জনগণ যদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আস্থা না রাখতে পারে তাহলে তারা বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগানো থেকে বঞ্চিত হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্যের মাত্রাও বাড়বে।
Published : 26 Dec 2024, 05:39 PM
আমার বর্তমান কর্মস্থলে চলতি সেমিস্টারে আমি ‘ইমার্জেন্সি কমিউনিকেশন’ বা ‘জরুরি পরিস্থিতিকালীন যোগাযোগ’ শীর্ষক একটি কোর্স পড়াচ্ছি। দিনকয়েক আগে এই কোর্সের একটি ক্লাসে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নে জরুরি পরিস্থিতিতে যোগাযোগ ক্রিয়া ও কৌশল। আলোচনার একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কাছে একগুচ্ছ প্রশ্ন ছিল, প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যায়, কেন? বাবা-মা, সন্তান, স্ত্রী কিংবা স্বামীর জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজনে কোথায় ডাক্তার দেখাবে? সরকারি হাসপাতালে, বেসরকারি হাসপাতালে, না বাইরের কোনো দেশে যেমন, ভারত, থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরে? সম্প্রতি করোনাকালে কেন সামাজিক দূরত্ব, নিয়ম মেনে চলা ও টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ মানুষ অনীহা দেখিয়েছিল? বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জবাব ছিল, ভরসার অভাব। আস্থা না থাকা। বিশ্বাস না করা। আমি আবার জানতে চাই, কাকে বিশ্বাস বা ভরসা করা যাচ্ছে না? জবাবগুলো ছিল ডাক্তারকে, নার্সকে, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও দেশের সরকারকে।
দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের আস্থা ও ভরসার বিষয়টিকে আমি আরেকটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি। জানতে চাই, এই ভরসা ও আস্থার মানে তাদের কাছে কী। আমার ওই ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জবাবগুলোকে এক জায়গায় করলে তার সারমর্ম দাঁড়ায় ঠিক এরকম— মানুষ যখন শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপন্নবোধ করে তখন সে আশা করে কিংবা বিশ্বাস করতে চায় যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার কল্যাণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এই বিপন্ন মুহূর্তে মানুষ ভরসা করতে চায় স্বাস্থ্যসেবাকর্মী তথা ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের ওপর এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তথা হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ওপর। এই বিপন্নতাকালে ডাক্তার, হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর ক্ষতিসাধন করবে না এটাই তাদের আশা। শুধু তাই নয়, সেবা দেবে শ্রদ্ধা ও যত্নের সঙ্গে। কোনো বাণিজ্যিক কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে শরীর, রোগ ও বিপন্নতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অর্থ ও ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করবে না। যাইহোক, স্বাস্থ্য, সুস্থতা ও বেঁচে থাকার প্রশ্নে জনগণের এই প্রত্যাশা ও ভরসার জায়গাটিকেই বলা যেতে পারে আস্থা। কাজেই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় জন-আস্থার বিষয়টিকে আমরা মোটাদাগে একটি দেশের জনগণের সামষ্টিক রায়, সিদ্ধান্ত, আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া, প্রত্যাশা, বিশ্বাস বা উপলব্ধি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। আর সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি ভরসা, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের দক্ষতা ও অঙ্গীকারবোধের জায়গাটি।
ওপরের আলোচনাকে গুছিয়ে নিয়ে এসে যখন জরুরি ও আপদকালে জনস্বাস্থ্য যোগাযোগ কৌশল নিয়ে কথা বলছি তখন আমার পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি কেঁপে ওঠে। বুঝতে পারি কোনো কল এসেছে। বুঝতে পারার আগে আরও পাঁচবার কল এসেছে। একই ফোন নাম্বার থেকে। জরুরি বিবেচনা করে আমার শিক্ষার্থীদের অনুমতি নিয়ে কলটি ধরি। ওপ্রান্তে আছেন আমার ছোটোবেলার শিক্ষক। তার কণ্ঠে প্রচণ্ড ভীতি, আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। তিনি জানালেন রাত থেকে বুকে ব্যথা, প্রেসার বেশি এবং কিছুটা ঘামও হচ্ছে। প্রত্যন্ত একটি গ্রামে থাকেন তিনি। আমি অনুরোধ করলাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে পরমর্শ করতে। তিনি সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিলেন না। আমি একটু জোরই করি। ফোন রেখে ক্লাসে মনোযোগ দেই।
রাতে আবার ফোন আসে। তিনি জানান, আমার কথামতো তিনি উপজেলা সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। নতুন পাশ করা এক জুনিয়র ডাক্তার তাকে দেখেন। ভালোভাবে দেখে কয়েকটা ওষুধ দেন। আর তিনি চিকিৎসা পরামর্শ দেন ব্লাড প্রেসারের ওঠা-নামা পর্যবেক্ষণ করে আবার দেখা করতে। আমার সেই শিক্ষককে আমি ডাক্তারের পরামর্শমাফিক চলতে বলি। তিনি খানিকটা বেঁকে বসেন। তার ধারণা, অতি জুনিয়র একজন ডাক্তার হয়তো তার রোগ ঠিক মতো নির্নয় করতে পারেননি। তাছাড়া সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা উন্নতমানের নয়। তাই তিনি স্থানীয় ক্লিনিকে আপাত সিনিয়র ডাক্তারকে দেখাবেন। প্রয়োজনে রাজশাহী কিংবা ঢাকায় যাবেন। কিছুটা অস্বস্তি ও বিরক্তি চেপে তার কথা শুনতে থাকি। আর বোঝার চেষ্টা করি, আমার ওই শিক্ষক যিনি কিনা স্থানীয় একটা কলেজেও পড়ান, দেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর তার এই আস্থাহীনতার কারণগুলো কী হতে পারে। লেখাটিতে মূলত এই দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় জনগণের আস্থার বিভিন্ন মাত্রা বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এই আস্থা গড়ে তোলা ও বজায় রাখার প্রশ্নে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।
এবার আসি আমার ক্লাসের শিক্ষার্থী ও গ্রামের শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে। আমার শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তাদের অধিকাংশই বিদেশে চিকিৎসা নিতে চান। অন্যদিকে আমার শিক্ষক চান কোনো বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে। তাদের এই চাওয়ার মূলে আছে আস্থার ঘাটতি। শিক্ষার্থীদের আস্থার ঘাটতি চিকিৎসা ব্যবস্থায়। আর শিক্ষকের আস্থার ঘাটতি চিকিৎসকের ওপর। অনুমান করি এর পেছনে চিকিৎসসেবা ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিংবা দেশের গণমাধ্যমে চিকিৎসক, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক উপস্থাপনার ভূমিকা থাকতে পারে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোনো উপলক্ষে করা যাবে। আজ কেবল আস্থার বিষয়টিকেই বিশ্লেষণ করা যাক।
জনগণ দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখবে কিনা; ভরসা করবে কিনা তা বেশকিছু অনুঘটকের ওপর নির্ভর করে। সেই অনুঘটকগুলোকে মোটাদাগে আমরা কয়েকটি ভাগে বিবেচনা করতে পারি। যেমন, আন্তঃব্যক্তিক পর্যায়ের আস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের আস্থা এবং গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা পর্যায়ের আস্থা। আন্তঃব্যক্তিক পর্যায়ের আস্থাকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের বুঝতে হবে রোগী ও তার স্বজনদের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সেবাকর্মীদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও মনোভাব। আর ওই অভিজ্ঞতা ও মনোভাবের জায়গাগুলো হলো স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের পেশাগত যোগ্যতা ও দক্ষতার গুণগত মান; তাদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ সক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানে স্বচ্ছতা; ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভরসা, বিশ্বাস ও প্রত্যাশার জায়গাটি।
আবার ব্যক্তিগত পর্যায়ে রোগী ও তার স্বজনরা স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের ওপর আস্থা রাখবে কিনা তা নির্ভর করে বেশকিছু সূচকের ওপর। আর ওই সূচকগুলো হলো রোগী ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মাঝে যোগাযোগের গুণগত মান; স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর সাংস্কৃতিক সক্ষমতা; সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মমতা ও আবেগ প্রকাশের দক্ষতা; মানবিক ও পেশাগত সম্পর্কের মাঝে ভারসাম্য; রোগীর প্রত্যাশা ও প্রয়োজনমাফিক পর্যাপ্ত সময় ধরে সেবা দেওয়া; রোগীর চাহিদা, পছন্দ ও মানবিক সক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং রোগীর সংস্কৃতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও চর্চার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।
অন্যদিকে রোগী বা তার স্বজনরা কোনো হাসাপাতাল বা ক্লিনিকের চিকিৎসা সেবার ওপর আস্থা রাখবে কিনা ওই প্রশ্নেও বেশকিছু অনুঘটক ক্রিয়াশীল থাকে। আর সেগুলো হলো ডাক্তারের ফি, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ খরচে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; ডাক্তারের চিকিৎসা পরামর্শ ও সাক্ষাৎ পাওয়ার ক্ষেত্রে কত সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়; দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আদৌ ডাক্তারের দেখানোর সুযোগ পাওয়া যায় কিনা; স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি চিকিৎসা প্রদানে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার; রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত করা; চিকিৎসা ও রোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা; রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে সহজ, সরল, সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ যোগাযোগ নীতিমালা; চিকিৎসাসেবা প্রদানে কোনো ভুল-ত্রুটি হলে তা স্বীকার করে নিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করা; সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা এবং সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদে প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম নিশ্চিত করা।
আর গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থার বিষয়গটি নির্ভর করে চিকিৎসা সেবা পেতে নিজ পকেট থেকে খরচের পরিমাণ এবং সেই খরচ মেটানোর সক্ষমতা; চিকিৎসা সেবা প্রদানে ডাক্তার-নার্স-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাকর্মী থেকে আরম্ভ করে সংশ্লিষ্ট সবার পেশার মানুষের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা। পাশপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অঞ্চল-জাতি-গোষ্ঠী-অর্থনৈতিক সক্ষমতাসহ যে কোনো নিরিখে বৈষম্য দূর করা; জরুরি জনস্বাস্থ্য প্রয়োজনে সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; চিকিৎসা গবেষণায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; সাম্যভিত্তিক স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন-কানুন কর্যকরভাবে প্রয়োগ করা।
এখন প্রশ্ন হলো, স্বাস্থ্যসেবা ওপর জন-আস্থার বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এই প্রশ্নের জবাব বহুমাত্রিক। প্রথমত, জনগণ যদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আস্থা না রাখতে পারে তাহলে তারা বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগানো থেকে বঞ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য সেবায় বৈষম্যের মাত্রা বাড়বে। বিষয়টিকে একটু ভেঙে বলা যাক। জনগণ যদি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর আস্তা ও বিশ্বাস না করে তখন সে বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধমূলক জনস্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে তুলনামূলক কম সাড়া দেবে কিংবা আদৌ অংশগ্রহণ করবে না। যেমন, হাসপাতালে চিকিৎসা না নিয়ে বিকল্প পন্থা খুঁজবে, দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাবে, কবিরাজ, ওঝা কিংবা অন্য কারও কাছ থেকে আরোগ্য খুঁজবে। কোনো রোগের চিকিৎসা বেশ দেরি করে নেবে। আর দেরি করে রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসা বাবদ খরচও যাবে বেড়ে। বিভিন্ন ভ্যাকসিন গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। কিংবা স্ক্রিনিং কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে না। একান্ত জীবন মরণের প্রশ্ন ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাবে না। ফলে চিকিৎসা সেবায় জটিলতা বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে অকালমৃত্যুর সংখ্যা। এছাড়া ডাক্তারের পরমর্শমাফিক ওষুধ খাবে না এবং মেনে চলবে না অন্যান্য চিকিৎসা বিধিনিষেধ; কিংবা চিকিৎসার মাঝপর্যায়ে এসে ওষুধ গ্রহণ বা অন্য পদ্ধতি ছেড়ে দেবে। আমলে নেবে না কোনো স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্যক্রম। রোগ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভুল ও অপতথ্য সম্পর্কে বিশ্বাস বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে এসব তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাত্রা। ফলে দেশের জনস্বাস্থ্যে এক ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।
দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা বাড়াতে বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিতে হবে। আর ওই ব্যবস্থাগুলো হতে হবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবাকর্মী পর্যায়ে, হাসপাতাল ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এবং গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবাকর্মী পর্যায়ে জন-আস্থা বৃদ্ধিতে জরুরি ভিত্তিতে যেসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে তা হলো, ডাক্তার-নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের রোগী-কেন্দ্রিক যোগাযোগ দক্ষতায় শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান। তাদের সাংস্কৃতিক সংবেদশীলতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা। চিকিৎসা ও সেবা প্রদানে প্রচ্ছন্ন কিংবা অজ্ঞাতসারে হলেও কোনোরকম বৈষম্য যাতে না হয় ওই লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা, প্রেরণা ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। চিকিৎসা ও স্বাস্থসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ডাক্তার যাতে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সময় দেন সেজন্য দরকারি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে জনগণের আস্থা বাড়াতে যা করতে হবে তা হলো, ক্লিনিক্যাল, নন-ক্লিনিক্যাল ও অন্যান্য কর্মী নিয়োগে বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড, ভৌগোলিক অঞ্চল ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার লোকজন নিয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবার বিভিন্ন খরচে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের দোরগোড়ায় বিভিন্ন স্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে হলে সাম্যভিত্তিক স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসেবা প্রাপ্তিতে খরচের পরিমাণ কমাতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসা সেবার গুণগত মান মূল্যায়ন ও যাচাইয়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানীয় বাস্তবতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় এমন মানদণ্ড ও ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণায় প্রণোদনা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইনের স্বচ্ছ ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের আস্থার বিয়টি অত্যন্ত জটিল ও বহুমাত্রিক। এই আস্থার ঘাটতি দেশের স্বাস্থ্য বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। কাজেই এই আস্থা গড়ে তোলা এবং বজায় রাখতে হলে বিভিন্ন স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে অতি জরুরি হলো ডাক্তার-নার্স-রোগীর যোগাযোগ ও সম্পর্ক উন্নয়ন, জনবান্ধব ও সাম্যভিত্তিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সম্পর্কে স্থানীয় জ্ঞান বিকাশে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রণোদনা প্রদান। সর্বোপরি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা আরও মানবিক করতে সেবা প্রদানকারীদের যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতায় দক্ষতা বৃদ্ধি করা।