পাকিস্তান সফরে এমনকি ‘বুচার অব বেঙ্গল' টিক্কা খানের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু কেন?
Published : 06 Oct 2022, 01:19 AM
আজ আপনি আমজনতা হিসেবে কোনও দেশকে, কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে শত্রুগণ্য করতেই পারেন। সেই আপনিই যখন এই দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হবেন, আপনি চাইলেও সেই ঘৃণা জারি রাখতে পারবেন না।
এই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ওই ঘৃণিত রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ করতেই হবে, যদি সেই দেশের সঙ্গে আপনার দেশের কোনও দেনা-পাওনা থাকে। কোনও হিসাব মেটানোর থাকে। কোনও আলোচনা থাকে। এভাবে পাকিস্তান ভারতের প্রধানমন্ত্রীরাও বৈঠক করেন। আমেরিকা-রাশিয়াও করেছে। ক্যাম্প ডেভিডে ইসরায়েল-আরবরাও করেছে। সেখানে আপনি সদিচ্ছা নিয়ে আলোচনায় এসেছেন সেই ভাব প্রকাশে আপনাকে তার সঙ্গে ছবি তুলতে হবে, করমর্দন করতে হবে। কিন্তু সেটা কখনও সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন নয়। ভারত-পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের করমর্দনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি কখনও বোঝায় না দুইদেশের মধ্যে বৈরিতা নেই।
একইভাবে ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে কোনও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর আর্কাইভে থাকা ছবিগুলো দেখে এই সিদ্ধান্তে আসবেন না আরাফাত পালেস্টাইন আন্দোলন বা ফাতাহকে বিক্রি করে ইসরায়েলিদের পা চেটেছেন। বা আরবরা ইসরায়েলিদের সব পাপ ক্ষমা করে তাদের বুকে টেনে নিয়েছে। নিয়াজী চারঘণ্টা আগে ব্যাপক কান্নাকাটি করলেও ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে হাসিমুখেই সই দিয়েছে আত্মসমর্পনে। দিস ইজ প্রটোকল।
কথাগুলো বলা আসলে আমাদের একদল জ্ঞানপাপীর উদ্দেশ্যে। যারা ইচ্ছেকৃত ইতিহাসবিকৃতির মাধ্যমে, মনগড়া আরোপের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বড় কোনো অর্জনকে মিথ্যার মাধ্যমে তুচ্ছ ও ঘৃণিত বানিয়ে ফেলার অপচেষ্টা করে। যারা সাইনবোর্ডে চরম ডান বা চরম বাম হলেও মোক্ষে এক, ভাষায় ও নিন্দাবাদে এক। এবং তারা এখনও মন থেকে তাদের পুর্বসূরীদের মতো এই দেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। নানা মিথ্যাচারের মতো নানা নুইসেন্স লজিকের মতো তারা মুজিব ভুট্টোর প্রসঙ্গ এনেছে, পাকিস্তানে ১৯৭৪ সালের বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক সফরকে নোংরা বানিয়েছে।
কোনও দেশ স্বাধীন বলে নিজেকে ঘোষণা করলেই স্বাধীন হয়ে যায় না। সেই স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রয়োজন। আর যেই দেশের মানুষের বেঁচে থাকাই পরের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল তার তো সেই মুখ থাকে না ভিক্ষার চাল কাড়া না আকাড়া যাচাই করার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই গরীব দেশের মানুষের নেতা, তারপরও মাথা উঁচু করে চলার চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ, বাতাসে লাশের গন্ধ, পানিতে লাশ। ফসলের জমি সব বোমার আঘাতে দীর্ণ, নদীর পানিতে লাশ, মাছেরা সেই লাশ খায় বলে জেলেরা মাছ ধরেন না, কারণ সেই মাছ কেউ খাবে না। সাত কোটি ভুখা বাঙালি নিয়ে মুজিব তাও মাথা উঁচু করে কথা বলে গেছেন। তার এই ভাবটা দেখা গেছে প্রথম দিন থেকেই।
১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই। সেখানে তিনি বললেন, “তোমরা ব্রিটিশরা জানো আমার দেশ সম্পর্কে, সেটা স্বর্ণগর্ভা। তোমরা দুশো বছর সেখান থেকে নিয়েছো, নিজেদের সমৃদ্ধ করেছো। এবার তোমাদের কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আমার দেশের মানুষ না খেয়ে আছে।”
মুজিব চাইলেই সেইসময় শীতল যুদ্ধের দুই পরাশক্তির একটাকে বেছে নিতে পারতেন। রাশিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে। জাতিসংঘে ভেটোর পর ভেটো দিয়ে নিশ্চিত করেছে স্বাধীনতা। কিন্তু মুজিব অপেক্ষা করেছেন। অর্থ সাহায্য চেয়ে এমনকি নিক্সনের সঙ্গে যখন বৈঠক করছেন তখন সেই কথোপকথনের লিখিত রূপে দেখা যায় তিনি বলছেন, “আমার দেশের পাট আছে, আমার মাটির নীচে গ্যাস আছে। তোমরা সাহায্য দাও, আমি দেশটাকে দাঁড় করাই, কথা দিচ্ছি বছর দশেকের মধ্যে আমরা তোমাদের সব ঋণ সুদে আসলে ফিরিয়ে দেবো।” নিজেকে বিকিয়ে না দিয়ে এভাবে ভিক্ষা চাইতে পারে কয়জন!
সে সময় সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে ছিল পাকিস্তানি যুদ্ধপরাধীদের বিচার। যা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক চাপ ছিল নানামুখী। প্রথম কথা বাংলাদেশ তখনও আরব দেশগুলোর স্বীকৃতি পায়নি। স্বীকৃতির বিনিময়ে তারা বলেছে, পাকিস্তানিদের ছেড়ে দিতে। বিশ্ব ব্যাংক এবং দাতা দেশগুলো এলো নতুন দাবি নিয়ে। তারা বললো- বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ভালো কথা, এখন পাকিস্তানকে আমরা যেসব খাতে ঋণ দিয়েছি সেগুলোও তাকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে! পাকিস্তানের কাছে যেখানে আমরা সম্পদের ভাগ চেয়ে দাবি তুলতে যাচ্ছি, সেখানে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না নেওয়া ঋণের বোঝা।
অবশ্য তার শর্ত শিথিলযোগ্য, যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করা হয়! বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পাচ্ছিলো না। কারণ চীন ভেটো দিচ্ছে। হ্যা, সদস্যপদ পাওয়া সম্ভব, চীনপন্থিদের কাছে প্রিয় চীনও বাগড়া দিবে না, যদি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
সিমলায় জুলফিকার আলী ভুট্টো শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। দুই দেশের মধ্যে বৈরিভাব দূর করতে এবং যুদ্ধবন্দি বিনিময় চুক্তি করতে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! ভারতের কাছে যারা যুদ্ধবন্দি, বাংলাদেশের কাছে তারা যুদ্ধাপরাধী। বাংলাদেশকে ছাড়া এমন কোনো চুক্তিতে আসা সম্ভব না। মুজিবের দূরদর্শিতা এখানেই যে, ভারত-পাকিস্তান ১৯৭১ সালকে নিজেদের যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে পারেনি, আটক পাকিস্তানিদের স্রেফ যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিনিময়যোগ্য করতে পারেনি। কারণ ওই যুদ্ধাপরাধের তকমা। অতএব বাংলাদেশকে আমলে নিতে হবেই। এবং যা আলোচনা হবে ত্রিপাক্ষিক।
এদিকে ভুট্টোর কাউন্টার মেজার শুধু আরব দেশ, চীন এবং মার্কিন চাপেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি পাল্টা হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন যে, তার দেশে আটকে পড়া বাঙালিদের একইরকমভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বিচার করবেন, যদি বাংলাদেশ পাকিস্তানি কোনও সেনা সদস্যকে বিচারের মুখোমুখি করে। সেজন্য পাকিস্তানে দুই হাজার বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে জেলে পুরে তাদের বিচারের প্রাথমিক ব্যবস্থাও সারলেন।
শেখ মুজিব বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন ন্যামে। ‘নন অ্যালাইড মুভমেন্ট’ (জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন) নামে এই জোটের জন্ম ১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে। মার্কিন-সোভিয়েত বলয়ের প্রভাবমুক্ত থেকে ২৫টি উন্নয়নশীল দেশ এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে সূচনা করেছিলো এর। ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ এর সদস্য হয়।
আলজিয়ার্সের সেই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ ফিদেল কাস্ত্রো বলে ওঠেন: “আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি!” সেই সম্মেলনেই মিশর, আলজেরিয়া ও লিবিয়ার মাধ্যমে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে একটা মীমাংসায় যাওয়ার উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। এ কথা মনে রাখতে হবে তখনও বাংলাদেশের পাসপোর্টে হজ করার সুযোগ পেতো না বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলমান।
এই দূতিয়ালির মাধ্যমেই ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠেয় অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি) এর সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায় বাংলাদেশ। আরব দেশগুলোর তরফে (বিশেষ করে কুয়েতের) বলা হলো, চলমান অচলাবস্থা কাটাতে নিজেদের সদিচ্ছা প্রমাণের এটাই সুযোগ বাংলাদেশের। মোক্ষম সময়ে মুজিব বললেন, অবশ্যই আমি এই সফরে যাবো। কিন্তু…। বাট…। পাকিস্তানকে আগে স্বীকৃতি দিতে হবে বাংলাদেশের। স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি।
১৮ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় সংসদ থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন ভুট্টো। মুজিব গেলেন পাকিস্তান। হাসলেন। ছবি তুললেন। এমনকি ‘বুচার অব বেঙ্গল টিক্কা খানে’র সঙ্গেও হাত মেলালেন (প্রটোকল, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের বাড়ানো হাত ফেরাতে পারেন না তিনি। সদিচ্ছা প্রমাণ বলে কথা।)। ফিরতি সফরে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন ভুট্টো। দুই দেশের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির অংশবলে পাকিস্তান তাদের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত সেনা অফিসারদের বিচার নিজেরাই করবে- এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নেয়। বিনিময়ে ফেরত দেয় আটক বাঙালিদের।
কী এনেছেন শেখ মুজিব পাকিস্তানে ওই হাসিমুখের পোজ দিয়ে, কলঙ্কিত সেনানায়কের সঙ্গে হাত মিলিয়ে?
১. স্বাধীন দেশ হিসেবে পাকিস্তানের স্বীকৃতি
২. জাতিসংঘের সদস্যপদ, চীনের ভেটো পাকিস্তানের অনুরোধে বন্ধ হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে জাতিসংঘে উদযাপন করলেন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি।
৩. মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতি এবং সাহায্য, যদিও সৌদি আরব চীনের মতোই ১৬ অগাস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, তবে হজের অনুমতি মিলেছে।
৪. আটকে পড়া দুই লাখ বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে আনা
এখন এটা বঙ্গবন্ধুর পাপ হয়েছে? ওয়েল, সফল পররাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞা তাহলে নতুন করে শিখতে হবে বন্ধুরা।
আমি শুধু গর্বভরে বলবো, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
পুনশ্চ: ফিরতি সফরে ভুট্টো এসে বাংলাদেশে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা পাননি, তাকে শুনতে হয়েছে ‘কসাই ভুট্টো ফেরত যাও শ্লোগান’। ভুট্টোর বোঝা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশে তার অবস্থান। মুজিব হত্যার পর তড়িঘড়ি দুই জাহাজ বোঝাই চাল আর কাপড় পাঠিয়ে সেটা মেরামতির চেষ্টা ছিল এবং ১৯৭৬ সালের ৭ই নভেম্বর, কথিত ‘সিপাই জনতা বিদ্রোহে’র এক বছর পূর্তির উপহার হিসেবে ভুট্টো বাংলাদেশকে একটি বোয়িং বিমান উপহার দেন। বাংলাদেশ বিমানের প্রথম বোয়িং যা গ্রহণ করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।