Published : 19 Dec 2013, 06:40 PM
তারানকোর উত্তাপে ঢাকায় বরফ গলা শুরু হয়েছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন খাদে পড়েছে। ৬ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। পাঁচদিনের সফরের সময় তিনি ছোটাছুটি করেছেন এ অফিস থেকে ও অফিসে, এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে, এক নেত্রীর কাছ থেকে অপর নেত্রীর কাছে, এক দল থেকে অন্য দলে। দুই প্রধান বিবদমান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপের টেবিলে নিয়েও এসেছেন। সমাধানের অন্তরায় কোথায়, তা-ও সঠিকভাবে সনাক্ত করেছিলেন।
কর্মস্থল জাতিসংঘে ফিরে যাওয়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, দুই দলকে আলোচনায় বসিয়েছেন, এবার আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাদের। তখন মনে হয়েছে, অনেকটা বেসামাল হয়েই তিনি এ কথা বলেছিলেন। কারণ, মহাসচিব বান কী মুনের উদ্যোগের সময় পর্দার অন্তরালের কোনো ঘটনাই থেমে থাকেনি। চারদিকে আঁটঘাট না বেঁধেই তিনি তার দূত ফার্নান্দেজ তারানকোকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। তারানকোর সফরের পর বরং দ্রুত যেসব ঘটনা ঘটে গেল, তার ফলে রাজনীতিতে নতুন দৃশ্যপট সৃষ্টি হয়েছে, যা আরও জটিল ও বিতর্কিত।
দুই দল যখন আলোচনার প্রথম পর্যায়ও অতিক্রম করতে পারেনি, তখন জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি আসনে নির্বাচনের একতরফা ফল নির্ধারিত হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১২৭টিসহ ১৫৪ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন– প্রার্থী ও ভোটার কাউকেই মাঠে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন হয়নি। ভোট নিয়ে কারচুপি হয়েছে, মারপিট হয়েছে, ভোটের বাক্স ছিনতাই হয়েছে– এ অভিযোগ করার কোনো উপায় নেই।
বাকি আসনগুলোতে নির্বাচন না হলেও কোনো অসুবিধা নেই, সংবিধান অনুসারে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট আবার সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারির পর তারা যে কোনো দিন সুবিধামত সরকার গঠন করতে পারবে। ওই একই মাঠে একই সঙ্গে আবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলনও চলছে।
বিএনপির এ আন্দোলনের ছত্রছায়ায় চলছে ১৮ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব আন্দোলন। গত ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি এই প্রথম কার্যকর করা হল। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে এ শাস্তি কার্যকর করার ওয়াদা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ফাঁসি কার্যকরের পর একদিকে শাহবাগ চত্বরে আনন্দ-উল্লাস হয়েছে রাতভর, অপরদিকে তেমনি দেশজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আরও সহিংস ঘটনাবলি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জনগণ পরিচিত ছিল না। খুনখারাবি, গোলাগুলি, মারপিট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ– সারাদেশে সব রকম নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চলছে একযোগে। মন্ত্রী-এমপির বাড়িতে, বিচারপতির বাড়িতে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বাড়িতে, হাটবাজারের দোকানে আগুন দেওয়া হচ্ছে নির্বিচারে। রাজধানীর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক দূরবর্তী এলাকার। জামায়াত-শিবির যেমন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে, তেমনি র্যাব-পুলিশও হিংস্র আচরণ করছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারীপুরুষ, বোবাবধির কেউ রেহাই পাচ্ছে না।
লাশের মিছিল প্রতিদিনই বাড়ছে। আগুনে পুড়ে মরার এমন নারকীয় দৃশ্য কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দেখেনি। টেলিভিশন আর সংবাদপত্র খুললে মনে হয় দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নীরবে নির্বিঘ্নে নির্বাচন হয়ে গেল, ভোটাধিকার প্রয়োগ না করেও আগাম ফলাফল জানতে পারল বিপন্ন জাতি।
নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের পার্টনার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান 'অসুস্থ' এরশাদ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিভৃত কক্ষে শোয়েও জানতে পারলেন, 'অভিমান' করে তিনি ভুল করলেও অকুতোভয় নির্বাচন কমিশন ভুল করেনি। দ্বিতীয়বার সাচ্ছা যাচাই-বাছাইয়ের পর তার মনোনয়ন প্রত্যাহারপত্রে অমার্জনীয় ভুলভ্রান্তি ধরা পড়ে। অতএব, নির্বাচন কমিশন এরশাদের মনোনয়ন প্রত্যাহারপত্র প্রত্যাখ্যান করে তার নামও ১৫৪ জনের তালিকাভুক্ত করে নেয়।
একতরফা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না-করা নিয়ে এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ চলছে। এরশাদ সর্বদলীয় না হলে একদলীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না-করার ব্যাপারে অনড়, কিন্তু রওশন এরশাদ নির্বাচনে যাবেনই। নির্বাচন কমিশন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অবশ্য এরশাদ-রওশনের গৃহবিবাদের আপাত একটা মীমাংসা করে দিল! এরশাদের উপর বালা-মুসিবত শুরু হয় ৪ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর। এরশাদ দিল্লির সুহৃদ হিসেবেই পরিচিত। সেই অধিকার নিয়েই সুজাতা সিং তাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু এরশাদ ঔদ্ধত্য দেখান তা নাকচ করে দিয়ে।
এরপর বৈঠক শেষে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে তিনি আবার তা সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দিয়ে বলেন, আমি আবারও বলছি, আমি একতরফা নির্বাচন করব না, করব না। হাজার হলেও বৃহৎ শক্তির একটা গরিমা আছে। এরশাদের সেদিনকার আচরণে সবাই হতভম্ব হয়েছিল। এখন তাকে নিয়ে যে নাটক চলছে, তা দৃশ্যত কমেডি মনে হলেও শেষ হতে পারে ট্র্যাজেডি হিসেবে। ভবিষ্যতে অনেক বেয়াড়া নেতানেত্রীর বেলায়ও এমন ঘটনা ঘটতে পারে, এটা তারই ইঙ্গিত।
এরশাদ কি অসুস্থ, না আটক? তাকে হয়তো সর্বশেষ বার্তা দেওয়ার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী সামরিক হাসপাতালে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। এরশাদকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি কি সংসদে বসবেন, না কারাগারে যাবেন। এখন শোনা যাচ্ছে, নির্বাচনকে ঝামেলামুক্ত করার জন্য তাকে সসম্মানে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে এবং তিনিও সানন্দে তা গ্রহণ করেছেন।
তারানকো ঢাকায় পৌঁছার ৪৮ ঘণ্টা আগে সুজাতা সিং ঢাকায় এসে চূড়ান্ত মন্ত্র পাঠ করে গেছেন। ফলে তারানকোর শত দৌড়ঝাপেও উত্তরের বাতাস দক্ষিণে বহেনি। বরং ঘূর্ণিবায়ুর আকার ধারণ করে এক জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে– আওতার মধ্যে যা পাচ্ছে, তা শূন্যে তুলে আবার আছড়ে ফেলছে। তারানকোর ঢাকায় অবস্থানরত অবস্থায়ই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কী মুন ও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে নৈরাজ্যকর ও সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধানের তাগিদ দেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেন একাধিকবার।
উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ও আলোচনায় বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের আশংকা প্রকাশ করেন। তারানকোও তার ঢাকায় অবস্থানের সময় কাদের মোল্লার ফাঁসি না কার্যকর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সে অনুরোধ উপেক্ষা করে ১০ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ওই দিন রাত ১২.০১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়। অবশ্য আইনি জটিলতার কারণে তা দুদিন পিছিয়ে যায়। কিন্তু কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করায় সারাদেশে, বিশেষত কয়েকটি অঞ্চলে যে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, সরকার তার মোকাবিলা করতে পারছে না।
এসব সহিংস ঘটনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীসহ গত সোমবার পর্যন্ত ৩০ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হরতাল ও অবরোধের সময় নিহত হয় আরও ৭৫ জন। যাহোক, শক্তিধর ব্যক্তিদের টেলিফোনেও কোনো কাজ হয়নি। রাজনৈতিক সংকটের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের তফসিল স্থগিত রাখার জন্য তারানকো প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনকে যে অনুরোধ করেছিলেন, তার প্রতিও কেউ কর্ণপাত করেননি। কয়েক দিন আগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ঢাকা এসেছিলেন। তিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয় নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে দুই নেত্রীকে চীনের মনোভাব অবগত ও বিরোধের মীমাংসা করা। কিন্তু আলোচনার ফলাফল নিয়ে চীনা কূটনীতিকদের মুখ থেকে বিস্তারিত কিছুই প্রকাশ পায়নি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা কেবল ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ব্যাপৃত হয়েছে ওয়াশিংটনে। ঢাকায় ঝটিকা সফরের পর সুজাতা সিং গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানসহ বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়েও তার আলোচনা হয়। দিল্লির দৃষ্টিতে, বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি এই তিনটি দেশই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। জন কেরি ছাড়াও সুজাতা সিং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরও কয়েকজন সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে।
পরে দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতির ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের যে মনোভাব, তাতে তারা হতাশ এবং এই হতাশার কথা মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। তার বক্তব্য অনুসারে, জামায়াতে ইসলামী একটি সন্ত্রাসী দল। কিন্তু আমেরিকা তা মনে করে না। আমেরিকা বিএনপি ও জামায়াতের অংশগ্রহণেই নির্বাচন চায়। কেননা তারা কৌশলগত কারণে বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে স্বস্তি বোধ করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের মূল উৎস দিল্লি ও ওয়াশিংটনের বিরোধ এবং সমাধানের চাবিকাঠিও তাদের কাছেই।
লক্ষণীয়, যে কারণে ভারতের কাছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ, ভিন্ন কারণ হলেও এই তিনটি দেশই আবার আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ, দক্ষিণ এশিয়ার এই তিনটি দেশে ভারত ও আমেরিকার স্বার্থ এক নয়। সুতরাং আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের একক মোড়লিপনা আমেরিকা মেনে নিতে রাজি নয়। দুই শক্তিধর দেশের স্বার্থের সংঘাত বাংলাদেশকে অনিশ্চিতভাবে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে– আমরা এখন তারই ভুক্তভোগী ।
এদিকে, আকস্মিকভাবেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের সকল অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করলে তারা কেবল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট নিরসন ও সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। তারা তাদের অবস্থানের সপক্ষে ও একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদে, অশোভন হলেও এ ধরনের কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। বাংলাদেশের তৈরিপোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপীয় দেশগুলো। জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজার থেকে আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকদের হাত গুটিয়ে নিতে হবে। ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ইকনোমিক টাইমস সম্প্র্রতি এক বিস্তারিত রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতের পোশাক কারখানাগুলোকে ব্যাপক হারে অর্ডার দেওয়া শুরু করেছে। যেসব কারখানায় অর্ডারের অভাবে ঝিমুনিভাব ধরেছিল, তারাও এখন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে– দিনরাত ব্যস্ততা চলছে।
আওয়ামী-বিএনপির মধ্যে যে কয়েক দফা নিরুত্তাপ বৈঠক হয়েছে, তা ছিল মুখরক্ষার মহড়া। আলোচনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে ওয়াশিংটনের কেরি-সুজাতার বৈঠকে। তবে এই নিষ্ফল আলোচনার ফায়দা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির নেতাদের মুখে ললিপপ ধরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ এই ফাঁকে সংসদের অর্ধেকেরও বেশি আসনে নির্বিঘ্নে নির্বাচন সেরে ফেলেছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের (১৩ ডিসেম্বর) দুদিন পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুঝতে পারেন নীলনকশার নির্বাচন চলছে। সাংবাদিক সম্মেলনেও না, কাগজে বিবৃতি দিয়ে সরকারকে নীলনকশার নির্বাচন বন্ধ করার দাবি জানান।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার অনুমতি চেয়ে বিএনপি আবেদন করেছিল পুলিশ প্রশাসনের কাছে। কিন্তু আবেদন প্রত্যাখান করায় বিএনপি নিশ্চুপ ও নিশ্চল হয়ে যায়, বিজয় দিবস উদযাপনে রাস্তায় নেমে একটা মিছিল করারও সাহস দেখায়নি। দেশের এমন ধ্বংসোন্মুখ ও সংঘাতময় পরিস্থিতির ব্যাপারে জাতিকে জানানোর মতো তাদের কোনো বক্তব্য নেই। দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটছে মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত। এমন দুঃসময়ে জাতি বেগম খালেদা জিয়ার মুখে শুনতে চায় এ দুঃস্বপ্নের অবসান কীভাবে, কবে হবে।
প্রতিদিন জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তার দায়দায়িত্ব নিঃসন্দেহে সরকারের। কিন্তু বিরোধী দল দায়িদায়িত্বের উর্ধ্বে নয়। নিরাপদ অবস্থানে থেকে একের পর এক হরতাল, অবরোধ দিলে বিরোধী দলের দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। নেতানেত্রীরা মাঠে না থাকলে কর্মীরাও মাঠে থাকে না। কিন্তু বিএনপির নেতানেত্রীরা সেই আত্মঘাতি কৌশল অবলম্বন করে মাঠ থেকে উধাও হয়ে চলে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন জামায়াত-শিবিরের উপর। বলা যায়, মফস্বলমুখী আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করছে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
জামায়াতের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। তারা লড়াই করছে অস্তিত্ব রক্ষা ও ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে শীর্ষ নেতাদের মুক্ত করার জন্য। বিএনপির লড়াই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য। কিন্তু আন্দোলনে বিএনপির নিষ্ক্রিয়তার ফলে জামায়াত-শিবিরের লড়াই-ই প্রধান হয়ে উঠেছে। দিল্লির আশংকা, জামায়াত-শিবিরের এ জঙ্গিপনা পরিণতিতে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
নির্বাচনের তফসিল অনুসারে আগামী ৫ জানুয়ারি ভোট। কিন্তু ভোটের আগেই জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে কাগজে-কলমে ১৫৪ আসনে নির্বাচন হয়ে গেছে। কারণ, এসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা অভাবনীয় ছিল না। এটা অনুমান করেই তারানকো প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের কাছে ছোটাছুটি করেছিলেন নির্বাচনের তফসিল স্থগিত বা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাকে বোঝানো হয়েছে, সমঝোতা হলে সবই সম্ভব। কিন্তু সমঝোতা হল না, তফসিল অনুসারে সবই হল।
নির্বাচন কমিশনকে চাবি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ইঞ্জিনের মতো তারা কাজ করছে। সে একতরফা কাজেও অনেক গলদ। ১৩ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় হলেও ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্তও সব জেলা থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা কমিশনের অফিসে এসে পৌঁছেনি। কেননা, সরকার ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের নির্দেশে তখনও প্রার্থী পরিবর্তিত হচ্ছিল। এই বিলম্বের কারণ সাংবাদিকরা জানতে চাইলে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এটা সম্পূর্ণভাবেই রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব, আমাদের কিছু করার নেই।
জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে এরশাদ ঘোষণা দিয়ে কমিশনকে তার দলের প্রতীক 'লাঙ্গল' কাউকে বরাদ্দ না দেওয়ার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু কমিশন তা শোনেনি, নিয়ম ভঙ্গ করে পছন্দসই প্রার্থীদের 'লাঙ্গল' প্রতীক বরাদ্দ করেছে। এসব অনিয়মসম্পর্কিত কোনো প্রশ্নের সদুত্তর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিনও দিতে পারেননি। অর্থাৎ যে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করছে, তারা নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নির্দেশ শুনছে না, শুনছে সরকার ও সরকারি দলের কথা। এ নির্বাচন কমিশন কেবল দন্তহীনই নয়, লুলা-ল্যাংড়া ও বধির। অবশ্য তাদের এ পরিচয় নতুন নয়, সার্চ কমিটি সার্চিং দিয়েই তাদের আবিষ্কার করেছিল। বিচারপতি সাদেকের তারা নবসংস্করণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বহুবার বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে তিনি জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ফলে প্রায় পাঁচ কোটি ভোটার (অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি) ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারি বাকি আসনগুলোতে যে নির্বাচন হবে, তখন নির্বাচন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া এবং বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘটনা, এবারই প্রথম নয়। ১৯৭৩, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালেও এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জনের নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এরশাদ সরকারের সময় অনুষ্ঠিত ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে আ.স.ম. রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ও কয়েকটি নামজানা-নাজানা খুচরা দল বা গ্রুপ ছাড়া আওয়ামী লীগ, বিএনপি, পাঁচদলীয় বাম মোর্চা ও জামায়াত কেউই অংশগ্রহণ করেনি।
খালেদা জিয়া সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনও ছিল একতরফা– ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও বাম দলগুলো অংশ নেয়নি। ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এরশাদের সরকার এবং ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত খালেদা জিয়া সরকার– কেউই ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাদের পতন হয়েছিল গণআন্দোলনের মুখে।
কিন্তু এবার সরকারবিরোধী আন্দোলন সারা দেশে যেভাবে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, তা নজিরবিহীন, প্রধানত এ কারণে যে, স্বাধীনতার পর অনেক দুর্যোগ-দুঃসময় গিয়েছে, কিন্তু জাতি এভাবে কখনও সরাসরি বিভক্ত হয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়নি। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলোও বাংলাদেশের পরিস্থতিকে প্রভাবিত করার জন্য কখনও এত তৎপর হয়ে ওঠেনি। নিজ নিজ স্বার্থের জন্য তারা যে আমাদের বিভক্তির সুযোগ গ্রহণ করছে, তা এখন আর পর্দার অন্তরালে নেই, প্রকাশ্যেই চলে এসেছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল– শেখ হাসিনার এ উক্তি যেমন ঐতিহাসিকভাবে সত্য, তেমনি এবার তিনি যে নজির স্থাপন করলেন, ইতিহাসে তা-ও নজিরবিহীন।
নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে এখন অনেকেরই জিজ্ঞাসা, তাহলে সর্বশেষ কী হতে যাচ্ছে? নির্বাচন কি হবে? যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এখন আর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, কথা বলা যেতে পারে একাদশ অর্থাৎ পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, এখনও সময় আছে, নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে সমঝোতা করুন। এই ঘোরে আছে বলেই বিএনপির এই দুর্দশা।
বিএনপি ট্রেন মিস (Miss) করেছে, টিকিট হাতে স্টেশনেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন সমঝোতার সময় বা অবকাশ কোনোটাই নেই– রাজনৈতিক সমাধানের আওতা অতিক্রম করে আইনি সমাধানের পথে গড়িয়েছে।
১৯৯৬ সালে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সমাধান করতে হয়েছিল জাতীয় সংসদে বিল পাস করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কাজেই ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন। দেশে-বিদেশে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও সংবিধান অনুসারে ৫ জানুয়ারির পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পরও বিএনপিকে সরকার গঠন করতে হয়েছিল।
তবে আন্দোলনের মুখে তিন মাসের মাথায় ওই বিএনপি সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, তার স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে এ কথাই বলা যায় যে, দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতার অভাবে তার ভিত হবে নড়বড়ে।
এ ধরনের সরকার স্থিতিশীল হয় না, স্থায়িত্বকাল সংক্ষিপ্তই হয়, ইতিহাসের নজির তাই বলে।