সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারতের ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ভারত ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতার দিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬০ টি জায়গায় কাঁটাতার দেয়া হয়েছে জিরো লাইনের দেড়শ গজের মধ্যে। এসব নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে।
Published : 23 Jan 2025, 06:20 PM
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত তিনটি এলাকায় উত্তেজনাকর পরিবেশ দেখা গেছে। সবচেয়ে নজরে এসেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌকা ও কিরণগঞ্জ সীমান্তের ঘটনা। ১৮ জানুয়ারি সেখানে যা ঘটলে তার নজির নিকট অতীতে নেই। সীমান্তের দুই পাশ থেকেই হাজারের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সীমানায়। বিতণ্ডায় জড়িয়েছেন নিজেদের মধ্যে। ফেইসবুক ছেয়ে গেছে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ফুটেজে। বিএসফকে এদিন টিয়ার শেল ছুঁড়তে দেখা গেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে সীমান্তে এমন ঘটনার উদাহরণ স্মরণকালে নেই।
ঘটনার সূত্রপাত নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা ব্যাটালিয়ানের (৫৯ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল গোলাম কিবরিয়া একটি টেলিভিশনের সঙ্গে যা বলছিলেন, ঠিক তা-ই উদ্ধৃত করা হলো– “বাংলাদেশি কিছু কৃষক ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ওদের কিছু গম খেত, অল্প পরিমাণ গম, ঘাস অথবা গম কাটে। এইটার প্রতিশোধ হিসাবে ভারতীয় কৃষকরা আমি বলবো, বিএসএফের প্রশ্রয়েই বলবো, তারা এসে বাংলাদেশে জিরো লাইনের পাশাপাশি কিছু আমগাছ ছিলো, আমগাছে কিছু ডালা কেটে ফেলে। তো এই ডালা কাটতে যেয়ে বাংলাদেশের গ্রামবাসীরা ভারতীয় নাগরিকদের ও বিএসফকে বাধা প্রদান করে।”
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরপর যা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত বটে। তবে তা বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন বিজিবির কর্মকর্তারা।
গত ১ জানুয়ারি লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রামের সরকারপাড়া সীমান্তে জিরো লাইন ঘেঁষে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার চেষ্টা করে বিএসএফ। খবর পেয়েই বিজিবি ঘটনাস্থলে গেলে কাজ বন্ধ হয়। ৭ জানুয়ারি লালমনিরহাটের ধবলসুতি সীমান্তে ল্যাম্পপোস্ট তৈরির চেষ্টাও বন্ধ করে বিজিবি। ৮ জানুয়ারি বিএসএফ একই রকম উদ্যোগ নেয় নওগাঁর ধামইরহাট সীমান্তে। সেখানেও উত্তেজনা নিরসনে পতাকা বৈঠক হয়। ১০ জানুয়ারি ফের দহগ্রামে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার চেষ্টা করলে সেটিও বন্ধ হয় বিজিবির বাধায়। একের পর এক এমন সব ঘটনায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয় উদ্বেগ। মনে করিয়ে দেয়া হয় জিরো লাইনের ১৫০ গজের ভেতর কোনো স্থাপনা তৈরি না করার আইনি বাধার কথা। বিপরীতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারাও দাবি করেন আইন মেনেই যা করার করছেন। তাহলে গলদটা কোথায় হচ্ছে?
সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের প্রথম চুক্তি হয় ১৯৭৪ সালে। ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট নামের চুক্তিটি ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নামেও পরিচিত। এই চুক্তিতেই স্থান পায়, দক্ষিণ বেরুবাড়ীর বদলে আঙ্গরপোতা-দহগ্রামে যাতায়াতের জন্য তিন বিঘা করিডোরের স্থায়ী বন্দোবস্ত, ছিটমহল বিনিময়, ফেনী-মুহুরী নদী, বেদখলে থাকা ভূমির মালিকানা নিশ্চিতকরণ, অচিহ্নিত সীমান্ত চিহ্নিতকরণসহ নানা বিষয়। ১৯৭৫ সালে দুই দেশ সই করে ‘জয়েন্ট ইন্ডিয়া বাংলাদেশ গাইডলাইন্স ফর বর্ডার অথরিটিজ’। এই গাইডলাইনের ৮ নম্বর পয়েন্ট অনুসারে জিরো লাইনের দুদিকে দেড়শ গজ করে মোট তিনশ গজের মধ্যে কোনো দেশ স্থায়ী বা অস্থায়ী প্রতিরক্ষা কাঠামো তৈরি করতে পারবে না। এই গাইডলাইনের ফলেই কাঁটাতারের বেড়াগুলো ভারতের দিকে দেড়শ গজ ভেতরে দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আসাম আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে ‘আসাম শান্তি চুক্তি’ সই করে। এই চুক্তির প্রভাবেই মূলত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরির উদ্যোগ নেয় ভারত। তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার এতে উৎসাহ না দেখালেও, বিরোধিতাও করেনি। ১৯৭৫ সালের গাইডলাইন মেনে দেড়শ গজ ভেতরে বেড়া দিতে শুরু করে ভারত। কিন্তু ছন্দপতন ঘটে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর। ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন শেষে বিএসএফের মহাপরিচালক রমন শ্রীবাস্তব সাংবাদিকদের বলেন, “মানবিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে, প্রয়োজনীয় অংশে দেড়শ গজের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে সম্মতি দিয়েছে ঢাকা।” সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইনুল ইসলাম। তিনিও সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ২০১০ সালের ১২ মার্চ দ্য ইকোনমিক টাইমসের শিরোনাম ছিলো, ‘ঢাকা ওকে টু ফেন্সিং উইথ ১৫০ ইয়ার্ডস’। সেখানে বলা হয় ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেই এই সিদ্ধান্ত নেয় দুই সরকার। যা প্রকাশ্যে আসে বিডিআর-বিএসএফ সম্মেলনে।
২০১০ সালের ১৮ অগাস্ট প্রথম বিএসএফের তরফে চিঠি লেখা হয় বিজিবিকে। ৬টি স্থানে কোনো গেট ছাড়া এক সারির বেড়া দেয়ার প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে লেখা অনুমতি চেয়ে লেখা হয় সেই চিঠি। ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি ফিরতি চিঠিতে, সরকারি অনুমোদনের কথা জানিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে বেড়াগুলো তৈরির অনাপত্তি দেয় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর (২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি বিডিআর আনুষ্ঠানিকভাবে বিজিবি নাম ধারণ করে)। এরও কয়েক মাস পর ২০১১ সালের জুলাইতে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বিজিবি ও বিএসএফ। ৩০ জুলাই এতে সই করেন তৎকালীন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আনোয়ার হুসাইন ও বিএসএফ মহাপরিচালক রামান শ্রীবাস্তব। ২০১০ সালের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক ও ২০০৯ সালের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের বরাতে পরিকল্পনা সাজানো হয়। এতে অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি জিরো লাইনের ১৫০ দেড়শ গজের ভেতর ‘ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কস’ নিয়ে ঐক্যমত হয়। বলা হয় দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনী স্থানীয় পর্যায়ের ইস্যুগুলো মীমাংসা করবেন। তবে এখানেও ‘মিলিটারি’ বা সামরিক তথা প্রতিরক্ষা স্থাপনা তৈরি না করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়। কিন্তু ‘সিঙ্গেল রো ফেন্স’ বা এক সারির বেড়া প্রতিরক্ষা স্থাপনার মধ্যে পড়ে কিনা তা স্পষ্ট করা হয়নি। এই অস্পষ্টতার সুযোগেই ‘কেস টু কেস বেসিসে’ দেড়শ গজের ভেতরে কাঁটাতার দেয়ার অনুমতি পেতে থাকে বিএসএফ। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারতের ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ভারত ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতার দিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬০ টি জায়গায় কাঁটাতার দেয়া হয়েছে জিরো লাইনের দেড়শ গজের মধ্যে। এসব নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। কেউ কেউ একে একেবারেই বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত করছেন। তবে লিখিত অনুমতি আছে বলে ইতোমধ্যে তৈরি বেড়াগুলো নিয়ে খুব একটা করণীয় না থাকলেও নতুন করে কোথাও এই অনুমতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেবে না তা স্পষ্ট। এমনকি বলবৎ হয়ে যাওয়া বেড়াগুলো নিয়েও আসন্ন মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে শক্ত অবস্থান নেবে পিলখানা সেই ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তবুও বিএসএফ বিভিন্ন জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া তৈরির চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে।
ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলবের পরও গত ২১ জানুয়ারি জয়পুরহাটের পাঁচবিবির সোনাতলা সীমান্তে জিরো লাইনের ২০ গজ দূরেই কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার চেষ্টা করে বিএসএফ। পতাকা বৈঠকে তাৎক্ষণিকভাবেই প্রতিবাদ জানায় বিজিবি। বন্ধ হয় কাজ। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনায় ২২ জানুয়ারি পতাকা বৈঠক হয়েছে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে। যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কৃষক ছাড়া কাউকেই সীমান্তের দেড়শ গজের মধ্যে ঢুকতে দেবে না দুই বাহিনী।
চুক্তি, পরিকল্পনা কিংবা সমঝোতার অস্পষ্টতার কারণে একটা লম্বা সময় ধরে চলা চর্চা বন্ধ হওয়া নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেসব নিয়ে সময়ের সঙ্গে যৌক্তিক আলোচনায় সমাধানও হবে বলে আশা করা যায়। চিন্তার বিষয় অন্যখানে। আবার ৫৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়ার কথায় ফিরি। ওই সাক্ষাৎকারটিতেই তিনি বলছিলেন, “জনগণ গুজব ছড়াচ্ছিলো যে বাংলাদেশের বিপুল অংশ দখল হয়ে গেছে অথবা ভারতীয়রা এসে জমি নষ্ট করছিলো। ব্যাপারটা এইরকম না। একচুয়ালি আমাদের কিছু উৎসুক জনতা বা বহিরাগত যারা আসছিলেন, তারা এসে আমাদের কৃষকের জমিগুলো নষ্ট করছিলেন।” এই উৎসুক জনতা বা বহিরাগতরা কি পরিস্থিতিগত কারণে উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে? আবার বিএসএফ কেন বারবার জিরো লাইনের কাছাকাছি বেড়া দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সেটি নিয়েও চিন্তার কারণ আছে। সরকারি পর্যায়ে সমমর্যাদা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীও আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে জটিলতা নিরসন করছে নিয়মিত। তবে এরপরও সীমান্তে উত্তেজনা ছড়ানোর উসকানি এলে, তার লাভের গুড় কার ঘরে যাবে তা নিয়ে বোধহয় ভাবতে হবে দুদিকের কর্তাদেরই। দিনশেষে সাধারণ মানুষ চায় শান্তি।