শ্রীলঙ্কা: দিনের পর দিন কাটছে পেট্রোল স্টেশনে

কোনো কাজে যখন লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়, সবাই চাইবেন সবার সামনে প্রথম জায়গাটি দখল করতে। আজিওয়ান সদাশিবম সেই জায়গাটি নিশ্চিত করতে পেরেছেন, কিন্তু তিনি জানেন না, কতক্ষণ তাকে সেখানেই আটকে থাকতে হবে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2022, 07:59 AM
Updated : 2 July 2022, 08:12 AM

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর একটি পেট্রোল স্টেশনের বাইরে ক্লান্তিকর এই অপেক্ষার সময় তিনি বলেন, দুই দিন পার হয়ে গেছে, তার গাড়ির কপালে তেল জোটেনি।

বিবিসি লিখেছে, একজন ট্যাক্সি চালক হিসাবে সদাশিবমের কাছে পেট্রোল হল জীবন বাঁচানো রক্তের মত, কিন্তু শ্রীলঙ্কায় পেট্রোলের সরবরাহ বন্ধ।

সদাশিবম তার গাড়ির ড্যাশবোর্ড দেখালেন, সেখানে পেট্রোল গজ দেখাচ্ছে শূন্যের ঘর।

তিনি বললেন, “আমি গাড়িতেই ঘুমাচ্ছি। মাঝে মধ্যে বাইরে চলে যাই, খাবার খাই। তারপর আবার ফিরে এসে অপেক্ষা করি।... গত কয়েকদিন গোসলও করিনি।”

সদাশিবম বিবিসিকে বলেছেন, অপেক্ষা করা ছাড়া তার আসলে আর কোনো উপায়ও নেই।

“আমাকে আমার পরিবার, আমার স্ত্রী এবং দুই সন্তানের দেখাশোনা করতে হয়...; তেল থাকলেই কেবল আমি আমার ক্যাব চালাতে পারব, আর তা হলেই কিছু আয় রোজগার করতে পারব।”

পেশায় গাড়ি বিক্রয়কর্মী আথুকোরালাকে এখন নিজের গাড়িতেই ঘুমাতে হচ্ছে। ছবি: বিবিসি

গত দুই সপ্তাহে বিদেশ থেকে জ্বালানি তেলের কোনো চালান শ্রীলঙ্কায় পৌঁছায়নি। এই দ্বীপ দেশের যেখানে যা মজুদ বাকি আছে, তা পাঠানো হচ্ছে রাজধানীর জরুরি চাহিদা মেটাতে। এ অবস্থা চললে শ্রীলঙ্কার জ্বালানি মজুদ সদাশিবমের গাড়ির দশায় পৌঁছাতে বেশি দিন লাগবে না।

তবে সদাশিবম আশাবাদী, তিনি শুনেছেন, শিগগিরই একটি জ্বালানির ট্যাঙ্কার পৌঁছাবে। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে খালি পেট্রোল পাম্প পাহারা দিচ্ছেন, তার মধ্যেও তিনি আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।

“এক সপ্তাহ লাগলেও আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। এখান থেকে বের হলে আমাকে আবার অন্য কোথাও লাইন ধরতে হবে। সেটা যৌক্তিক কিছু হবে না।”

এই পাম্পে সদাশিবমের গাড়ি দিয়ে যে লাইনের সূচনা হয়েছে, তা সড়কের পাশে সাপের মত এঁকেবেঁকে দুই কিলোমিটার দূরে সমুদ্রে ধারে গিয়ে শেষ হয়েছে।

ওই এক লাইনই শেষ হয়। পাশাপাশি মোট চারটি লাইন। একটি কারের জন্য, একটি বাস ও ট্রাকের জন্য, বাকি দুটি মোটরসাইকেল ও টুক-টুকের জন্য।

পেট্রোলের জন্য শুধু অপেক্ষা করলেই হবে না, তেল পাওয়ার জন্য দেখাতে হবে টোকেন। বেশিরভাগ পেট্রোল স্টেশন একবারে দেড়শর বেশি টোকেন ছাড়েন না। কিন্তু তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গাড়ি তেলের জন লাইনে অপেক্ষায়।

লাইনের পেছন দিকে অপেক্ষা করছিলেন কলম্বোর বাইরে থেকে আসা জয়ন্ত আথুকোরালা। ১২ লিটার পেট্রোল পুড়িয়ে তিনি পাম্পে এসেছেন আরও পেট্রোল নিতে।

তার কাছে ট্যাক্সি চালক সদাশিবমের মত টোকেন নেই। তার অনুমান ঠিক হলে, লাইনে তার অবস্থান ৩০০ নম্বরের আশপাশে।

হতাশা নিয়ে আথুকোরালা বলেন, “আমি আজ টোকেন পাব কিনা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নই। গ্যাস আর পেট্রোল ছাড়া আমরা চলতে পারি না। আমরা বিরাট সমস্যার মধ্যে রয়েছি।”

তেলের সঙ্কট থেকে বাঁচতে তিন গুণ দাম দিয়ে জগন্নাথন কিনেছেন সাইকেল ছবি: বিবিসি

পেশায় গাড়ি বিক্রয়কর্মী আথুকোরালাকে এখন নিজের গাড়িতেই ঘুমাতে হচ্ছে। কিছু পেট্রোল স্টেশন শুধু স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য বিতরণ এবং গণপরিবহনের মত জরুরি পরিবহনগুলোকে তেল দিচ্ছে। অন্যদের দেওয়া হচ্ছে কঠোর রেশনিংয়ের মাধ্যমে, সামান্য পরিমাণে।

আথুকোরালার ভাষ্য, তার গাড়ির ট্যাংক অর্ধেক পূরণ করতেও শ্রীলঙ্কার ১০ হাজার রুপি গুণতে হবে।

এই বিপদের মধ্যে জ্বালানি পাওয়ার আশায় শ্রীলঙ্কা সরকার রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে। সস্তায় তেল কেনার ব্যাপারে আলোচনা করতে শ্রীলঙ্কার একটি প্রতিনিধি দল এ সপ্তাহের শেষে মস্কো পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

জ্বালানি সমস্যা মেটাতে রুশ প্রেডিসডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাহায্য চেয়ে চিঠিও লিখেছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে।

পেট্রোল স্টেশনের পাশে বিবিসি প্রতিবেদকের দেখা হয় জগন্নাথনের সঙ্গে, যিনি ঘুরে বেড়ানোর জন্য জ্বালানি খরচ না করে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করছেন।

জিজ্ঞাসা করতেই তিনি হেসে নতুন বাইসাইকেলটি দেখালেন, সেটায় এখনও প্লাস্টিকের মোড়ক লাগানোই রয়েছে।প্যাডেল নাড়াতে নাড়াতেই বললেন, “আমি এখনও এতে অভ্যস্ত।”

জগন্নাথন ছিলেন ড্রাইভার। কিন্তু পেট্রোল বা ডিজেলের সংকট হওয়া তিনি কাজ বন্ধ করে দেন। এরপর জমানো টাকায় কিনে নেন বাইসাইকেল। তবে তাকে সেটা কিনতে হয়েছে স্বাভাবিক দামের চেয়ে তিনগুণ বেশি দিয়ে, খরচ হয়েছে ৭০ হাজার রুপি।

সিরির হাতে কোনো কাজ নেই, আয় রোজগারের ব্যবস্থা নেই। তিনি বাজি ধরেছেন লটারিতে। ছবি: বিবিসি

টুক-টুকের লাইনের পেছনে একটি ছোট লাইনে ছয়জনের একটি দল লটারির টিকেট কেনার অপেক্ষায় ছিল। সেখানে সিরির সঙ্গে কথা হয় বিবিসি প্রতিবেদকের।

পেশায় শ্রমিক সিরি এটা-সেটা করে সংসারের খরচ চালান। পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর আশায় ২৬টি টিকেট একবারে কিনে নিয়েছেন তিনি।

সিরি বলেন, “আমার রোজগারের আর কোনো রাস্তা নেই, লটারি মিলে যাবে, এই করাটা কঠিন। কিন্তু আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে।”

তেল নিতে আসা অনেকে লাইনে অপেক্ষার সময় টুক-টুকের ভেতরে ঘুমিয়ে নিচ্ছিলেন। কেউ বা সময় পার করতে গল্প করছিলেন। আর সিরি তার হাতে থাকা টিকেটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন আশা নিয়ে।

তিনি বললেন, “হয়ত কোনো একদিন আমিও লটারি জিতব।”

আরও খবর: