ডিম্বাণু-ভ্রুণ হিমঘরে রাখার বাড়তি খরচে জিম্মি গ্রাহক

অনেক রকম কারণ দেখিয়ে বেড়েই চলেছে ডিম্বাণু, ভ্রুণ অথবা শুক্রাণু হিমাগারের রাখার খরচ। ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়ার আশায় বাড়তি অর্থ গুনতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2023, 06:38 AM
Updated : 20 April 2023, 06:38 AM

বয়স যখন বিশের ঘরে, তখন ডিম্বাণু হিমাগারে রেখেছিলেন এলিজাবেথ। বছর দুই আগে দাতার কাছ থেকে নেওয়া শুক্রাণু এবং সেই ডিম্বাণুর নিষেকে টেস্টটিউবে ভ্রুণ তৈরি করান এলিজাবেথ ও মেগান রবিনস।

সেই ভ্রুণ এখন তাদের সাত মাসের ছেলে। আগামীতে সন্তান নেওয়ার স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে এই যুগল বাকি ডিম্বাণু আবারও হিমাগারে রেখেছেন।

তবে এই স্বপ্নকে যত্নে রাখতে অর্থ খরচ করতে হচ্ছে দেদার। হিমাগারে এক বছর ডিম্বাণু এবং ভ্রুণ রাখার খরচ দশ বছরে দ্বিগুণ হয়ে ৭২০ মার্কিন ডলারে ঠেকেছে।

গত মার্চে এলিজাবেথ ও মেগান রবিনস জানতে পারেন, প্রতি বছরের এই খরচ বেড়ে ৭৮০ ইউএস ডলার হতে চলেছে শিগগিরই। তাদের মত যারা ফার্টিলিটি বাণিজ্যের গ্রাহক, তাদের সবার অভিজ্ঞতাই মোটামুটি এরকম।

ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ডিম্বাণু ও ভ্রণ হিমাগারে রাখার চাহিদা বেড়েই চলেছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে খরচ। হিমাগারে রাখার বার্ষিক খরচ এক বছরেই বেড়েছে ৪০ শতাংশ। আর কোনো বিকল্প না থাকায় বাড়তি অর্থ গুণতে বাধ্য হচ্ছেন ভবিষ্যতে সন্তান নিতে আগ্রহীরা।  

ফার্টিলিটি স্টোরেজের কর্মীরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির এই সময়ে তাদের ভাড়া বাড়াতেই হচ্ছে। আর গ্রাহকরা বলছেন, সন্তান নেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আবেগ। তাছাড়া আর কোনো বিকল্পও তাদের সামনে নেই। ফলে নিরুপায় হয়েই ওই খরচটা তাদের করতে হচ্ছে।

ওয়াশিংটনে আইন পেশায় কর্মরত ৩১ বছর বয়সী মেগান রবিনস বলেন, “আমরা একভাবে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। তারা নিশ্চয় এসব ভালো করেই বোঝে।”

সোসাইটি ফর অ্যাসিসটেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজির তথ্য অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ডিম্বাণু হিমাগারে রাখার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আর ভ্রুণ হিমাগারে রাখার হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ।

রোগীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ডিম্বাণু, ভ্রুণ ও স্পার্ম হিমঘরে রাখার খরচ চড়া হতে শুরু করেছে মূলত ২০১৯ সাল থেকে। প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাত থেকে কেমন লাভ করে, সে তথ্য তারা প্রকাশ করেনি কোথাও।

ফার্টিলিটি ক্লিনিক ও হিমঘরগুলো খরচ বাড়ার পক্ষে বেশ কিছু কারণ দাঁড় করিয়েছে। যেমন- মূল্যস্ফীতি ও পণ্য সরবরাহের চাপ। তাছাড়া ২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ও ওহাইও শহরে নামি হিমঘরের এক জোড়া ট্যাংক অকার্যকর হলে কয়েক হাজার ডিম্বাণু ও ভ্রুণ নষ্ট হয়, যার প্রভাবে এ সেবার খরচ বেড়ে যায়।

শ্যাডি গ্রুভ ফার্টিলিটি ক্লিনিকের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা এরিক উইড্রা বলেন, “এই সেবা ব্যয়বহুল। তবে ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে।”

রবিনস যুগলসহ আরও যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, তারা এ প্রতিষ্ঠানেরই গ্রাহক।

ওয়াশিংটন পোস্ট ১২ জনেরও বেশি নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যারা মূলত একটি ফরম পূরণ করে ডিম্বাণু ও ভ্রুণ হিমাগারে রাখার অভিজ্ঞতা জানাতে সাড়া দিয়েছেন।

৩৬ বছর বয়সী ক্রিস্টা মে একজন ভিজুয়াল ডিজাইনার; কাজ করছেন নিউ ইয়র্ক শহরে। খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “ওরা তো আমাদের ডিম্বাশয় পেয়ে বসেছে।”

ডিম্বাণু হিমাগারে রেখেছেন ক্রিস্টা মে। দুই ধাপে ২০২১ ও ২০২২ সালে ডিম্বাণু হিমঘরে রাখেন তিনি।  

৩৮ বছর বয়সী ইরিন আররোয়ো বলেন, “এখানে আবেগের বড় একটা জায়গা আছে, যে কারণে তারা যা খুশি দাম হাঁকতে পারছে।”

২০১৮ সালে ওয়াশিংটনে স্বামীসহ ফার্টিলিটি চিকিৎসা করিয়েছিলেন তিনি। এরপর দুটো ভ্রুণ তৈরি করা হয়, যার একটি এখন তাদের চার বছরের ছেলে।

অন্য ভ্রুণ এখনও হিমাঘরে রয়েছে। তবে এই যুগল আর কোনো সন্তান নিতে চান না। এই সিদ্ধান্তে তারা ৯৯ দশশিক ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত।

এর মধ্যে হিমাগারে একটি ভ্রুণ সংরক্ষণে তিন বছরের জন্য প্রতি মাসের খরচ ৫০ ইউএস ডলার থেকে বেড়ে ৭০ ইউএস ডলার হয়েছে।

ক্রিস্টা মে জানালেন, তার বেলায় ২৪০ ইউএস ডলার বেড়েছিল ২০২২ ও ২০২৩ সালের মাঝে; যা আগের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।

২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কাইন্ডবডি কোম্পানিতে ডিম্বাণু রেখেছেন মে। শুরুতে তার বার্ষিক খরচ ছিল ৬০০ ডলার। কিন্তু এখন তাকে দিতে হচ্ছে ৮৪০ ডলার।

ডিম্বাণু ও ভ্রুণ ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে একটি ছোট কনটেইনারে রাখা হয়। এতে রোগীর নাম সাঁটানো থাকে। এই ভ্রুণ অথবা ডিম্বাণু দ্রুত শীতল প্রক্রিয়ায় হিমায়িত করা হয়। তারপর তরল নাইট্রোজেন ভর্তি একটি ট্যাংকে রেখে দেওয়া হয় ডিম্বাণু অথবা ভ্রুণ রাখা কনটেইনারটি।

শ্যাডি গ্রুভ ফার্টিলিটি প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র মেগান অগাস্টিন বলেন, মহামারীর সময় থেকে তরল নাইট্রোজেনের দাম বেড়ে গেছে। গত বছর এর মূল্য বাড়ার মাত্রা ছিল ‘নাটকীয়’।

আর এরিক উইড্রা বলেন, কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে ক্লিনিকগুলো ইলেকট্রনিক মনিটরিং, অ্যালার্ম সিসটেম, স্বয়ংক্রিয় নোটিফিকেশনে বিনিয়োগ করেছে; যে কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

তবে শ্যাডি গ্রুভ বা কাইন্ডবডি এ ব্যবসা থেকে তাদের লাভের হিসাব জানাতে রাজি হয়নি।

ইদানিং ট্যাংকের দামও বেড়ে গেছে বলে জানালেন ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের প্রসূতি, স্ত্রীরোগ ও প্রজনন বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিউ টেইলর।

খরচ বেশি মনে হলে গ্রাহক এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে ডিম্বাণু, ভ্রুণ বা শুক্রাণু স্থানান্তর করতে পারেন। কিন্তু এই স্থানান্তরের জন্য আলাদা করে গুণতে হবে কয়েকশ ডলার।

এরপর স্থানান্তরের সময় দুর্ঘটনা ঘটলে হিমায়িত ডিম্বাণু বা ভ্রুণ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। তাছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠানও যে বছর ঘুরলে খরচ বাড়িয়ে দেবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

২০১৯ সালে টেক্সাসের এক যুগল সিয়াটলের একটি ফার্টিলিটি ক্লিনিকের নামে মামলা করে দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, স্থানান্তরের সময় ভ্রুণ হারিয়ে যায় অথবা নষ্ট হয়ে যায়।

শ্যাডি গ্রুভের আরেক গ্রাহক ৪২ বছরের সারাহ কিন্ডার বলেন, “মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এই ‍উপাদান সরিয়ে নিলেও ঝুঁকি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা তো থাকেই।”

২০১৯ ও ২০২১ সালে ভ্রুণ জমা রাখেন সারাহ কিন্ডার। প্রতি মাসে ১৩০ ডলার দিতে হয় তাকে। কিন্তু খরচ যে হারে বাড়ছে, তাতে এই দম্পতি শেষ ভ্রুণটি বাদ দেওয়ার কথা ভাবছেন।

ম্যারিল্যান্ডের বাসিন্দা এই যুগলের তিন সন্তান রয়েছে, যদিও চতুর্থ সন্তান নিতে তারা বরাবর আগ্রহী ছিলেন।

স্বাস্থ্য যোগাযোগে কর্মরতা কিন্ডার বলেন, “এ বড় বেদনাদায়ক। আমরা এক ধরনের চাপ অনুভব করি এমন সিদ্ধান্ত নিতে আবার অন্যদিকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে আমরা প্রস্তুত নই।”