স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা একজন নারী সারা জীবনে গড়ে ৬০ কিলোগ্রাম বর্জ্য যোগ করেন পৃথিবীতে।
Published : 10 Jun 2023, 09:35 AM
বেশির ভাগ স্যানিটারি প্যাড নন বায়োডিগ্রেডেবল ওয়েস্ট বা অপচনশীল বর্জ্য হিসেবে পরিবেশে জমা হচ্ছে প্রতিদিন; বিপরীতে মেন্সট্রুয়াল কাপ নারীকে পরিবেশবান্ধব হতে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
গত ৫ জুন উদযাপিত হল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে নানা আলোচনার মাঝে কয়েকজন নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন নিজেদের মাসিক ব্যবস্থাপনায় মেন্সট্রুয়াল কাপ বেছে নিয়ে প্রকৃতির প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথা।
নিজের মেন্সট্রুয়াল কাপ পরার অভ্যাসকে পরিবেশবান্ধব বলে জানালেন নূসরাত খান, যিনি পেশায় একজন উন্নয়নকর্মী।
২০২০ সাল থেকে কাপ ব্যবহার শুরু করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ”যে কাপটি কিনেছি তা সিলিকন দিয়ে বানানো, ফলে আক্ষরিক অর্থে পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি নয়। কিন্তু আমার এই পরিবর্তিত অভ্যাসটি পরিবেশবান্ধব।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই নারী বলেন, “স্যানিটারি প্যাডের বদলে কাপে অভ্যস্ত হয়ে গত ৩০ মাসে অন্তত ৩০০টা প্যাড ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছি। এর পুরোটাই পৃথিবীর জন্য প্লাস্টিক বর্জ্য হত। আমি চাইলেও এই বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা করতে পারছিলাম না।”
একজন পরিবেশ কর্মী হিসেবে নূসরাত খানের মেন্সট্রুয়াল কাপে অভ্যস্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা ছিল একটাই; নিজেকে আগে বদলাতে হবে।
তিনি বলেন, “কাপ পরে জীবন অনেক সহজ। নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। কিন্তু আমি একটা ফিল গুড ফ্যাক্টর বাড়তি পাই। ভাবতে ভালো লাগে আমার কাপ ব্যবহারের কারণে পৃথিবীর মাটি, পানি একটু হলেও প্লাস্টিকের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে।”
মেন্সট্রুয়াল কাপে অভ্যস্ত হলে প্লাস্টিক বর্জ্যের পাহাড় থেকে পৃথিবীকে সুরক্ষিত রাখতে ভূমিকা রাখা যায়, তাই পরিবেশ সচেতন নারীকে মেন্সট্রুয়াল কাপ পরার পরামর্শ দিলেন নূসরাত খান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ”এভাবে পরিবেশ রক্ষা করে পরের প্রজন্মের সুস্থতাতেও অবদান রাখতে পারছে নারী। একজন দূরদর্শী নারীই পারে নিজের দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন এনে নতুন প্রজন্মকে সুস্থ একটি চিন্তা দিতে, সুন্দর একটি পৃথিবী দিতে।”
নূসরাত খানের মত ২০২০ সাল থেকে কাপ ব্যবহার করে আসছেন ২৫ বছর বয়সী সিলভিয়া মাহজেবিন। তখন থেকেই পরিবার ও বন্ধুদের মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন তিনি।
সিলভিয়া বলেন, ”এখন আমাকে আর টেনশন করতে হয় না প্যাড কোথায় ফেলব তা নিয়ে। অনেকের কিন্তু আবার সাত দিন ধরে পিরিয়ড চলে... তাহলে কতগুলো প্যাড বাইরে ফেলতে হচ্ছে তা প্রত্যেকেরেই হিসাব করা জরুরি।”
একটি মেন্সট্রুয়াল কাপ প্রতিবার ব্যবহারের সময় পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। মাসিক শুরু হলে গরম পানিতে ফুটিয়ে নিয়ে কাপ ব্যবহার করতে হয়। মাসিকের দিন শেষে আবারও এভাবে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে জীবাণুমুক্ত করা যায়। এরপর কাপ ছোট কাপড়ের থলেতে ভরে রাখা যায়।
জীবন যাপনে ’ইকোফ্রেন্ডলি সামগ্রী’ ব্যবহারে সিলভিয়া মাহজেবিনের ভালো লাগা কাজ করে সবসময়ই।
সে কথা জানিয়ে ইন্সটিটিউট অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে প্রকৌশলে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করা এই নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রত্যেক মাসে যদি আমাকে এক প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে ফেলতে হয়... র্যাপিং থেকে শুরু করে সবকিছুতে যত প্ল্যাস্টিক আছে ওটার ইমপ্যাক্ট তো পরিবেশে অনেক বেশি।
”আমি একাই যদি এত পরিমাণ প্যাড ব্যবহার করি, তাহলে পুরো পৃথিবীতে হিসাবটা কত দাঁড়াচ্ছে...? অথচ একটি কাপের স্থায়িত্ব হচ্ছে ১০ থেকে ১২ বছর, যদি ঠিক মত ব্যবহার করা হয়; এই ভাবনা থেকেই আমার কাপে আসা।”
বাংলাদেশে সাড়ে পাঁচ কোটির উপরে প্রজনন বয়সী নারী রয়েছে; অর্থ্যাৎ তাদের নিয়মিত মাসিক হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১৮ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন সার্ভে অনুসারে, মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ডিসপোজাল প্যাড ব্যবহার করেন ৪৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী।
তাহলে প্রকৃতিতে কী পরিমাণ স্যানিটারি ন্যাপকিন বর্জ্য হিসেবে ফেলা হয় সেই হিসাব ব্যাখ্যা করলেন নাহিদ দিপা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ধরি এই নারীদের মাসে গড়ে পাঁচ দিন পিরিয়ড থাকে এবং আট ঘণ্টা পর পর প্যাড বদল করতে হয়। তাহলে প্রতি মাসে তার ১২ থেকে ১৩টা প্যাড লাগছে।
”অনেকে অবশ্য চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে প্যাড কম বদল করেন। তাই গড়ে ১০টা স্যানিটারি প্যাড লাগছে ধরে নেওয়া যায়।”
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির গবেষণা বলছে, সাধারণ ডিসপোজেবল স্যানিটারি প্যাড তৈরিতে সব মিলিয়ে ৯০ শতাংশ প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার হয়।
”আবার প্যাডগুলো মোড়ানো থাকে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে। একটু দামি ব্র্যান্ডগুলোর বেলায় মূল প্যাকেটের ভেতর প্রতিটি প্যাড আবার ছোট ছোট আলাদা প্যাকেটে মোড়ানো থাকে, সেটিও প্লাস্টিকের”, বললেন নাহিদ দিপা।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি ) বলছে, স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা একজন নারী সারা জীবনে গড়ে ৬০ কিলোগ্রাম বর্জ্য যোগ করেন পৃথিবীতে। এভাবে প্রতি বছর এক লাখ টন স্যানিটারি প্যাড বর্জ্য জমা হচ্ছে বিশ্বে।
উন্নয়নকর্মী নাহিদ দিপা বলেন, এসব স্যানিটারি প্যাড বর্জ্য মাটিতে-পানিতে যাচ্ছে, পৃথিবীর দূষণে ভূমিকা রাখছে।
”মাসিকে কাপড় ব্যবহার করাও স্বাস্থ্যকর না। আবার প্লাস্টিক তো পাঁচশ বছরেও মাটিতে বা পানিতে পরিবেশবান্ধব ভাবে মিশে যায় না। প্রথম যে স্যানিটারি প্যাড তৈরি হয়েছিল প্ল্যাস্টিক উপকরণ দিয়ে তা হয়ত এখনও পর্যন্ত পচে নিঃশেষ হয়নি। তারমানে এর একটা বিরূপ প্রভাব রয়েছে।”
৪০ বছর বয়সী দিপা বলেন, তিনি মেন্সট্রুয়াল কাপে ঝুঁকেছিলেন মাসিকের দিনে ’শারীরিক কষ্ট লাঘবের’ জন্য। পরে ধীরে ধীরে কাপের অন্যান্য দিকগুলো নিয়ে জানতে পারেন।
”যেমন প্যাকেটের গায়ে লেখা– কাপ পাঁচ থেকে সাত বছর ব্যবহার করা যাবে, শরীরে কোনো অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হবে না।”
প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাপ পরার অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেন, ”প্রত্যেক মাসে মাটিতে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলছি না এটা ভাবতেই ভালো লাগে।
”তাছাড়া কাপ মেডিকেল গ্রেড সিলিকনের হওয়ায় শরীরের জন্য ভালো। এসব কারণে আমি সবাইকে কাপ ব্যবহার করতে বলি।”
”শুধু তাই না, যারা মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে কাজ করছেন, তারা প্রত্যেকেই আগ্রহী হচ্ছেন এমন একটি মাসিক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকতে ও প্রচার-প্রচারণায় আনতে।”