শিশুর জন্মগত ত্রুটি সারাতে চাল ও আটায় ফলিক এসিড চান বিজ্ঞানীরা

গর্ভকালের শুরুর দিনগুলোতে ফলিক এসিড স্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি। তাতে গর্ভে থাকা শিশুর মস্তিষ্ক, মাথার হাড় ও মেরুদণ্ডের গড়ন সঠিকভাবে হয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2023, 04:03 PM
Updated : 12 May 2023, 04:03 PM

আটা অথবা চালে বাড়তি ফলিড এসিড যোগ করা হলে তাতে শত শত শিশুর শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মের ঘটনা এড়ানো যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা।

বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য সরকার গতবছর নন-হোলমিল হুইট ফ্লাওয়ারে ভিটামিন বি নাইন বা ফলিক এসিড যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করেছিল। তার মনে হল, যারাই সাদা আটার রুটি খাবেন, তারা সাধারণ মাত্রার তুলনায় বেশি ফলিক এসিড পাবেন।

কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে মাত্রায় ফলিক এসিড এখন সাদা আটায় যোগ করার কথা বলা হয়েছে, তাতে অনেক নারীরই কোনো উপহার হবে না। আর এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগেরও কোনো ভিত্তি নেই।   

গর্ভকালের শুরুর দিনগুলোতে এই ভিটামিন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি। এতে করে গর্ভে থাকা শিশুর মস্তিষ্ক, মাথার হাড় ও মেরুদণ্ডের গড়ন সঠিক ভাবে হয়।

গর্ভবতী হওয়ার আগে নারীদের প্রতিদিন ফলিক এসিড সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে অনেকেই এ পরামর্শ মেনে চলেন না, বিশেষ করে যারা স্বচ্ছল নন। তাছাড়া মোট গর্ভধারণের অর্ধেকই ঘটে অপরিকল্পিতভাবে।

এতে করে প্রসবের সময় শিশুর নানারকম শারীরিক অস্বাভাবিকতা থাকার ঝুঁকি রয়ে যায়। ফলিক এসিডের অভাব থেকে শিশুর জন্মগতভাবে নিউরাল টিউব ডিফেক্টস বা এনটিডি হতে পারে; শিশু স্পাইনা বাইফিডা বা স্পাইনাল কর্ড ও মেরুদণ্ডের অসম্পূর্ণ গঠন নিয়ে জন্ম নিতে পারে।

যুক্তরাজ্যে প্রতি এক হাজার গর্ভবতীর মধ্যে একজনের বেলায় সন্তানের এমন স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয়।   

আজীবন শারীরিক ভোগান্তি

বিজ্ঞানীরা বলছেন, যুক্তরাজ্য সরকার কেবল এক ধরনের আটায় ফলিক এসিড যোগ করার সুপারিশ করায় যারা গ্লুটেন মুক্ত লাল আটা ও চাল খেতে অভ্যস্ত, তাদের কোনো উপকার হবে না।


তাদের ভাষ্য, সরকারের প্রস্তাবে ফলিক এসিডের যে মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাও যথেষ্ট নয়, তাতে কেবল ২০ শতাংশ জন্মগত ক্রুটি এড়ানো সম্ভব হতে পারে, যেখানে ফলিক এসিডে পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে ৮০ শতাংশ শিশুর নিউরাল টিউব ডিফেক্টস এড়ানো সম্ভব।

এই বিজ্ঞানীদের একজন নিনা মোদী কাজ করছেন ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনে। তিনি সেখানে নিওন্যাটাল মেডিসিন বিভাগের একজন অধ্যাপক।

নিনা মোদী বলেন, “যুক্তরাজ্যে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট থাকা শিশুর পরিসংখ্যান আছে। ইউরোপের মধ্যে এই হার সর্বোচ্চ।

”এখন আসলে অবহেলা করার মত পরিস্থিতি নেই। এ ধরনের ঘাটতি থেকে সারা জীবনের জন্য সন্তান ও পরিবার ভুগতে পারে। নিউরাল টিউব ডিফেক্ট হওয়ার প্রতিটি ঘটনাই মর্মান্তিক। একটি মজবুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ না নেওয়ার কোনো কারণই আমি দেখছি না।”

যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০০ গ্রাম সাদা আটায় শূন্য দশমিক ২৫ গ্রাম ফলিক এসিড যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অধ্যাপক মোদী এবং অন্যান্যরা মনে করছেন, এই পরিমাণ চার গুণ বাড়ানো ‍উচিত; অর্থ্যাৎ প্রতি ১০০ গ্রাম যে কোনো আটা ও চালে এক মিলিগ্রাম ফলিক এসিড থাকতে হবে।  

লন্ডনের প্যাডিংটনে সেন্ট ম্যারিস হসপিটালের  অবসটেট্রিকস ও গাইনোকলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডেম লেসলি রিগান বলেন, ফলিক এসিডের মাত্রা বাড়ানোর মেডিকেল, নৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে।

”এমন রোগে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হলে সারা জীবন তাকে যত্ন করার খরচ লাখ লাখ পাউন্ড। (যুক্তরাজ্যে) আটশ পরিবারকে এই সমস্যার সঙ্গে যুঝতে হচ্ছে।”

মাতৃস্বাস্থ্যে জরুরি

সাপ্লিমেন্ট বা ওষুধ দিয়ে শরীরে ফলিক এসিডের ঘাটতি পূরণের চেয়ে খাবার থেকে পাওয়া ফলিড এসিড শরীরের জন্য দ্বিগুণ কার্যকর। 

বিশেষজ্ঞদের অনেকে আগেও জানিয়েছিলেন, প্রত্যেকের খাদ্যাভাসে ফলিড এসিড যোগ করলে অ্যানিমিয়ার মত অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দূর হবে।

১৯৯১ সালে ল্যান্সেট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, নারীরা প্রতিদিন চার মিলিগ্রাম ফলিক এসিড পরিপূরক খেলে তার সন্তানের নিউরাল টিউব ডিফেক্টস সমস্যা ৮০ শতাংশ কমে আসে। যুক্তরাজ্যে নিরীক্ষা চালিয়ে ওই ফলাফল পাওয়া যায়।    

ওই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক স্যার নিকোলাস ওয়াল্ড। তিনি বলেন, বেশি পরিমাণে রোগ প্রতিরোধমূলক খাবার জন্মগত অনেক ক্রুটি থেকে নিরাপদ রাখে, প্রতিরোধ করে।

“একজন মা বিত্তবান হোক অথবা দরিদ্র, সবার জন্যই তা উপকারী।”

ফলিক এসিড কী?

• ভিটামিন বি৯ বা ফোলেটের কৃত্রিম সংস্করণ

• গর্ভাবস্থায় প্রথম কয়েক সপ্তাহে এই ভিটামিন খুব জরুরি; কারণ এতে শিশুর মেরুদণ্ড ও স্নায়ুর কোষ গঠন হয়

• গর্ভধারণের পরিকল্পনা করছে এমন যে কারো প্রতিদিন এক বেলা ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড খাওয়া উচিত

• গর্ভকালের প্রথম ১২ সপ্তাহ ফলিড এসিড খাওয়া দরকার

• যদি বংশে কারো স্পাইনা বাইফিডা হয়ে থাকে, তাহলে গর্ভবতীকে পাঁচ মিলিগ্রাম ফলিক এসিড খেতে হবে

• ফোলেট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভিটামিন যা পালং শাক, বাঁধাকপি, কমলা ও শস্যজাত খাবারে পাওয়া যায়।

• গর্ভবতী নয় এমন কেউ এসব খাবার থেকে শরীরের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলিক এসিড পাবেন

স্পাইনা বাইফিডা রোগে আক্রান্তদের সেবা দিয়ে থাকে দাতব্য সংস্থা শাইন। আটায় বাধ্যতামূলক ফলিক এসিড শিগগিরই যোগ করার দাবি জানিয়েছে তারা।

এ সংস্থার প্রধান নির্বাহী বলেন কেট স্টিলে বলেন, “যে পরিমাণ ফলিক এসিড যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হোক না কেন, আমরা চাই এই মাত্রা যেন যাচাই করা হয়। এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব যেন নজরে রাখা হয়।”.

সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা এখন থাকুক আর না থাকুক, আগামীতে গর্ভবতী হতে পারেন– এমন সব নারীকেই প্রতিদিন ফলিক এসিড পরিপূরক নিতে পরামর্শ দিচ্ছে সংস্থাটি।

বিশ্বে ৮০টির বেশি দেশে আটায় ফলিক এসিড মেশানো হয়। অস্ট্রেলিয়ায় রুটিতে ফলিক এসিড মেশানোর পর নিউরাল টিউব ডিফেক্ট নিয়ে জন্মানো শিশুর হার ১৪ শতাংশ কমে গিয়েছিল।