Published : 04 May 2025, 04:42 PM
হিসাব বছর শেষে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত ও অনুমোদনের পাশাপাশি লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ডাকা পর্ষদ সভায় কী হল, তার ব্যাখ্যা দিয়েছে ১৬ ব্যাংক।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তুলে ধরা এই ব্যাখ্যায় কেউ বলেছে পর্ষদ সভা ‘অনিবার্য’ কারণে স্থগিত করা হয়; কোনো কোনো ব্যাংক বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি না পাওয়ায় পর্ষদ সভায় আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়নি।
আবার কোনো ব্যাংক বলেছে, পর্ষদ সভা হলেও আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা সম্ভব হয়নি; এ কারণে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা পিএসআই প্রকাশ করা হয়নি।
খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে এর বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে না পারা, কয়েকটি প্রকৃত খেলাপির চিত্র না দেখানো ও আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করার অনুমতি না দেওয়ায় সরকারি-বেসরকারি ১৯ ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন শেষ মুহূর্তে আটকে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২৪ হিসাব বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে তার ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ঘোষণার শেষ দিন ছিল গত ৩০ এপ্রিল।
সেজন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬ ব্যাংকের ১৭টি শেষ দিনে পর্ষদ সভা ডেকেছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) বা অনাপত্তি না পাওয়ায় ব্যাংকগুলো অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
এর আগে আরও দুই ব্যাংক পর্ষদ সভার তারিখ ঘোষণা করলেও বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি না পাওয়ায়। এ কারণে সেগুলো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি।
২০২৪ হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত না হওয়ায় ব্যাংকগুলো চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনও চূড়ান্ত করতে পারেনি। ফলে সাত মাস ধরে ব্যাংকগুলোর কোনো আর্থিক তথ্য জানতে পারছে না বিনিয়োগকারিরা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬ ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৬টি ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে; যেগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবারও কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে গভর্নর দেশে না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সভা শেষ করে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন গভর্নর। ব্যাংকাররা আশা করছেন, চলতি সপ্তাহে ব্যাংকগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া ঘোষণায় বলেছে, “গত ৩০ এপ্রিল হাইব্রিড মোডে ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড সভা হয়। ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। সভায় আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা সম্ভব না হওয়ায় হিসাব চূড়ান্ত করা যায়নি। সেজন্য কোনো ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
কবে নাগাদ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে, সে বিষয়েও কিছু জানাতে পারেনি ব্যাংকটি।
স্টান্ডার্ড ব্যাংক ডিএসইতে জানিয়েছে, তাদের পর্ষদ সভা হয়েছে। তবে আর্থিক প্রতিবেদন বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ কারণে সভা স্থগিত করা হয়েছে। পরে স্থগিত সভা ডাকা হলে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার পাশাপাশি ডিভিডেন্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ব্যাংকটির কোম্পানি সচিব মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পর্ষদ সভা তো হয়েছে। অন্যান্য এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা করা হলেও শুধু অ্যানুয়াল রিপোর্ট নিয়ে ডিসকাস হয়নি। এজন্য সভা স্থগিত করা হয়েছে। অ্যাকাউন্টস ঠিক হলে স্থগিত সভা ফের ডাকা হবে।”
ওয়ান ব্যাংক জানিয়েছে, গত ৩০ এপ্রিল তাদের পর্ষদ সভা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনাপত্তি না পাওয়ায় আর্থিক বিবরণ, ডিভিডেন্ড দেওয়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত, রেকর্ড ও বার্ষিক সাধারণ সভার তারিখ ঘোষণা করা যায়নি।
প্রিমিয়ার ব্যাংক বলেছে, ‘অনিবার্য কারণবশত; ব্যাংকের গত ৩০ এপ্রিলের পর্ষদ সভা স্থগিত করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি পেলে আবার পর্ষদ সভা ডাকার কথা বলেছে ঢাকা ব্যাংক।
একইভাবে আইএফআইসি ব্যাংক, আল আরাফাহ ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক পিএলসি, এনআরবিসি ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এবি ব্যাংক তাদের ব্যাখ্যা ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
কবে রোববার দুপুর পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের কাছে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি ইউসিবি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
কী বলছে আইন
আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনাপত্তি নিতে হয় ব্যাংকগুলোকে। নীতিমালা অনুযায়ী আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে কি না, তা যাচাই শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে থাকে। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদ সভায় অনুমোদন হয় চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদন।
আর্থিক প্রতিবেদনে অনাপত্তি নেওয়ার পর আরো একটি অনুমোদন নিতে হয় ব্যাংকগুলোকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক বছর শেষে কী পরিমাণ ডিভিডেন্ড দিতে পারবে তার একটি মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে তা নির্ধারিত হয়। কোম্পানি কী পরিমাণ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করবে, তারও অনাপত্তি নিতে হয় ব্যাংকগুলোকে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর আগের হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন নতুন বছরের প্রথম দুই মাসের মধ্যে চূড়ান্ত করার বাধ্যবাধকতা আছে। এই সময়ে নিরীক্ষা শেষে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে আবেদন করে আরো দুই মাস সময় বাড়ানো যায়।
বছরের প্রথম চার মাসের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারলে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হয়। তা না করলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসইসি) নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো জরিমানার মুখে পড়বে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা সম্পর্কিত কোনো কারণে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারলে বিএসইসিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে অবহিত করতে হবে। এরকম পরিস্থিতি হলে, কত সময়ের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হবে, তার কোনো নির্দিস্ট সময় বেঁধে দেয়নি বিএসইসি।
পুজিবাজারের নিয়ম অনুযায়ী তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন সংক্রান্ত বিষয়ে পর্ষদ সভা ডাকার পরে তা বিনিয়োগকারীদের জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে।
বিনিয়োগকারীদের জানাতে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ সভার তরিখ ও সভার সূচি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ।
বিএসইসির নীতিমালা অনুযায়ী আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত ও ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে তা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা পিএসআই হিসেবে বিএসইসি ও দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
পরের দিন দুটি জাতীয় পত্রিকায় তা প্রকাশ করার পাশাপাশি একটি অনলাইন নিউজপোর্টালে দ্রুত প্রকাশ করতে হয় পিএসআই।
একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটেও পিএসআই ও চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে।