১৪ বছরে গ্রামে সি-সেকশন বেড়েছে ২৭ শতাংশ পয়েন্ট: গবেষণা

পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সি-সেকশন করার খরচও।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2022, 06:52 PM
Updated : 28 Sept 2022, 06:52 PM

শুধু শহরে নয়, গ্রামেও সন্তান প্রসবে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনের হারে উল্লম্ফন দেখা গেছে ১৪ বছরের মধ্যে, যা ’অস্বাভাবিক’ বলছে একটি দেশীয় গবেষণা। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সি-সেকশন করার খরচও।   

২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের উপাত্ত বিশ্লেষণে এসব চিত্র উঠে এসেছে `ম্যাসিভ বুম অব সিজারিয়ান ডেলিভারি ইন বাংলাদেশ: এ হাউজহোল্ড লেভেল এনালাইসিস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে।

বুধবার বিআইডিএসের মিলনায়তনে এক সেমিনারে এই গবেষণা প্রতিবেদন  প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ব বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।

এতে বলা হয়েছে, ‘‘২০০৪ সালে গ্রামে যেখানে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার ছিল ২ শতাংশ, ২০১৮ সাল শেষে তা ২৯ শতাংশে পৌঁছেছে।”

সেমিনারে এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক।

গ্রামীণ এলাকায় সি-সেকশনের হার বেড়ে যাওয়াকে ’উদ্বেগজনক’ বলছে বিআইডিএস।

সারা দেশে এই হার ২০০৪ সালে ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ হলেও ২০১৮ সালে সি-সেকশনের হার বেড়ে হয়  ৩৩ দশমিক ২২ শতাংশ।

অর্থ্যাৎ দুই দশকের মত সময়ে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনে সন্তান প্রসবের সংখ্যা ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য নির্দেশনা অনুসারে, সি-সেকশনের গ্রহণযোগ্য হার হচ্ছে ১৫ শতাংশ।

স্বাভাবিক প্রসবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে বা এড়ানো অসম্ভব এমন ক্ষেত্রেই সি-সেকশনের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। 

কথিত আছে, খ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে প্রাচীন রোমের অধীশ্বর জুলিয়াস সিজারকে মা আউরেলিয়ার পেট কেটে বের করা হয়েছিলো। সে কারণে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যতিক্রম এ পদ্ধতিকে বলা হয় 'সিজারিয়ান', আর এ পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের বলা হয় 'সিজারিয়ান বেবি'।

প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে সরকারি হাসপাতালে সিজারের হার কমে আসলেও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে তা বাড়ছে।

সেমিনারে গবেষণার বরাতে প্রতিটি সি-সেকশনে পরিবারের খরচ বেড়ে যাওয়ার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়।

দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালে পরিবারের গড় ব্যয় করতে হচ্ছে ২১ হাজার ৫০০ টাকা। সেখানে সরকারি হাসপাতালে খরচ হচ্ছে ১৩ হাজার ৬২২ টাকা।

আর এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার ৮৬০ টাকা।

গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায় ধাত্রী বা মিডওয়াইফের সংখ্যা কমে যাওয়াকে সি-সেকশনের হার বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে বলছে বিআইডিএসের গবেষণা।

এতে বলা হয়, সন্তান প্রসব সংক্রান্ত সকল সেবা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থাৎ হাসপাতাল-ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। এটিকে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উৎসাহিত করায় ধাত্রীরা এই কাজ থেকে সরে আসছেন।

আর সবাই এখন হাসপাতালমুখী হওয়ায় সিজারের সংখ্যা ও খরচ দুটোই বেড়েছে।

গবেষণায় তুলে আনা এসব পরিসংখ্যান চার বছর আগের অর্থ্যাৎ ২০১৮ সাল পর্যন্ত। বর্তমান চিত্র আরও বেশি হতে পারে বলে সেমিনারে বলা হয়।

বিআইডিএসের পক্ষ থেকে সুপারিশে বলা হয়, কেন সবখানেই সিজারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ নিয়ে সরকারের দ্রুত গবেষণা পরিচালনা করা উচিৎ।

সেমিনারে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, “সিজারের সংখ্যা বৃদ্ধির পার্শ্ব-প্রভাব অনেক বেশি পড়ছে।

“নারীর শারিরিক জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার কর্মক্ষমতা কমছে, দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী সমস্যায় ভুগছেন। তাদের ব্যয় বাড়ছে।”

তিনি বলেন, “সিজারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে কি না, তা গবেষণা করা প্রয়োজন।”

প্রতিবেশী দেশ ভারতে সিজারের হার ২২ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ, নেপালে ১৬ ও মিয়ানমারে তা ১৭ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণার বরাতে সেমিনারে বলা হয়, বাংলাদেশে গর্ভবতী নারীরা সি-সেকশনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই প্রতিবেদন অনুসারে, প্রসবের পদ্ধতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাকরিজীবী নারীরা ছুটির হিসাব কষে দিনক্ষণ ঠিক করছেন।  

এছাড়া প্রসব পূর্ব ব্যথা সহ্য করতে ভয় পাওয়া, বেশি ওজনের সন্তান ও নারীর ওজন বেশি হওয়া, সচেতনতার ঘাটতি থেকেও সি-সেকশন করেই সন্তান প্রসব হচ্ছে।

এর সঙ্গে চিকিৎসকদের স্বাভাবিক প্রসব করার মতো সক্ষমতা না থাকার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও মালিকদের বেশি মুনাফার লোভে সি-সেকশনে উৎসাহ দেওয়া, গ্রামীণ এলাকায় গর্ভবতী নারীর স্বাভাবিক প্রসব পর্যন্ত চিকিৎসকের অপেক্ষা না করা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্বক্ষণিক সেবা না পাওয়াকেও কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

বিআইডিএসের গবেষণায় সি-সেকশন বেড়ে যাওয়ার কারণ:

  • চাকুরিজীবী নারী ছুটির হিসাব

  • প্রসব পূর্ব ব্যথা সহ্য করতে ভয় পাওয়া

  • চিকিৎসকদের স্বাভাবিক প্রসব করার মতো সক্ষমতা না থাকা

  • বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও মালিকদের বেশি মুনাফার লোভ

  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্বক্ষণিক সেবা না পাওয়া

এই গবেষণায় ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৭ হাজার ৩২৮ জন গর্ভবতী নারীর সন্তান প্রসবের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

এসব তথ্য নেওয়া হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিচালিত পাঁচটি ’বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে’ থেকে।

গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে সেমিনারে অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার মন্ডল বলেন, “ইউরোপের দেশগুলোতে প্রসব বিমা করা হয়।

“সিজারের খরচ বেশি হওয়ায় বিমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হাসপাতালে গিয়ে যাচাই-বাছাই করে দেখে সিজারের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কি না।”

“আমাদের দেশে সিজার ইস্যুতে চিকিৎসকদের কোনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। কেন সিজার করা হচ্ছে তার যৌক্তিকতা বের করতে হবে।”

গ্রামে যেখানে সিজারের হার ২৯ শতাংশের উপরে, সেখানে শহরে এই হার ৪৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

শহরে সি-সেকশনের হার বৃদ্ধির বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শহুরে নারীর খাদ্যাভাস ও জীবন যাপনের কারণে সন্তান প্রসবে অনেক সময়ে জটিলতা দেখা দেয়।

তবে কোন ক্ষেত্রে সি-সেকশন প্রয়োজন ও কোন ক্ষেত্রে অপ্রয়োজন তা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনার কথা বলছে বিআইডিএসের।

সেমিনারে আলোকরা বলেন, সি-সেকশনের হার কমিয়ে আনতে জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জাতীয় সূচকে হাসপাতালে সন্তান প্রসবের হার বেড়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি সি-সেকশনের সংখ্যাও উপস্থাপনের সুপারিশ করা হয় সেমিনারে।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সিজারের মাধ্যমে জন্ম দিতে বেসরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় সিলেটে এবং সবচেয়ে কম ব্যয় হয় রংপুর বিভাগে।

জরিপের তথ্য অনুসারে, দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা বিভাগের সরকারি হাসপাতালে  সি-সেকশনে গড়ে ১৩ হাজার ৩৮৩ টাকা, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮৩১, বরিশালে ১৬ হাজার ৮৪৬, খুলনায় ১১ হাজার ৮৯৩, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৯৪১, সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭, রংপুরে ৭ হাজার ৩১, ময়মনসিংহে ১১ হাজার ৫১৬ টাকা খরচ হয়।

বেসরকারি হাসপাতালে গড়ে দিতে হয় ঢাকা বিভাগে ২৩ হাজার ১৬৮, চট্টগ্রামে ২৫ হাজার ৫০৭, বরিশালে ২৮ হাজার ৯৫৯,খুলনায় ১৫ হাজার ৭২৯, রাজশাহীতে ১৫ হাজার ৭০৫, সিলেটে ৩০ হাজার ৫৫৭, রংপুরে ১৮ হাজার ২৩০, ময়মনসিংহে ১৯ হাজার ৯৭৩ টাকা।

সেমিনারে নারীপক্ষের প্রতিনিধি শিরিন হক বলেন, “অনেক সময় দেখা যায় ডাক্তারকে অগ্রিম টাকা দিতে হয়। না হলে তারা আসতে চান না। কিন্তু কোনো ধাত্রীর ক্ষেত্রে এমন অবস্থা তৈরি হয়নি যে, অর্থ না দিলে মাঝরাতে তিনি আসবেন না।”

বিআইডিএসের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “সরকারি ডাক্তাররাই দিন শেষে বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন, অপারেশন করছেন।

“ডেলিভারিতে ধনী-গরিব সকলের সমান অর্থ ব্যয় হয়। কেননা প্রত্যেকেই নিজের সবকিছু বিক্রি করে হলেও সন্তানকে বাঁচাতে যায়।”