“স্তন নিয়ে কথা বলায় চারপাশের সমাজে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। স্তন পরীক্ষা করানোকেও অনেকে যৌনতার চোখে দেখেন।“
Published : 13 Oct 2023, 12:34 PM
“আমি অনেক ছোট বয়সেই মায়ের যুদ্ধটা দেখেছিলাম। এরপরও আমি আমার স্তনের পরীক্ষা করাইনি। আমি এসব নিয়ে কথা পর্যন্ত বলিনি।“
মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাকে হারান সোনিয়া ভান্ডাল। স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে যুঝতে না পেরে মৃত্যু হয়েছিল সোনিয়ার মায়ের; ক্যান্সার ধরা পড়ার ছয় বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় তার।
সোনিয়ার যখন ১৮ বছর বয়স, তখন পরীক্ষায় স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ল তারও।
এশীয় সমাজে ক্যান্সার নিয়ে কথা বলা খুব সহজ নয়। আর আলাপের বিষয় যখন হয় স্তন ক্যান্সার তখন প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
সোনিয়ার উপলব্ধি হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থতা নারীর জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দেখা দেয়। এতে নারীর বিয়ে অথবা সন্তান ধারণের সক্ষমতা প্রায়ই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বিবিসি এশিয়ান নেটওয়ার্ককে তিনি বলেন, “আমার চিকিৎসা চলাকালে একজনের সঙ্গে প্রেম চলছিল। একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলাম। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এক আন্টি বললেন, ‘ছেলেটির পরিবার কি তোমাকে মেনে নেবে?’
“আমি বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলাম প্রতিদিন। এসময় আমার ভবিষ্যৎ, আমার বিয়ে, আমার সন্তান ধারণ সক্ষমতা নিয়ে কাছের মানুষদের কাছ থেকে যেসব প্রশ্ন এসেছে, তা ওঠা মন ভেঙে দেওয়ার মত।”
সোনিয়া বলেন, ”এসব কারণেই মানুষ কথা বলতে চায় না। কারণ কেউ তার আন্টি অথবা অন্য কাউকে এরকম কথা বলার সুযোগ দিতে চায় না।”
’ক্যান্সার নিয়ে ভয়’
‘ব্রেস্ট ক্যান্সার নাও’ এক গবেষণায় বলছে, দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে স্তন পরীক্ষা করানোর প্রবণতা কম।
এর অর্থ হল, ক্যান্সার যখন ধরা পড়ে, ততদিনে তা ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে শ্বেতাঙ্গ নারীদের তুলনায় এশীয় নারীদের স্তন ক্যান্সারে বাঁচার হার কম হয়।
দাতব্য প্রতিষ্ঠান ব্রেস্ট ক্যান্সার নাওয়ের গণস্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী পরিচালক মানভিট বাসরা বলেন, “স্তন নিয়ে কথা বলায় চারপাশের সমাজে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। স্তন পরীক্ষা করানোকেও অনেকে যৌনতার চোখে দেখেন।
”ক্যান্সার নিয়ে ভয় তো আছেই, পাশাপাশি অদৃষ্টের ওপরও ছেড়ে দেওয়া হয় সবকিছু। অনেকের মধ্যে সামাজিক আর ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে যে, পাপ আর অতীতের কৃতকর্মের ফল হচ্ছে ক্যান্সার।”
বংশানুক্রমে পাওয়া স্তন ক্যান্সার জিন বিআরসিএ শরীরে ধরা পড়ার আগে ‘স্তনে খুব বেশি যন্ত্রণা হত’ বলে জানালেন সোনিয়া।
ওই জিন তার স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছিল। মা এবং এক খালা– দুজনকেই স্তন ক্যান্সারে হারিয়েছেন সোনিয়া।
তিনি বলেন, “আমি বিছানায় গড়াগড়ি খেতাম এবং হাত দিয়ে স্তন স্পর্শ করলে মনে হত পাথর ধরে আছি। আমি কান্নায় ভেঙে পড়তাম।”
শরীরে বিআরসিএ জিনের উপস্থিতি থাকা মানে ক্যান্সার আবারও ফিরে আসার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। পাশাপাশি সোনিয়ার ডিম্বাশয় ক্যান্সার হওয়ারও ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল।
এসব কারণে সোনিয়া উভয় স্তনের জন্য মাস্টেক্টমি করালেন। সোনিয়া কেমোথেরাপি নেওয়ার ঝুঁকিও এড়াতে চেয়েছিলেন।
দক্ষিণ এশীয় সমাজে স্তন ক্যান্সারকে কী চোখে দেখা হয় তা নিয়ে সবাইকে সচেতন করতে কাজ করছেন চিকিৎসক সানিয়া আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমার তখন ২৪ বছর বয়স। আমার পরীক্ষা হল। তারপর আমার মনে হল, যেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে আমাকে।
”আমাদের সমাজে মেয়েরা নিজেদের স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেয় না। উপরন্তু স্তন মানে খুব গোপন জায়গা ভাবা হয়। অনেকের কাছে স্তন পরীক্ষা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই।“
”আমি একটি ভালোবাসাপূর্ণ মুসলমান পরিবারে বড় হয়েছি। কিন্তু নারীকে আসলে এখনও স্ত্রী ও সন্তান পালনের জন্যই ভাবা হয়।”
সমাজে উন্নত স্বাস্থ্য নিয়ে সবাইকে সচেতন করার কাজ চালিয়ে যেতে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন সানিয়া। তিনি বলেন, ”একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি সবসময় আমার রোগীকে তার স্তন পরীক্ষা করে দেখতে উৎসাহ দেই। যদি কোনো কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়, তবে তা ভালো করে দেখা দরকার।”
স্তন ক্যান্সার নিয়ে পরিবারে কখনও কিছু ঘটেনি দিপিকার সাগ্গির। একবার তিনি তীব্র যন্ত্রণায় ভুগতে শুরু করেন। তখন কোভিড মহামারী চলছে চারিদিকে।
দিপিকার চিকিৎসক তাকে সরাসরি বায়োপসি করে দেখতে বলেন।
তখন ৩৫ বছর বয়স চলছে দিপিকার। রিপোর্টে বলা হল, সময় একটু বেশি গড়িয়ে গেছে, টিউমারের আকার আট সেন্টিমিটার।
ওই মুহূর্ত যেন রোলার কোস্টারে চড়ার মত অভিজ্ঞতা ছিল দিপিকার জন্য। তিনি দ্বিধা, যন্ত্রণা আর বাস্তবতা মেনে নেওয়ার চেষ্টায় নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন।
“তরুণ বয়সে কখনও মনে আসে না যে ক্যান্সার হবে কখনও। হয়ত সে কারণেই আমি পরে অনেক সহায়তা পেয়েছিলাম।”
তবে অনেকের মন্তব্য তার জন্য সবকিছু কঠিন করে তোলে; কেউ কেউ কৃতকর্ম এবং ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ বলেও মন্তব্য করেছিল।
“আমি বড়দের কাছ থেকে সবসময় শুনতাম, সবকিছু পেছনে একটা কারণ থাকে...। আমার মনে হত, তারমানে তুমি ভাবছো যে ঈশ্বর মনে করেন আমার ক্যান্সার হওয়া উচিত?”
সোনিয়া, দিপিকা এবং সানিয়ার মত তরুণরা মানসিকতা বদলাতে পারবে বলে মনে করেন মানভিট।
তিনি বলেন, “স্তন নিয়ে সচেতন হলে, লক্ষণ ও উপসর্গ জানা থাকলে তা নিজের জন্য এবং পরিবারের অন্যদের জন্যও সহায়ক হবে।”