“ভোরে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। আমি বাসেও যেতে পারতাম, কিন্তু সিএনজিতে করে ইস্কাটন থেকে আগারগাঁও আসি শুধু ইতিহাস হতে,” বললেন যাত্রী তাহমিনা।
Published : 29 Dec 2022, 11:25 PM
যানজটের নগরী ঢাকায় নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য যে মেট্রোরেল এসেছে, ইতিহাসের সাক্ষী হতে প্রথম দিনই তার অভিজ্ঞতা নিলেন শত শত মানুষ।
এই যাত্রার জন্য টিকেট পেতে সারি ধরে ঘণ্টা খানেকের মতো অপেক্ষা করতে হলেও যাত্রাপথ পাড়ি দেওয়া গেল নিমিষেই।
বৃহস্পতিবার ঘন কুয়াশায় ঘেরা ভোরে উত্তরে দিয়াবাড়ি আর দক্ষিণে আগারগাঁও স্টেশনে জড়ো হতে থাকে উৎসুক মানুষ। যদিও সকাল ৮টার আগে কোনো ট্রেন ছেড়ে যাবে না বলে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আগারগাঁও স্টেশনে দেখা গেল, অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সারি সিঁকি কিলোমিটার দূরে পাসপোর্ট অফিসের ফটক ছাড়িয়ে গেছে। তাদের অনেকেই ভোর ৫টায় এসে এখানে দাঁড়িয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কারও মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই, সবাই অপেক্ষায়- ‘কখন আসবে মেট্রোরেল’।
ভোর ৫টার পরপরই আগারগাঁও এসে লাইনে দাঁড়ানো প্রথম ব্যক্তি কামরুল ইসলাম অফিস থেকে দুই-আড়াই ঘণ্টার ছুটি নিয়েছেন কেবল মেট্রোরেলে চড়ার জন্য। তার মতো ভোর থেকে শতাধিক ব্যক্তি আগারগাঁও স্টেশনে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন মেট্রোতে চড়তে।
তাদের একজন তাহমিনা জানালেন, ডাক্তার দেখাতে উত্তরায় যাবেন মেট্রোরেলে চড়ে যাবেন। তিনি দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে ইস্কাটনে উঠেছেন আত্মীয়ের বাসায়।
মেট্রোকে বেছে নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই তাহমিনা বললেন, “ভোরে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। আমি বাসেও যেতে পারতাম, কিন্তু সিএনজিতে করে ইস্কাটন থেকে আগারগাঁও আসি শুধু ইতিহাস হতে।”
সকাল ৮টায় উত্তরা প্রান্ত থেকে যাত্রী নিয়ে একটি ট্রেন আগারগাঁও চলে এলেও কারিগরি জটিলতার কারণে ২০ মিনিট বিলম্বে খুলেছে আগারগাঁওয়ের মূল ফটক। টিকেট বেচতে গিয়ে কিছুটা বিপত্তিতে পড়েছিল মেট্রোরেলের দুই প্রান্ত। অনেক যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ট্রেনের দর্শন না পেয়ে ফিরেও গিয়েছিলেন।
সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মেট্রোরেলের কোচগুলো আপাতত চলছে। প্রথম দিনে এই সময়ের মধ্যে ৩ হাজার ৮৫৭ জন যাত্রী মেট্রো ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন। তবে কতজন যে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি।
শুরুতে বিভ্রাট, অপেক্ষার ভোগান্তি
মেট্রোরেলের প্রথম দিনে আলোচনার বড় অংশ জুড়ে ছিল স্টেশনকর্মীদের টিকেট বিতরণে প্রযুক্তিগত বিভ্রাট। স্বয়ংক্রিয় টিকেট বুথগুলো বার বার বিকল হয়ে যাচ্ছিল। টাকা দেওয়ার পর তা গ্রহণ করলেও অনেক সময় টিকেট দিচ্ছিল না মেশিন। আবার টিকেট দিলেও অবশিষ্ট টাকা ফেরত দিচ্ছিল না অনেক সময়।
স্বয়ংক্রিয় টিকেটের বুথে এই বিভ্রাট নিয়ে প্রথম দিনের যাত্রীদের মাঝে ক্ষোভ কিংবা হতাশা- তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। প্রথম দিনের বিপত্তিকে মনে নেওয়ার পক্ষেই অভিমত দিয়েছেন অনেকে।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বিষয়টি বাঁকা চোখে না দেখার অনুরোধ করেছেন।
মেট্রোরেলের সার্ভার অতিরিক্ত চাপ নিতে পারছে না, এমন কি সিগন্যাল ঠিক দিচ্ছে না বলে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাঁকা চোখে দেখছেন কেন? একটা জিনিস বাংলাদেশে হয়েছে নতুন, প্রথম অভিজ্ঞতা, মেশিনটা তো চালাতেও এদিক সেদিক হতে পারে। এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
স্টেশগুলোর দক্ষিণ প্রান্তে তিনটি এবং উত্তর প্রান্তে তিনটি অটোমেটেড টিকেট মেশিন রয়েছে। এগুলোর পাশেই রয়েছে দুটি করে কাউন্টার। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে টিকেট কেনা যায়। মেশিন কাজ না করায় ভিড় লেগে গেছে সেই কাউন্টারে।
আগারগাঁও স্টেশনে মেট্রোরেল প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, বড় নোট দিয়ে মেশিনে টিকেট কাটার সময় বাকি টাকা ফেরত দিতে পারছে না মেশিন, কারণ ভেতরে পর্যাপ্ত টাকা রাখা হয়নি। সমস্যা হচ্ছে সে কারণেই।
আগারগাঁওয়ে স্টেশনে টিকিট বিক্রয় মেশিন কাজ না করায় সকালে মেজাজ হারাতে দেখা যায় ডিএমটিসিএল'র জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) ইফতেখার হোসেনকে। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাকে উচ্চকণ্ঠে বকাঝকা করছিলেন তিনি।
সেলফি-লাইভ আনন্দ-উল্লাস
দীর্ঘ সারি, টিকেটের ঝামেলা উতরে রোমাঞ্চের নতুন নতুন ধাপ পেরিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছান যাত্রীরা। প্রথমেই প্লাস্টিক কার্ড পাঞ্চ করলেই খুলে যায় স্বয়ংক্রিয় দুয়ার। সামান্য সামনে এগিয়ে যাত্রীরা দেখা পান একটি চলন্ত সিঁড়ির। একটানে স্টেশনের প্লাটফর্মে পৌঁছালেই কিছুক্ষণের মধ্যে মাইকে আসে দিক নির্দেশনা।
যাত্রীদের দুইপাশ দিয়ে ট্রেন আসা-যাওয়া করে। প্ল্যাটফর্ম ও রেললাইনের পূর্বপাশ ধরে উত্তরা থেকে ট্রেনগুলো আসে। পশ্চিম পাশ ধরে আগারগাঁওয়ের ট্রেনগুলো উত্তরার দিকে চলে যায়। প্ল্যাটফর্ম ও রেলের মেঝে একেবারে সমান্তরাল, লাগোয়া। ফলে লিফটের দরজার মতো রেলের দরজা ও প্ল্যাটফর্মের দরজা একই সঙ্গে খুলে যায়। যাত্রী উঠার পর মাইকে সতর্কতামূলক ঘোষণা দিয়ে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মোট তিন থেকে চার মিনিটের এই প্রক্রিয়া শেষে ১০ মিনিট দূরের (১১.৭৩ কিলোমিটার) গন্তব্যে ছুটতে শুরু করে ট্রেন।
চলন্ত মেট্রোরেলের ভেতরে দেখা যায়, যাত্রীরা নিজের সেলফি তোলার পাশাপাশি অন্যের হাতে মোবাইল দিয়ে পছন্দ মতো তুলে নিচ্ছেন ছবি। অনেক দ্রুত অতিক্রম করা দুই পাশের দৃশ্যের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করছেন। পর্যন্ত আসন থাকা সত্ত্বেও অনেকে দাঁড়িয়ে হাতল ধরে ঝুলছেন, এক বগি থেকে আরেক বগিতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
বগিতে অবস্থানরত সংবাদকর্মীরাও ব্যস্ত ট্রেন নিয়ে যাত্রীদের মূল্যায়ন বুঝতে।
সেখানে ঢাকার ফার্মগেটের বাসিন্দা লতা মোস্তাফিজ ধারণা থেকে বললেন, মেট্রোরেলে যাতায়াতে হয়ত তাকে অন্য বাহনের মত হেনস্তার শিকার হতে হবে না।
“বাসে আমাদের, বিশেষ করে মহিলাদের নানারকম হয়রানির শিকার হতে হয়। আমি নিজে তার ভুক্তভোগী। কিন্তু আজ মেট্রোরেলে চড়ার পর মনে হয়েছে এখানে তেমনটি হবে না।”
অপেক্ষার দীর্ঘ সারি, ছুটছে ফাঁকা ট্রেন
আগারগাঁও থেকে উত্তরা আসা-যাওয়ার ভ্রমণে দেখা যায়, বাইরে শত শত যাত্রী অপেক্ষমাণ থাকলেও টিকেট সরবরাহে ধীর গতির কারণে কম যাত্রী নিয়েই একের পর এক ছুটে চলছে ট্রেন। আবার দুপুর ১২টায় এ দিনের মতো ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অপেক্ষমাণ অনেক যাত্রী ফিরে গেছেন ব্যর্থতা নিয়ে।
বেলা ১১টায় উত্তরা উত্তর স্টেশনে দেখা গেল, সেখানে স্টেশনের বাইরে দীর্ঘ সারি এক কিলোমিটার ছাড়িয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় আগারগাঁও প্রান্তের লাইনও এক কিলোমিটার দীর্ঘ হয়ে যায়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ স্লুইচগেট মাদ্রাসা ও মসজিদের ইমাম আবুল বাশার অপেক্ষা করছেন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে। যখন সকাল পৌনে ৯টা বাজে, তখনও তিনি প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে।
ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি আর দাঁড়াতে পারছিলেন না; ফুটপাতেই বসে থাকতে দেখা যায় তাকে।
আবুল বাশার বলেন, তিনি যাবেন টঙ্গীর চেরাগ আলীতে। মেট্রোরেলের কথা শুনেছেন, টিভিতে দেখেছেন। তাই সকাল সাড়ে ৬টার সময় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তবে লাইন যেন কিছুতেই এগোচ্ছে না। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। তবে তিনি হাল ছাড়তে রাজি নন, ট্রেনে উঠেই ছাড়বেন। লাইনের লোকজন তাকে ধরে ফুটপাতে বসিয়ে দিয়েছে।
শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছয়জন শিক্ষার্থী এসেছিলেন মেট্রোরেলের চড়তে। কিন্তু তারা নির্ধরিত সময়ে টিকেট কিনতে না পেরে ব্যর্থতার কষ্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন বলে জানান দলে থাকা লিমা আক্তার।
প্রথম দিনেই নিয়মভঙ্গ জরিমানা
বৃহস্পতিবার যাত্রী বহন শুরুর দিনে চার ঘণ্টায় ৩ হাজার ৮৫৭ জন যাত্রী মেট্রোতে ভ্রমণের স্বাদ পান। আনন্দ আয়োজনের মধ্যেই নিয়ম ভঙ্গ করে জরিমানা গোনার মতো পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে দুই যাত্রীকে।
এদের একজনকে জরিমানা করা হয়েছে টিকেট হারিয়ে ফেলার জন্য। অন্যজনকে করা হয়েছে প্ল্যাটফর্মে অতিরিক্ত সময় অবস্থান করায়।
উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ে মেট্রো যাত্রায় একজন যাত্রীকে গুনতে হচ্ছে ৬০ টাকা করে। ইলেক্ট্রিক চিপযুক্ত প্লাস্টিকের একবার ভ্রমণের জন্য দেওয়া টিকেটগুলো যাওয়ার সময় ফেরত নেয় কর্তৃপক্ষ। ওই কার্ড দিয়ে দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকতে হয়। ভ্রমণ শেষে স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় দরজা খুলতে ওই কার্ডের প্রয়োজন হয়।
আর টিকেট কাটার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভ্রমণ করতে হয়, নইলে ওই টিকেট অকার্যকর হয়ে পড়ে।