একাকিত্ব শরীরের জন্য ক্ষতিকর

একা হওয়ার ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, বিষণ্নতা এবং অকাল মৃত্যু ঘটতে পারে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2023, 09:02 AM
Updated : 23 May 2023, 09:02 AM

এতদিন ধারণা করা হত, একাকিত্বের কারণে মানসিকভাবে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, একাকী বোধ আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে শারীরিক ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সার্জন জেনারেল’ ডা. ভিভেক মার্থির তৈরি করা ৮১ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে একাকিত্ব ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকাকে, দৈনিক ১৫টি সিগারেট টানার সমান ক্ষতিকর হিসেবে দেখিয়েছেন। যে কারণে দেখা দিতে পারে হৃদরোগ, স্ট্রোক, বিষণ্নতা, স্মৃতিভ্রংশ এবং অকাল মৃত্যু।

তিনি উল্লেখ করেন- ধূমপান, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার চাইতেও বেশি বিস্তার লাভ করেছে একাকিত্ব বোধ।

তবে দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ মানুষই এই ক্ষতির বিষয়টা ধরতে পারে না।

সামাজিকভাবে যোগাযোগ থাকাটা সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। প্রতিবেদনে জানানো হয় একাকিত্বের কারণে অকাল মৃত্যুর পরিমাণ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে সামাজিকভাবে বিছিন্ন থাকায় এই ঝুঁকি বাড়ে ২৯ শতাংশ।

একাকিত্ব যেভাবে শারীরিক ক্ষতি করে

‘ব্রিগহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটি’র সাইকোলজি ও নিউরোসায়েন্স’য়ের অধ্যাপক ড. জুলিয়ান হল্ট-লান্সটেড বলেন, “আমাদের মস্তিষ্ক যোগাযোগের জন্য প্রস্তুত করা।”

প্রকাশিত প্রতিবেদনের একজন উপদেষ্টা হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেন, দলের মধ্যে থেকে মানুষ কাজ করায় অভ্যস্ত।

রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “আমরা যাদের বিশ্বাস করি তাদের সান্নিধ্য আশা করি। তবে সেটা পাওয়া না গেল, আমরা বিচ্ছিন্ন হই, আশপাশের মানুষদের বিশ্বাস করতে পারি না। অথবা সেই দল থেকে আমরা বের হয়ে যাই। এটা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি স্বরূপ।”

যুক্তরাষ্ট্রের নিউরোসায়েন্টিস্ট ম্যাথিউ লিবারম্যান বলেন, “বেঁচে থাকতে সামাজিক যোগাযোগ প্রয়োজন; সেটা আমাদের দেহ জানে। তবে বিষয় হল, একাকিত্বের মতো মানসিক আঘাত প্রমাণ করে যে সামাজিক যোগাযোগটা জরুরি।”

যেভাবে খিদা লাগলে পেট জানান দেয়, তেমনি কোনো কিছুর ঘাটতি হওয়ার সংকেত দেয় একাকিত্ব।

সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া আর একাকিত্বের কারণে মস্তিষ্ক ‘ফাইট অর ফ্লাইট মুড’য়ে চলে যায়।

লিবারম্যান বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ধরা যাক কোনো বনভূমিতে আপনাকে একটি সিংহ তাড়া করছে। এখন বেঁচে থাকতে মস্তিষ্ক সারা শরীর জুড়ে মানসিক চাপের হরমোন কর্টিসল এবং নোরাপিনাফ্রেন নিঃসরণ করবে। এর ফলে শরীরের অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড ধীর হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলার জন্য দেহ প্রস্তুত হবে। ফলে সমস্ত শক্তি খরচ হবে সিংহ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য।

একই সঙ্গে মস্তিষ্ক প্রদাহজনক শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন বাড়াবে যাতে ক্ষত শুকানোর পাশাপাশি ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস হয়। একটাই লক্ষ্য- বেঁচে থাকা।

যখন উদ্দেশ্য সাধিত হবে, ধরা যাক সিংহ থেকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে পারলেন, তখন আমাদের শরীর আবার স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করবে। তবে শরীর যদি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো না পায়- এক্ষেত্রে যথেষ্ট সামাজিক যোগাযোগের বিষয়টা চলে আসবে- তখন মস্তিষ্ক কর্টিসল নিঃসরণ করেই যাবে।

এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট’ কাইলার শামওয়ে বলেন, “কর্টিসল চিহ্নিত করতে পারলে আমাদের জিন স্বাভাবিকভাবে ‘রিসেপ্টর’গুলো বন্ধ করে দেয়। তবে মস্তিষ্ক যখন প্রচুর পরিমাণে কর্টিসল উৎপন্ন করতে থাকে তখন দেখা দেয় প্রদাহ। যা কিনা হৃদরোগ ও স্মৃতিভ্রংশ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

তবে ভালো খবর হল, ডা. মার্থি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন- বয়স, স্বাস্থ্য, জীবনধানের পদ্ধতি ও আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখলে বেশি দিন বেঁচে থাকার পরিমাণ বাড়ে ৫০ শতাংশ।

মানে হল আমাদের সম্পর্কগুলোর নিয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় লালন করতে পারলে লাভ আছে।

যেভাবে একা হয়

মনে রাখতে হবে একাকিত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব সবার ওপর সমানভাবে পড়ে না। যাদের ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যগত বা মানসিক সমস্যা রয়েছে, পঙ্গু বা আর্থিকভাবে দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি।

হল্ট-লান্সটেড বলেন, “সাধারণ একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, কেউ যদি ইচ্ছে করে একা থাকে তবে সেখানে ক্ষতির কিছু নেই।”

তবে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ করে যে, একাকী বোধ না করলেও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে স্বাস্থ্যের ওপর বাজে প্রভাব পড়ে।

বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা, অটোমেটিক কাজ করতে পারে এমন যন্ত্রে অভ্যস্ত হওয়া, একা বিনোদন পাওয়া যায় এরকম বিষয়গুলো থাকার পরও আমাদের জৈবিক চাহিদার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টা থেকেই যায়।

একাকিত্ব থেকে বের হওয়ার পন্থা

এই ক্ষেত্রে হল্ট-লান্সটেড তিনটি উপায় দিয়েছেন।

বর্তমান সম্পর্কগুলো লালন করা: সামাজিকভাবে কর্মক্ষম থাকা মানে শারীরিকভাবেও কর্মযজ্ঞে থাকা। একদিন ব্যায়ামাগারে দেহের কোনো পরিবর্তন হয়। এজন্য বার বার যেতে হয়। তেমনি আমাদের সম্পর্কগুলো একদিনে তৈরি হয় না, প্রতিনিয়ত যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্কগুলো পূর্ণতা পায়।

তাই যারা আশপাশে আছেন তাদের খবর রাখা, টেক্সট ম্যাসেজ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো চালাতে হবে।

আগ্রহের সঙ্গে মিলে যায় এরকম দলে যোগ দেওয়া: অনেকের সমন্বয়ে গড়া একটি দলে যোগ দিতে পারলে নানান ধরনের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটবে। দেখা যাবে তাদের মতাদর্শ আলাদা। বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য উদ্দেশ্য এক হলেও, বৈচিত্র্যতা আসবে। ফলে ‘আমি বনাম তারা’ এই অনুভূতির জায়গায় বাড়বে বিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তি।

অন্যদের সেবা দেওয়া: গবেষণায় দেখা গেছে, কাউকে সাহায্য করা মানে নিজেই সাহয্যটা ফেরত পাচ্ছেন। হতে পারে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কোনো কিছুতে জড়ানো কিংবা নিজের একক প্রচেষ্টায় কারও প্রতি দয়াশীল আচারণ করা।

সাহায্য চাওয়া কঠিন। তবে অন্যকে সাহায্য করার মাধ্যমে সেই কঠিন গণ্ডি ভেঙে অধিকার বুঝে নেওয়ার অনুভূতি জোরদার করা যায়।

আরও পড়ুন

Also Read: একসঙ্গে থাকার যত বাজে কারণ

Also Read: একাকী জীবনেও সুখী হওয়া যায়

Also Read: একাকিত্ব থেকে হৃদরোগ