ঈর্ষা আর হিংসা এক বিষয় নয়।
Published : 05 Nov 2023, 02:47 PM
ঈর্ষা একটা নেতিবাচক অনুভূতি যেখানে একজন ব্যক্তি তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতির কারণে কাছের মানুষের অমনোযোগিতা, ভালোবাসার ঘাটতি বা প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় ভুগে থাকেন।
এমন অনুভূতি মাঝেমধ্যে হওয়া স্বাভাবিক। তবে নিয়মিত অনুভব করা স্বাস্থ্যকর নয়। সেক্ষেত্রে এর কারণ খুঁজে বের করা ও সমাধানের চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
ঈর্ষা ও হিংসার মধ্যে পার্থক্য
“যদিও ঈর্ষা ও হিংসা- দুই অনুভূতি নেতিবাচক এবং এ দুটি শব্দকে একটি অপরটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে এ দুটি শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা”- হেল্থ ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন মার্কিন ‘নিবন্ধিত পেশাদার জীবনযাপন-বিষয়ক প্রশিক্ষক’ শেরি গর্ডন।
ঈর্ষা প্রধানত প্রিয় ব্যক্তিকে হারানোর বা ভালোবাসা কমে যাওয়ার ভয়ের কারণে হয়ে থাকে। এর কারণ হলো প্রিয় ব্যক্তির মনোযোগ বা ভালোবাসা লাভ করা।
সাধারণত, প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন অনুভূতি দেখা যায়। তবে কেবল প্রেম নয় বরং কাছের মানুষজন বা সুসম্পর্ক আছে এমন সম্পর্ক যেমন- বাবা-মা ও সন্তান, বন্ধুত্ব, সহকারী এদের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যেয়ে থাকে।
মনে রাখতে হবে ঈর্ষা কমপক্ষে তিনজন ব্যক্তি মধ্যেই হয়ে থাকে।
অন্যদিকে, হিংসা বলতে ব্যক্তির এমন অনুভূতিকে বোঝায় যেখানে সে অন্য সকলের প্রতি হিংসা অনুভব করেন। অন্যের অর্জন, পেশাদারিত্ব, ভালো গুণ বা ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতি হিংসা পোষণ করেন।
হিংসা দুজন ব্যক্তির মধ্যে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে হিংসুক ব্যক্তি নিজের ছাড়া অন্য সকলের প্রতি একই হিংসার মনোভাব পোষণ করেন।
ঈর্ষা বোধ করার কারণ
যদিও এর মূল কারণ সম্পূর্ণ ব্যক্তি নির্ভর। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবেশগত কারণে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হতে পারে।
গর্ডন উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, “যেমন- কোনো ব্যক্তি যদি অনিরাপদ অনুভব করেন এবং একা থাকতে ভয় পান, আত্ম সংযোম কম থাকে তাদের মধ্যে অন্যান্যদের তুলনায় ঈর্ষা প্রবণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।”
এছাড়াও যেসব ব্যক্তির সঙ্গী অসৎ বা আগে তাদের খারাপ সম্পর্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে বা কেউ তাদেরকে ঠকিয়েছে এমন ক্ষেত্রে সম্পর্কের তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশের ফলে ঈর্ষান্বিত হতে পারেন।
কিছু গবেষক মনে করেন, ঈর্ষা মূলত এমন একটা অনুভূতি যেখানে কেউ তার সঙ্গীকে বোঝাতে চায় যে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে অন্য কেউ ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
গবেষকরা দেখেছেন যে, ঈর্ষা অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার মূল চাবিকাঠি হিসেবেও কাজ করে। বিশেষ করে আপত্তিজনক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে। এছাড়াও ঈর্ষা স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের প্রাথমিক ধাপ হিসেবেও বিবেচিত।
শুরুর দিকে ঈর্ষাকে ভালোবাসার মূল বলে মনে হলেও, পরে সেটা নিয়ন্ত্রণ প্রবণতায় যেয়ে ঠেকে।
লক্ষণ
ঈর্ষার সব থেকে সাধারণ লক্ষণগুলো হল- অস্বস্তি, কষ্ট পাওয়া এবং বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা।
মজার বিষয় হল- ঈর্ষান্বিত ব্যক্তির মুখ দেখতে রাগী বা দুঃখী ব্যক্তির মতো হয়। কারণ ঈর্ষা-কে এমন আবেগ হিসেবে ধরা হয় যেখানে রাগ, দুঃখ, ভয় বা অবাক হওয়ার মতো নানান বিষয়ের যোগ রয়েছে।
ঈর্ষাকে ‘প্যাথলজিক্যাল’ বিষয় হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। সেটা যদি সমাজ স্বীকৃত হয়। এই পরিস্থিতিতে ঈর্ষা অনেক ক্ষেত্রে আবেগপ্রবণ ও বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
প্রেমের ঈর্ষার ক্ষেত্রে অনেক সময় নারী-পুরুষের মাঝে মারামারি আত্মক্ষতি, এমনকি হত্যা পর্যন্ত বিষয় গড়াতে পারে।
প্রেমের ক্ষেত্রে ঈর্ষান্বিত হয় এমন ব্যক্তিরা মনে কষ্ট ও অস্বস্তিতে ভোগেন। তারা সবসময় মনে করেন যে, তাদের সঙ্গী তাদের প্রতি সৎ নন।
অসততার কোনো প্রমাণ না থাকার পরেও তারা সঙ্গীকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন না।
আপত্তিকর সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঈর্ষান্বিত ব্যক্তিরা সাধারণত রাগ পোষণ করেন এবং সঙ্গীকে বরাবরই তাদের সততা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তারা নিয়মিত সঙ্গীকে নজরদারীর ওপর রাখেন এবং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালায়।
অস্বাস্থ্যকর ঈর্ষার কয়েকটি লক্ষণ হল-
সঙ্গী- বন্ধু বা পরিবারের সদস্যরা সবসময় একসাথে সময় কাটাতে চায়।
এরা আপনার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান।
আপনি কার সাথে কথা বলবেন তার একটি বিধিমালা তৈরি করে।
এরা অনেক বেশি সন্দেহপ্রবণ এবং প্রভাব রাখতে চায়।
এরা ই-মেইল, মেসেজ, এমনকি ফোন কলের ওপরেও নজরদারি চালায়
ইতিবাচকভাবে ঈর্ষা প্রকাশের উপায়
যদি নিজের কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঈর্ষা অনুভব করেন- সেক্ষেত্রে সঙ্গী, বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। নিজের অনুভূতির প্রতি সৎ থাকা এবং কী চিন্তা করছেন সেটা অন্যকে দোষারোপ না করে জানানো উচিত।
সঙ্গীর দেওয়া উত্তর ভালো মতো শুনতে হবে।
অনেক সময় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক জোড়ালো হয়।
ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণের উপায়
সুস্থ সম্পর্কের প্রধান শর্ত হল সততা এবং খোলামেলা যোগাযোগ। ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কয়েকটি কৌশল জানা থাকা প্রয়োজন।
প্রথমেই বড় শ্বাস গ্রহণ করতে হবে এবং মনে করতে হবে যে, এটা একটা অনুভূতি। আর বাস্তবিক ক্ষেত্রে আপনি কেমন আচরণ করবেন তা বাছাই করার ক্ষমতা আপনার আছে।
এমন অনুভূতি হলে তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। তবে সেটা নিয়ে বসবাস করা যাবে না। যদি মনে হয় সঙ্গী আপনাকে ঠকাচ্ছে তাহলে সেই ধারণা মাথায় জাল বিস্তার করতে থাকে।
সেক্ষেত্রে সঙ্গী আপনাকে ঠকাচ্ছে না এমন প্রমাণ খুঁজে বেড়াতে হবে।
মনে রাখতে হবে ঈর্ষা করে কোনো ভালো ফলাফল আসে না। বরং এতে সম্পর্ক আরও নষ্ট হয়। তাই যদি এমন অনুভূতি হয়েই থাকে সেক্ষেত্রে নিজের বা সম্পর্কের ক্ষতি না করে বিশেষজ্ঞ সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন।
মেনে নিতে হবে যে- কোনো সম্পর্কের নিশ্চয়তা নেই। যদি কোনোভাবেই সঙ্গী বা বন্ধুকে বিশ্বাস করতে না পারেন সে ক্ষেত্রে ওই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা শ্রেয়।
সম্পর্ক ভালো রাখতে দুজনে মিলেই একটি সীমারেখা সৃষ্টি করা প্রয়োজন যার মাঝখানে আপনারা দুজনই স্বস্তি অনুভব করবেন।
মনে রাখতে হবে- বিশ্বাস এমন একটা জিনিস যা আসলে আপনি দিচ্ছেন এমন কিছু নয়, বরং যা আপনি অর্জন করছেন।
যদি আপনার সঙ্গী নিজেও আগে ঠকে থাকে তাহলে আপনার ঈর্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার অতীত নিয়ে কথা বলা বা সেটাকেই মূল ধরে এগিয়ে চলা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
চিকিৎসা
যদি ঈর্ষার অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার ফলে দৈনন্দিন কাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে, সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব এবং কর্মক্ষেত্র বা প্রিয়জনদের সাথে জটিলতা সৃষ্টি করে- তবে দ্রুতই মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সম্পর্ক ভালো রাখতে ঈর্ষার ইতিবাচক চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে-
কগনেটিভ বিহেভিয়রান থেরাপি: বা সিবিটি-এই চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণগত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে কমানোর চেষ্টা করা হয়।
মননশীল ও গ্রহণযোগ্যতার কৌশল: এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেকে চিনতে, নিজের চিন্তা ভাবনা ও শারীরিক সংবেদন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে এবং তা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে প্রস্তুত করে তোলা হয়।
অ্যান্টিসসাইকটিক ওষুধ গ্রহণ: এই ধরনের ওষুধ বিভ্রান্তি ও ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আরও পড়ুন
প্রেমের সম্পর্কে দ্বিতীয় সুযোগ