‘তবে এটা ঠিক দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই।’
Published : 10 Oct 2024, 07:08 PM
চারশ বছর আগে কেমন হতো এই বাংলার দুর্গাপূজা? ইতিহাসের পাতা আর গবেষকদের কথা থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য সেই ছবিটিই তুলে আনতে চেয়েছেন রিদওয়ান আক্রাম।
১৬১০ সাল। ঢাকায় এসে নামলেন মোগল বাংলার সুবাদার ইসলাম খান। বুড়িগঙ্গার তীরে নেমে দেখতে পেলেন দুর্গাপূজা হচ্ছে। ঢাকিরা ঢাক বাজাচ্ছে। এই ঢাক বাজানোর শব্দ শুনে সুবাদারের মাথায় এক বুদ্ধি এল। ঢাকের শব্দ দিয়েই না হয় সুবাবাংলার নতুন রাজধানী ‘ঢাকা’র আয়তন ঠিক করা যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। শহরের তিন দিকে ঢাকিদের ঢাক বাজাতে বাজাতে যেতে বললেন। ঢাকের আওয়াজ যতদূর শোনা যাবে ঠিক তত দূরত্ব পর্যন্তই হবে ঢাকা শহরের পরিধি।
ঘটনা কতটুকু সত্য এ ব্যাপারে ইতিহাস জোর গলায় কিছু বলে না। তবে এটা ঠিক, একসময় দুর্গাপূজা ঢাকায় হত। সারা বাংলাতেই হত। তবে ঠিক কবে থেকে দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল এ নিয়ে আছে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। তবে এটা ঠিক দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই।
হয়তো প্রাচীনকালে যে দুর্গাপূজা হত তার প্রকৃতি ও রূপ ছিল ভিন্ন। তবে বাংলাদেশে (বিভক্ত বাংলা) যে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে তা একান্তই বাঙালি সাংস্কৃতির অংশবিশেষ। বাংলায় দুর্গাপূজা কবে চালু হয়েছিল সে বিষয়ে গবেষক ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা মোটামুটিভাবে একটি মতে পৌঁছেছেন।
উনিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতায় দুর্গাপূজার আলোকচিত্র।
সম্রাট আকবরের শাসনামলে (ষোড়শ শতকে) বাংলার দেওয়ান হন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের সামন— রাজা কংস নারায়ণ। এত বড় এক পদ পাওয়ার আনন্দে রাজা চাইলেন সেই পৌরাণিক যুগের মতো এক মহাযজ্ঞ করতে। রাজার পুরোহিত বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের রমেশ শাস্ত্রী জানালেন যে, বিশ্বজিৎ, রাজসূর্য, অশ্বমেধ ও গোমেধ— এই ৪ রকমের যজ্ঞ করার নিয়ম আছে। তবে রাজার জন্য এই ৪ যজ্ঞের কোনোটাই করা সম্ভবপর নয়। এখন উপায়? রাজার মাথায় হাত! তাহলে যজ্ঞ হবে না?
পুরোহিতমশাই রাজাকে অভয় দিয়ে বললেন, “যজ্ঞের বদলে দুর্গাপূজা করুন।”
রাজা খুশিমনে দুর্গাপূজার আয়োজন করলেন।
সেই সময় এই পূজার জন্য খরচ হয়েছিল আট থেকে নয় লক্ষ টাকা। সেই থেকে দুর্গাপূজার শুরু। তবে এই উৎসব সেই সময় জনপ্রিয় হয়নি। একটা কারণ হতে পারে এ পূজার সঙ্গে বেশ অর্থ-কড়ি খরচের একটা বিষয় ছিল। ধনী ছাড়া এই পূজার আয়োজন করাটা কারও সামর্থ্য ছিল না বললেই চলে। মোদ্দাকথা দুর্গাপূজা জনপ্রিয় আর সর্বজনীন হয়ে ওঠার জন্য উনিশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিশেষ করে বললে ওই শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।
তৎকালীন ভারতের শাসক ইংরেজদের রাজধানী কলকাতা। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ শহর। ইংরেজশাসনযন্ত্রের অন্যতম সহকারী হিসেবে হিন্দুদের কাছে টাকাকড়িও ছিল বেশ। ফলে দুর্গাপূজায় অন্যান্য উৎসবের মতো জৌলুসও যুক্ত হয়। সঙ্গে নিজস্ব মান-মর্যাদা আভিজাত্য প্রর্দশনের একটা বড় সুযোগ হয়ে দাঁড়ায় এই পূজা। শাসকগোষ্ঠী ইংরেজদের
আনন্দোৎসবে হিন্দুরা বেশ ঘটা করেই আমন্ত্রণ জানাতেন। ফলে উৎসবের ব্যাপকতা আর জাঁকজমকও বৃদ্ধি পেতে থাকে বহুগুণে।
দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার প্রায় তিনশ’ বছর আগে, সে সময়ের হিন্দুদের উৎসবে ইংরেজরা ছিল অগ্রহণযোগ্য। ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা আর শাসকের পরিবর্তণের ফলে তারাই হয়ে ওঠে আদরনীয়।
এছাড়াও দুর্গাপূজা করার ক্ষেত্রে উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দুদের সঙ্গে জমিদাররাও যোগ হলেন। সবকিছু মিলিয়ে বলা চলে দুর্গাপূজা উৎসবের ব্যাপকতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এই বাংলাতেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে উৎসবের রেশ।
১৮৫৯ সালে কলকাতার দুর্গাপূজা। এঁকেছিলেন অ্যালেক্সিস সোলটিকফ।
সেই সময়ে বাংলার যে সমস্ত ভূ-স্বামী কলকাতায় বাস করতেন, তারাও নিজ নিজ জমিদারি এলাকায় এ ধরনের উৎসবের চালু করতে চাইলেন। বলা যায়, ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নিজস্ব প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানোর বিষয়টি। সেসব জমিদারের সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছিল স্থানীয় মধ্যবিত্ত এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। ফলে তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় উৎসব হিসেবে পূর্ববঙ্গে দুর্গাপূজা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।
আগেই বলা হয়েছে এসব পূজায় কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না ধনীরা। অনেক সময় তা অপচয়ের দিকেও চলে যেত। উচ্চবিত্তদের অর্থের অপচয় হলেও পল্লিসমাজের একঘেয়ে জীবনে বাৎসরিক এ পূজা জনগণের মনে নিয়ে আসত অশেষ আনন্দের বারতা। উৎসবের কয়েকটা দিন লোকজন মেতে থাকত অপার আনন্দে। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হত ভোগ, যাত্রা, থিয়েটার, সংকীর্তন, কবিগান, ঢপকীর্তন প্রভৃতি। অনেক সময় বিজয়ার দিনে হাতির মিছিলও বের হত।
এই আনন্দের মাত্রার রেশ ছড়িয়ে পড়ত সর্বত্র। এমনকি খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত দীর্ঘসময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যেত। ১৯০২ সালে ঢাকার প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ থেকে সেই রকমটাই জানা যায়, “শারদীয় পূজা উপলক্ষে আগামী সপ্তাহ হইতে চার সপ্তাহের নিমিত্ত ঢাকা প্রকাশ বন্ধ থাকিবে। গ্রাহক, অনুগ্রাহক এবং পৃষ্ঠপোষকবর্গের যথাযোগ্য অভিবাদন ও সাদর সম্ভাষণ করিয়া আমরা অবকাশ গ্রহণ করিতেছি। মা সর্ব্বমঙ্গলী সকলের মঙ্গল বিধান করুন।”
তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে সরকারি ছুটি পাওয়া যেত তিনদিন পর্যন্ত বন্ধ।
পাটনা রীতিতে আঁকা ১৮০৯ সালের দুর্গাপূজা।
দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হচ্ছে মা দুর্গা, বাহন সিংঘ আর অসুরের মূর্তি। পূজায় এইসব দেবদেবীদের মূর্তি থাকতেই হবে। না হলে কিসের পূজা? আর এসব মূর্তির ধরন শুরুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় একরকমই আছে।
প্রতিমায় সূক্ষ্ম কাজের উপর সাধারণত এর নির্মাণের সময়কাল নির্ভর করে থাকে। দুর্গাপূজার প্রতিমা নির্মাণ কাজ ধীরে সু্স্থে শুরু হয় রথযাত্রার পর থেকে। আর এ কাজ কুমোররা বংশ পরাম্পরায় করে আসছেন। তারা মূর্তি নির্মাণে ব্যবহার করে থাকেন মাটি, খড়, বাঁশ, কাঠ প্রভৃতি। প্রথমে খড়, বাঁশ, কাঠ দিয়ে মূর্তির ছাঁচ তৈরি করে নিয়ে মাটি দিয়ে দেওয়া হয় প্রলেপ। আর মূর্তি নির্মাণের জন্য সাধারণত এটেল, বেলে, দো-আঁশ মাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বুড়িগঙ্গার মাটি এখন ব্যবহারের অনুপোযোগী হওয়ায় ঢাকার কুমোরেরা সাধারণত সাভার, বিক্রমপুর, নায়াণগঞ্জের মতো এলাকা থেকে তাদের প্রয়োজনীয় মাটি সংগ্রহ করে থাকেন। মাটি শুকিয়ে গেলে একজন কুমোর তার মুন্সিয়ানা দিয়ে প্রতিমাটিকে প্রায় জীবন্ত করে তোলেন।
আগের দিনে প্রতিমা রং করার জন্য মূর্তি নির্মাতারা নির্ভর করতেন প্রাকৃতিক উৎসের উপর। খড়িমাটি ঘষে ঘষে বের করা গুড়া রংয়ের সঙ্গে পানি মিশিয়ে তৈরি করা হত আসল রং। মূর্তিতে রং লাগানোর জন্য ব্যবহার করা হত তুলি আর কাপড়। তবে আধুনিক জামানায় কুমোররা এসবের পরিবর্তে ব্যবহার করেন প্লাস্টিক পেইন্ট, ব্রাশ এমনকি স্প্রে মেশিন পর্যন্ত।
১৮১৬ সালের দিকে একটি প্রতিমা বানাতে খরচ পড়ত ১০ থেকে ২০ টাকা। আর এখন সেই খরচ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত।
এটা ঠিক বাংলায় দুর্গাপূজা শুরু হলেও আপামর হিন্দুদের কাছে এটি বৃহত্তর পূজা হয়ে উঠেনি। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বিভিন্নজনের আত্মজীবনীতে এ পূজার তেমন একটা বর্ণনাও পাওয়া যায় না। সে হিসেবে বলা যায়, তখনও এটি হিন্দুদের প্রধান উৎসবে পরিণত হতে পারেনি। আর পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর বা রাজধানী ঢাকাতে দুর্গাপূজার কথা তো শোনাই যায় না।
তৎকালীন ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলরের ১৮৩৯ সালে লেখা ‘ট্রপোগ্রাফি অফ ঢাকা’ বইতে ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ‘মহররম’, ‘বেরা’ এবং ‘বৈষ্ণ’ উৎসবের কথা বললেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে ছিলেন নিশ্চুপ। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঢাকার বাসিন্দা হৃদয়নাথ মজুমদার উনিশ শতকের সত্তর দশকেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে কিছু বলেননি। বরং বলেছেন ‘হোলি’, ‘ঝুলন’, ‘মহররম’-এর মতো ধর্মীয় উৎসবের কথা।
দুর্গাপূজা তখনও ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব না হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে বলেছেন, “ঢাকা মূলত বৈষ্ণব শহর।”
এ ধারাটি বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও বজায় ছিল। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তার ‘আট দশক’ বইতে লিখেছেন, “ঢাকার মতো বৈষ্ণবপ্রধান শহরে সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা নয়। আসল উৎসব ছিল ঝুলন আর জন্মাষ্টমী। শহরে অনেক মন্দির ছিল। সেগুলো ঝুলনের সময়ে উৎসবের সাজে সাজানো হত।”
উনিশশতকের দুর্গাপূজা লিথোগ্রাফ।
তাই বলে যে ঢাকায় দুর্গাপূজা একদমই হত না তা কিন্তু নয়। ভবতোষ বাবু আরও লিখেছেন, “বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলন তখনও হয়নি-- অন্তত ঢাকাতে। পূজা দেখতে যেতাম সূত্রাপুরের ঢাকার বাবু নন্দলালের বাড়িতে যেখানে দোতালা প্রমাণ বড় প্রতিমা হত। সবচেয়ে বেশি যেতাম টিকাটুলি ছাড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোয়। আমরা সবাই মিলে কাজ করতাম। ভিড় সামলানো থেকে দর্শনার্থীদের জুতোর খবরদারি করা পর্যন্ত। সন্ন্যাসীরা কীর্তন করতেন: আমরাও তাতে যোগ দিতাম।”
১৯৪৬ সালে নোয়াখালিতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ধনাঢ্য হিন্দু পরিবারগুলো এদেশ ত্যাগ করে। তখন থেকে এখানে একক ও পারিবারিকভাবে দুর্গাপূজা করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষভাবে বললে, জমিদারি প্রথা উঠে গেলে বন্ধ হয়ে যায় দুর্গাপূজায় জমিদারদের একক পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে চাঁদা তুলে সার্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা আয়োজনের সূচনা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির’কে ঘিরে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ দুর্গাপূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি।
তথ্য সূত্র: ভবতোষ দত্ত— ‘আট দশক’, কলকাতা ১৯৮৮। মনুতাসীর মামুন— ‘হৃদয়নাথের ঢাকা শহর’, ঢাকা ১৯৮৫। জেমস টেলর— ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’, ঢাকা। সঙ্কলক : পরাগ আজিম, ‘১০০ বছর আগে ঢাকা’, ঢাকা, ২০০৫।
প্রতিমা নির্মাতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ২০০৫।