ঘুম ঘুমভাব, বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে না হওয়ার মতো ঘটনা শীতকালে স্বাভাবিক বিষয়।
তাই বলে এই অবস্থাকে সার্বিকভাবে অসুস্থতা বা দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়ার কিছু নেই। সবাই এই রকম হয়।
ঋতুর পরিবর্তনে তাপমাত্রা ও দিনের আলো থাকার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে দেহের ওপর প্রভাব ফেলে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ‘প্লুটো পিলো’ প্রতিষ্ঠানের ঘুম-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. কার্লিয়ারা ওয়াইস বলেন, “আমাদের সার্কেডিয়ান রিদম বা জৈবিক ঘড়ি আলোর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়।”
ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “শীত আসতে আসতে প্রাকৃতিকভাবেই সার্বিকভাবে আলোর পরিমাণ কমতে থাকে, যা আমাদের সাধারণ ঘুম-জগরণে প্রভাব ফেলে।”
যে কারণে শীতকালে বেশি আলসেমি জাগে
বস্টনের ‘ব্রিগাম অ্যান্ড উইমেন্স’স হসপিটাল’য়ের ঘুম-বিশেষজ্ঞ ড. রেবেকা রবিন্স একই প্রতিবেদনে বলেন, “সকালে আলোর সংস্পর্শে আসার কারণে ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী নিউরোট্রান্সমিটার মেলাটনিন উৎপাদনের মাত্রা দেহে কমে আসে। যে কারণে আমরা ঘুম থেকে জাগরণের অবস্থায় যাই। তবে শীতকালে সূর্যের আলোর মাত্রা কমা ও কুয়াশার কারণে দেরিতে সূর্য দেখা দেওয়ার জন্য শরীরেও এক ধরনের ধোঁয়াশা পরিস্থিতির তৈরি হয়। যে কারণে ঘুম থেকে ওঠার পরও এক ধরনের ক্লান্তিভাব লেগে থাকে।”
ড. রবিন্স আরও বলেন, “শীতের সন্ধ্যায় আরও বেশি ক্লান্ত লাগতে পারে। কারণ সূর্য ডুবে তাড়াতাড়ি। অন্ধকারও হয় দ্রুত। ফলে শরীর ঘুমের জন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আর ঘুমাতে যাওয়ার সময়ের আগ থেকেই শরীরে এক ধরনের আলসেমি কাজ করতে থাকে।”
তারপর যখন আসলেই ঘুমাতে যাওয়ার সময় হয় তখন আর ঘুম আসতে চায় না। অথবা ঘুমিয়ে পড়তে অসুবিধা হয়। কারণ মস্তিষ্ক ততক্ষণে দ্বিধায় পড়ে গেছে কখন ঘুমাতে হবে আর কখন জেগে থাকতে হবে।
ফলে যখন বেশি জাগ্রত থাকার কথা, অর্থাৎ দিনের বেলা ক্লান্ত লাগে। আর যখন ঘুমের ভাব আসার দরকার মানে রাত্রে বেলা বেশি জেগে থাকা হয়।
ড. ওয়াইস বলেন, “শীতের সময়ে এই আলো কমার কারণে যে বিষণ্নতা তৈরি হয়, তাকে বলে ‘সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার বা স্যাড।”
এই ‘স্যাড’য়ে ভোগার লক্ষণ হল- বিষাদগ্রস্ততা, মেজাজের ওঠানামা, একাকিত্ববোধ, আলসেমি। আর সব মিলিয়ে দেখা দেয় ক্লান্তিভাব।
“পাশাপাশি শীতে তাপমাত্রা কমতে থাকায় ঘুম ঘুমভাব দেখা দেয়। কারণ তাপমাত্রা কমলে এমনিতেই ঘুমের মাত্রা বেশি হয়,” বলেন ড. রবিন্স।
যে কারণে শীতের সময় গরমকালের চাইতে বেশি ঘুমাতে ইচ্ছে করে। আর গরমকালে দেখা দেয় ঘুমের ব্যাঘাত।
শীতের অলসতা কাটানোর পন্থা
স্বাভাবিক বলেই যে বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না তা নয়। বরং এই সমস্যা কাটিয়ে দিনের বেলায় আরও কর্মক্ষম ও রাতে ভালো ঘুমের ব্যবস্থা তৈরি করা যায়।
ঘুম জাগরণের সময় ঠিক রাখা: দেহকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমিয়ে পড়া ও সকালে একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়তে হবে।
ড. ওয়াইস বলেন, “আর এজন্য সন্ধ্যার পর থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। কাজ কর্ম গুছিয়ে ঘুমের সময়ে অন্তত ত্রিশ মিনিট আগে সব ধরনের গ্যাজেট, বৈদ্যুতিক যন্ত্র, মোবাইল, টিভি ইত্যাদি দেখা বন্ধ করে দিতে হবে। আর সকালের ঝিমানোভাব কাটাতে, ঘুম ভাঙার ত্রিশ মিনিটের মধ্যে ঘরে আলোর ঢোকার ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেকে আলোর সংস্পর্শে আনতে হবে। আর জৈবিক ঘড়ি সচল করার জন্য সকালে নাস্তা করতে হবে সঠিক সময়ে।”
এভাবে কয়েকদিন করলেই দেহে এই অভ্যস্ততায় জড়িয়ে যাবে।
দিনে যতক্ষণ পারা যায় সূর্যালোকে থাকা: তারমানে এই নয়, রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
ড. রবিন্স বলেন, “শীতকালে দিনের পরিমাণ কম। তারপরও প্রাকৃতিক আলোর সংস্পর্শে যত বেশি থাকা হবে ততক্ষণ মেলাটনিন মাত্রা কম থাকবে। ফলে শরীরে তন্দ্রালুভাব দেখা দেবে না। কাচের জানালা গলে আসা বাইরের আলো দেহের ঘুম জাগরণের ঘড়ি ঠিক মতো কাজ করতে সাহায্য করবে।”
পাওয়ার ন্যাপ: বা স্বল্পমাত্রায় ঘুম সাংঘাতিক কার্যকর। আর দুপুরে অল্প ঘুমিয়ে নিতে পারলে দিনের বাকি অংশ ক্লান্তি কাজ করে না।
তবে কৌশল হল অনেকক্ষণ ঘুমানো যাবে না। আর সন্ধ্যার পর ‘পাওয়ার ন্যাপ’ নেওয়া যাবে না। নিলে দেহ মনে করবে্ এখনই ঘুমিয়ে পড়ার সময়।
ড. রবিন্স পরামর্শ দেন, “যে কারণে দুপুর তিনটার আগে ২০ মিনিটের ‘পাওয়ার ন্যাপ’ নিতে হবে। পাশাপাশি ক্যাফেইন গ্রহণে সমস্যা না থাকলে আর রাতে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটালে, এই অল্প ঘুমানোর পর এক কাপ চা বা কফি পান করতে পারলে আরও চাঙা অনুভূত হবে।”
শীতলতা কাজে লাগানো: শীত যেহেতু ঘুমের জন্য চমৎকার আবহাওয়া সেজন্য এটা কাজে লাগানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ঘরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য আলাদা যন্ত্র ব্যবহার না করে বরং শীত শীতভাব উপভোগ করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস করা উচিত হবে।
ঘুম পর্যাপ্ত হলে দিনের সময় এমনিতেই ক্লান্তি কম দেখা দেবে।
ডা. রবিন্স বলেন, “এক্ষেত্রে রাতে মাথার কাছে নেই এরকম কোনো জানালা খোলা রেখে ঠাণ্ডা নির্মল প্রাকৃতিক বাতাস উপভোগ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়াই হবে দারুণ বিষয়।”
আরও পড়ুন