অনেকেই শখে কবুতর পালেন। দেশী কবুতর গ্রামের অনেক পরিবারের পুষ্টির উৎস। তবে কেউ কেউ শুধুই ওড়া প্রতিযোগিতাসহ শোভাবর্ধনের জন্য কবুতর পোষেন।
Published : 07 Apr 2013, 03:00 AM
বেকারত্ব ঘুচাতে অনেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কবুতরের খামার স্থাপন করে আজ স্বাবলম্বী। এরকমই একজন পাবনা শহরের রাধানগর এলাকার বাসিন্দা সাইদ। তার সংগ্রহে বিদেশী কবুতর দেখে আকৃষ্ট হন রানা। তিনি বাসার ছাদেই গড়ে তোলেন কবুতরের খামার। রানার প্রতিবেশী ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ জানান-প্রথমদিকে জানতাম সে শখ করে দুটো কবুতর পুষছে। পরে দেখি তারা এ থেকে আয়ও করছে।
রাজধানীর অনেক কবুতর ব্যবসায়ী এদের কাছে এসে প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকার কবুতর কিনে নিয়ে যায়। সাইদ ও রানার কাছ থেকে জানা যায়- ২০০৬ সালে নব্বই হাজার টাকা নিয়ে কবুতর লালন-পালন শুরু করেন তারা। প্রথম দিকে কবুতরের অধিকাংশই চিকিৎসা ও অভিজ্ঞার অভাবে মারা যায়। সবমিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার মতো কবুতর ছিল। ওটাই শেষ পর্যন্ত পুঁজি হয়ে দাঁড়ায়। তারা আরও জানান, পাবনায় বর্তমানে দুইশর মত ব্যবসায়ী কবুতরের খামার করেছেন। রানা সাঈদের খামারসহ এসব খামারে রয়েছে বিরল প্রজাতির কবুতর এল-স্টার, বোখারা, নরেশ কোকার, স্টেচার, ফিলিগেচার ব্লু, ও হেনা পোর্টার।
রানা-সাঈদের কাছে প্রথম অবস্থায় বিদেশী কবুতর ছিল ৩০-৩৫টি। এখন তাদের সংগ্রহের তালিকায় রয়েছে পুরনো আমলের চিঠি আদান প্রদানের বিউটি হোমার থেকে শুরু করে ব্লু-ম্যাকপাই, ভিয়েল সর্টফেস টামলার, স্যালো, শিল্ড ফিল্ডব্যাক, হলুদ দোভাস, হাইফিলার টামলার, ম্যাকপাই পোটার, পেমোরিয়ান পোটার, র্যান্ড কিং, দোভাস হাইফিলার, কমন্ন্যার, নান, ফিলিগিচার, জার্মান পোর্টার, ফিলব্যাক, সার্টিং, মুক্ষী, ন্যাকেট নিক, ডাউন ফেস, হোমার, বাগদাদ হোমার, মডেনা, লক্ষ্যাসহ নানা প্রজাতির কবুতর। এসব কবুতর সর্বনিম্ন দুশ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে ম্যাগপাই পোর্টার প্রতি জোড়া ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। দোভাস হাই হিলার ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ও স্যালো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
কবুতর পালনের প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী
কবুতর পালনের সুবিধা
বিনিয়োগ কম। প্রতিপালন অত্যন্ত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত প্রজননকাল। বেকার যুবক এবং দুঃস্থ মহিলাদের আয় বাড়ানোর উৎস হতে পারে। অল্প জায়গায় এবং অল্প খাদ্যে পালন করা যায়। রোগ বালাই কম। মাংস সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পুরণের উৎস। কবুতরের মল জৈবসার হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
কবুতরের বাসস্থান
কবুতরের খাবার
পানি সরবরাহ
প্রতিদিন গভীর বা খাদ জাতীয় পানির পাত্র ভালভাবে পরিষ্কার করে ৩ বার পরিষ্কার পরিচছন্ন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা উচিত। দুই সপ্তাহ পর পর পটাশ মিশ্রিত পানি সরবরাহ করলে কবুতর পাকস্থলীর বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।
কবুতরের রোগ বালাই
রাণীক্ষেত- আক্রান্ত কবুতর থেকে সুস্থ কবুতরের দেহে এ রোগের জীবাণুর বিস্তার ঘটে। মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ১০ ভাগ। সবুজ ডায়রিয়া এবং প্যারালাইসিস ইত্যাদি এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। কবুতরকে জীবিত বা মৃত টিকা প্রয়োগ এবং খামারের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
ইনক্লুশন বডি হেপাটাইটিস- অসুস্থ কবুতরের বমির মাধ্যমে এ সংক্রামক রোগ খামারের অন্যান্য সুস্থ কবুতরে বিস্তার লাভ করে। এ রোগে মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ৪০ থেকে ১০০ ভাগ। দূর্গন্ধযুক্ত বাদামী বা সবুজ ডায়রিয়া, ঝিমানো, খাবারে অনীহা, শুকিয়ে যাওয়া, বমি করা এবং হঠাৎ মারা যাওয়া এ রোগের লক্ষণ। এ রোগের কোন চিকিৎসা না থাকার কারণে আক্রান্ত কবুতরকে দ্রুত সরিয়ে ফেলাই রোগের বিস্তার রোধ এবং প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
বসন্ত- সাধারণত শরীরের পালকবিহীন অংশ যেমন- চোখ বা মুখের চারিদিক, পা ইত্যাদি জায়গায় ফোস্কা বা গুটি দেখা যায়। আক্রান্ত কবুতরের চোখের পাতা ও চোখ ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং পানি পড়ে। আক্রান্ত কবুতরকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে ফোস্কা বা গুটিগুলোকে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার করে আয়োডিন যৌগ যেমন পভিতেসপ বা আয়োসান দিয়ে মুছে দিতে হবে। কোন চিকিৎসা না থাকার কারণে খামারের জৈবনিরাপত্তা রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
সালমোনেলোসিস- আক্রান্ত পিতামাতা থেকে ডিমের মাধ্যমে, খাবার, পানি, খামারে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কর্মরত শ্রমিক ও আগত অন্যান্য লোকজন, খাদ্য সরবরাহের গাড়ি, বন্যপ্রাণী যেমন ইঁদুর ইত্যাদির মাধ্যমে খামারে এ সংক্রমক রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটে। শতকরা ৫ থেকে ৫০ ভাগ বা তারও বেশি কবুতর আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত কবুতরের ডায়রিয়া, শুকিয়ে যাওয়া, পা এবং পাখায় প্যারালাইসিস এবং ডিম পাড়ার সমস্যা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। আক্রান্ত কবুতর খামার থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
এসপারজিলোসিস- আক্রান্ত কবুতর থেকে শ্বাস প্রশ্বাস মাধ্যমে সুস্থ কবুতর আক্রান্ত হতে পারে। এই ছত্রাকজনিত রোগে মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। শ্বাস কষ্ট, ঝিমানো, শুকিয়ে যাওয়া, খাবারের প্রতি অনীহা, ওজন কমে যাওয়া এবং ঘন ঘন পিপাসা পাওয়া ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ। কার্যকরী ছত্রাক বিরোধী ঔষধ যেমন Amphotericine দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য আক্রান্ত কবুতর খামার থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং খামারের জৈবনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
রক্ত আমাশয়- বিভিন্ন প্রজাতির প্রটোজোয়া দিয়ে এ রোগ হতে পারে। সংক্রামিত খাবার বা পানি থেকে মুখের মাধ্যমে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ। রক্ত মিশ্রিত ডায়রিয়া, ক্ষুধামন্দা এবং ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি এ রোগের প্রধান লক্ষণ। রোগ প্রতিরোধের জন্য আক্রান্ত কবুতর কার্যকরী জীবাণুনাশক দিয়ে শেড ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং কঠোর জৈবনিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে।
ক্যাঙ্কারঃ আক্রান্ত বয়স্ক পিতামাতা কবুতর থেকে দুধের মাধ্যমে বাচ্চায় প্রটোজোয়ার আক্রমণে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। আক্রান্ত জীবিত কবুতর সারাজীবন এ রোগের জীবাণু বহন করে। মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ। আক্রান্ত কবুতর অস্থির থাকে, পাখা উষ্কখুষ্ক হয়ে যায়, খাবার কম খায় এবং ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যায়। অসুস্থ কবুতরের মুখের চারিদিকে সবুজাভ বা হলুদ লালা লেগে থাকে। আক্রান্ত কবুতরকে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।
কবুতর পালনে আর্থিক লাভ
যেথায় পাবেন পায়রা
প্রতি শুক্রবার গুলিস্তানের কাপ্তানবাজারে কবুতর এবং কবুতরের খাবারের বিশাল হাট বসে। এখানে দেশী-বিদেশী প্রায় সব ধরনের কবুতর পাওয়া যায়। এ ছাড়া জিঞ্জিরায় শুক্রবার, ঢাকার পাগলায় শনিবার হাট বসে। কাপ্তানবাজার এবং কাঁটাবনে কিছু স্থায়ী দোকান আছে যেখানে সারা সপ্তাহ কবুতর ও খাবার পাওয়া যায়। এছাড়া সোশ্যাল নেটওর্য়াক facebook.com/Bangladesh Pigeon Sales, বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং অনলাইন ক্রয়-বিক্রয় ওয়েবসাইট-এ বিভিন্ন বিজ্ঞাপন এর মাধ্যমে কবুতর বেচা কেনা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন জাতের কবুতর এবং মূল্য
ম্যাগপাই ৫ থেকে ৭ হাজার। বুডারবল ৭ থেকে ১০ হাজার। লক্ষ্যা ১ থেকে ৭ হাজার টাকা। লালসিরাজী ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। সিলভার সিরাজী ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। এছাড়া বিভিন্ন দেশী কবুতর ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ব্লু-ম্যাকপাই, ভিয়েল সর্টফেস টামলার, স্যালো, শিল্ড ফিল্ডব্যাক, হলুদ দোভাস, হাইফিলার টামলার, ম্যাকপাই পোটার, পেমোরিয়ান পোটার, র্যান্ড কিং, দোভাস হাইফিলার, কমন্ন্যার, নান, ফিলিগিচার, জার্মান পোর্টার, ফিলব্যাক, সার্টিং, মুক্ষী, ন্যাকেট নিক, ডাউন ফেস, হোমার, বাগদাদ হোমার, মডেনা, লক্ষ্যাসহ নানা প্রজাতির কবুতর ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।