সন্ধ্যা-রাতে, বনের ফাঁক দিয়ে পথ। সেপথে দুজন মাত্র অভিযাত্রী। পা দুটোই ভরসা। মাঝে মাঝে বনের মধ্যে জ্বলন্ত চোখগুলো দেখে আৎকে উঠলেন দুজন।
Published : 30 Mar 2018, 03:37 PM
“স্যার, আমরা মাত্রই এলাম। আজ আর বগালেক থাকবো না, যদি অনুমতি দেন তবে সোজা কেওক্রাডং চলে যাব। আমি আপই, গাইডের কাজে নতুন। সন্ধ্যা হয়ে গেল বলে, প্লিজ স্যার অনুমতি হবে?” এভাবে অনেক মিনতি করেও অনুমতি পাওয়া গেল না বগালেক আর্মি ক্যাম্প থেকে।
অপাই আমার গাইড, যাব কেওক্রাডং। পথ দূর্গম বলে বিকেল তিনটার পরপরই অনুমতি বন্ধ করে দেয় আর্মি ক্যাম্প থেকে। আমিও পণ করেছি আজই যাব, রাতটা কেওক্রাডং কাটিয়ে সকালে চলে আসবো। কি আর করা, শেষে নিজের ওপর সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে অফিসারের কাছে নিজেই মিনতি করি।
ফ্রেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি মিলে লম্বা একটা ছুটি। হলে কি হবে, ছুটিতে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। একুশ ফেব্রুয়ারির দিন শেষ হয়ে রাত দশটা বেজে গেছে। হঠাৎ কেমন টান অনুভব করলাম। সে টান আমাকে ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ড নিয়ে গেল। মনে হল কেওক্রাডং আমায় ডাকছে, সে ডাক উপেক্ষা করার উপায় ছিল না।
পথে নামলাম। তবে বাসের টিকিট মিলবে কিনা সেই সন্দেহ বুকে করে ফকিরাপুল এগিয়ে চললাম। ফকিরাপুল এসে জানলাম বান্দরবান যাওয়ার সব বাস এরইমধ্যে ছেড়ে গেছে। অগত্যা, চট্টগ্রামের বাসে চেপে বান্দরবান যাওয়ার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। কিন্তু সে আশাতেও গুড়েবালি, টিকিট নাই। হাঁটা শুরু করলাম নটরডেম কলেজের উদ্দেশ্যে। জানতাম চট্টগ্রাম যাওয়ার এসি বাসের টিকিট পাওয়া সম্ভব। তবে ভাগ্য ভালো ছিল, সেন্টমার্টিন পরিবহনের কাউন্টারে এসে সরাসরি বান্দরবানের টিকিটই পেয়ে গেলাম, সে বাস ছাড়লো রাত সাড়ে এগারোটায়!
দেরি করার উপায় ছিল না, বন্ধু তপনের সঙ্গে দেখা করে তাকে নিয়ে রুমা বাসস্ট্যান্ড চলে যাই। দুপুর একটার বাস ছেড়ে যাচ্ছে রুমার উদ্দেশ্যে, তবে সিট নাই। তাতে কি! ওটাতেই চড়ে বসি।
তিনটায় রুমা হয়ে বগালেক পৌঁছি বিকেল পাঁচটায়। বগালেক বান্দরবনের গহীনে লুকিয়ে থাকা অপার সৌন্দর্যের আধার। যতই এখানে আসি আর দেখি রহস্যের কুল কিনারা পাই না। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩শ’ ফুট ওপরে পাহাড়ের মধ্যেখানে প্রাকৃতিক এ লেক দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া গেলেও আমার পথনির্দেশক আপুই বেঁকে বসলো, শেষে তাকে টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে রাজি করিয়ে কাল-বিলম্ব না করে সাড়ে পাঁচটায় কেওক্রাডং’য়ের উদ্দেশ্যে বগালেক ছাড়লাম।
তার আগে কিছুটা শুকনা খাবার আর পানি নিয়ে নিলাম। আমরা যখন পথে নামি, তখন পাহাড়ের কোনে গোধূলির উঁকিঝঁকি!
চাঁদ না থাকলেও স্বচ্ছ আকাশে তারার মেলা ছিল। তারা গুনে গুনে আমরা পথ চললাম। অনেকক্ষণ হাঁটার পর নিজেকেই নিজের কাছে মনে হল হাঁপাচ্ছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে। মোবাইলকে টর্চ বানিয়ে দেখেশুনে পথ চলছিলাম, অপাইর সে বালাই নেই, সে ধুপধাপ এগিয়ে চলেছে। এখানে চড়াই এমন যে কোথাও সমতলে বসে একটু বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই। তবু একটা গাছের গুঁড়িতে বসে পড়লাম। বিস্কুট আর পানি পান করি আরাম করে।
অপাইর তাড়া, বেশি সময় আরাম করা যাবে না। বলা তো যায় না কোনো অঘটন চলে এলে!
ভয়ের জন্যই ঘন ঘন হাফ ধরে যাচ্ছে। মনের ভয়ে কিনা দ্রুত অন্ধকারে পা চালানোর শক্তি পাই। রাস্তার দুপাশে বুনো গন্ধ ছাড়া আর পথের ওপর টর্চ মেরে ধুলো ওড়া পথ দেখা ছাড়া আর কিছুই নজরে আসছিলো না। এভাবে উপর নিচ করে কতক্ষণ চলেছি তার হিসেব রাখতেও ভুলে গেছি।
পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে ডগডগ করে পানি পান করে আবার যাত্রা শুরু করি। যতই সামনে এগিয়েছি, কেওক্রাডং’য়ের দূরত্ব ততই কমে আসছে। কিন্তু চলতি পথে ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়নি, মাঝে মাঝে অবশ্য জ্বলজ্বল করা শেয়ালের চোখ দেখে ভয় পাওয়ার উপক্রম হয়েছে, ব্যাস ওই পর্যন্তই!
এভাবেই পথের বাঁকে বাঁকে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে শুন্যতা আর অন্ধকার উপভোগ করে করে এক সময় আমরা দার্জিলিং পাড়া পৌঁছি। এবার মোবাইলে সময় অনুসন্ধান করে দেখি সে সময় রাত নয়টা বাজে।
গরম গরম পুরি না থাকলেও দেশি মুরগি দিয়ে গরম ভাত ছিল। অল্প খেয়ে আবার চা পান করলাম। অপাই এরমধ্যে কেওক্রাডং যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটু পর সে জানালো থাকার জায়গার অভাব সেখানে। আজ রাত আমরা দার্জিলিং পাড়াতেই থেকে যাই।
আমি জোড় গলায় বললাম, “এখানে ঘুমাতে আসিনি। আমি কেওক্রাডং’য়ের চূড়ায় জেগে রাত কাটাবো। তুমি নিজের জন্য ঘুমের ব্যবস্থা করে নিও।”
“শুনো অপাই কেওক্রাডং’য়ের একেবারে কাছে আমরা। বাকি পথটুকু চোখ বন্ধ করেই চলা যাব।”
অপাইর মুখে কোনো রা নেই, নেই কোনো শব্দ। চুপচাপ সে আমার ব্যাগ গুছিয়ে যাত্রা শুরু করলো, আমিও দোকানির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে অপাইর পিছু নিলাম। রাত দশটায় আমরা কেওক্রাডং পৌঁছালাম।
বগালেক থেকে যাত্রা শুরু করে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখিনি। ঘন জঙ্গলের ফাঁকে নীলাকাশ, সবুজ সমুদ্রে হাবুডুবু অথবা পথের বাঁকের সৌন্দর্য এবং চিংড়ি ঝরনার মরা সৌন্দর্যসহ কিছুই না।
সেদিন কেওক্রাডং পৌঁছে অবাক হই। এত্ত পর্যটক কেওক্রাডং’য়ের পাদদেশে যে, ঠিক মতো পা ফেলার উপায় টুকু নেই, থাকার জায়গা তো আকাশের চাঁদ। কোথায় কীভাবে রাত্রিযাপন হবে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে কিছু সময় পরিবেশটার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করি।
তারপর আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করতে গিয়ে যারপরনাই অবাক হই। আমার সম্পর্কে বগালেক ক্যাম্প থেকে আগাম জানিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের। পাগলা পরিব্রাজক নাকি আমি এবং সাংবাদিক। সুতরাং একটু যত্ন যেন নেয় তারা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
বছরের যে কোনো সময় কেওক্রাডং যাওয়া যায়। যারা রোমাঞ্চপ্রিয় প্রিয় তাদের জন্য মে, জুন এবং সেপ্টেম্বর ভালো সময়।
সাধারণ পর্যটকদের জন্য শীতকালটাই ভালো। এখন কেওক্রাডং যাতায়াত সহজ। একেবারে বগালেক পাড়ে গাড়ি চলে যায়। চাইলে কেউ কেউ কেওক্রাডং পর্যন্তও চান্দের গাড়িতে যেতে পারবেন। তার ওপর কেওক্রাডং চূড়ায় ওঠার জন্য সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বহু আগের সে মজা বা কেওক্রাডং ভালোবাসা সত্যিকার অর্থে নেই। তবু কেওক্রাডং বলে কথা।
ঢাকা থেকে বান্দরবানের খুব ভালো মানের বাস চলাচল রয়েছে। বান্দরবান থেকে রুমা যাত্রার জন্য বাস বা চান্দের গাড়ি পাবেন। রুমা বাজার পৌঁছে গাইড নিয়ে একই ভাবে চান্দের গাড়িতে বগালেক যাওয়া যায়।
এখানে রাত্রি যাপন করে পরদিন ভোরে চলে যান কেওক্রাডং। কেওক্রাডং রাত্রিযাপন না করলে রাতের কেওক্রাডং এবং ভোরবেলা তার অপরূপ সৌন্দর্য ও সূর্যোদয়সহ তার আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।
কেওক্রাডং এবং বগালেকে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা গাইডই করে দেবে। বড় দল হলে অবশ্যই আগে থেকে সব বন্দোবস্ত করে যাবেন।
ভাবনার কিছু নেই বলেছিলাম, আসল চিন্তার বিষয় হল, পাহাড় আর পাহাড় নেই। সেই আগের বুনো রূপ সে হারিয়ে ফেলেছে বহু আগে, আমাদেরই জন্য!