কী খাচ্ছেন সেটার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে মানসিক ও শারীরিক অবস্থা।
Published : 03 Jun 2024, 11:52 AM
‘যা খাচ্ছ সেটাই তুমি’- শুধু চটকদার বাক্য নয়, স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে এটাই সত্য কথা।
পুষ্টিকর সুষম খাবার খাওয়ার মাধ্যমে শরীর ও মন সুস্থ রাখা সম্ভব হয়। আর আজেবাজে খাবার যত খাওয়া হবে ততই স্বাস্থ্যের বারোটা বাজবে।
“এই কারণে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার কোনো নির্দিষ্ট বয়স লাগে না। যে কোনো সময়ে এই কাজটা শুরু করে দেওয়া যায়” – প্রিভেনশন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এভাবেই মন্তব্য করেন ‘ইট টু বিট ডিজিজ: দি নিউ সায়েন্স অফ হাও ইয়োর বডি ক্যান হিল ইটসসেল্ফ’ বইয়ের লেখক ডা. উইলিয়াম লি।
চীনা বংশোদ্ভূত এই মার্কিন চিকিৎসক আরও বলেন, “নিজের সুস্থতার জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়াও আমরা যেটা করতে পারি তাহল স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস গড়া।”
তাই প্রদাহ দূরে রাখা, হৃদপিণ্ড, অন্ত্র, কঙ্কাল ও মস্তিষ্ক ভালো রাখার ক্ষেত্রে যে ধরনের খাবারগুলো কাজ করে সেসব বিষয়ে সবারই ধারণা থাকা দরকার।
অন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা
স্বাস্থ্যকর অন্ত্র হল সার্বিকভাবে সুস্থ থাকার প্রথম শর্ত। কারণ সারা শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টির শোষণ এখান থেকেই হয়। আর শুধু মস্তিষ্ক নয়, মানসিক অবস্থার ক্ষেত্রেও প্রভাব রাখে।
এই বিষয়ে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক পুষ্টিবিদ ভ্যালেরি অ্যাজিম্যান বলেন, “স্বাস্থ্যকর অন্ত্র খাবার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে। শরীর সেগুলো কাজে লাগায়।”
আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ৭০ শতাংশ কার্যকারিতা নির্ভর করে অন্ত্রের ওপর। পাশাপাশি মস্তিষ্কের সাথে এর সরাসরি যোগযোগ রয়েছে যা মানসিক অবস্থার ওপরেও প্রভাব রাখে।
অন্ত্র ভালো রাখতে দরকার হয়-
প্রোবায়োটিক খাবার: অন্ত্রে ভালো ব্যাক্টেরিয়ার যোগান দেয়। দই, কেফির, কিমচি, কাম্বুচা- এই ধরনের গাঁজানো খাবার থেকে মিলবে অন্ত্র উপকারী উপাদান।
প্রিবায়োটিক খাবার: অপাচ্য আঁশ সমৃদ্ধ খাবার অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়ার জন্য উপকারী। যা পাওয়া যায় আদা, পেঁয়াজ, কলা এবং মধু থেকে।
আঁশযুক্ত খাবার: অন্ত্রের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে এই উপাদান প্রয়োজন। এছাড়া মল অপসারণসহ হজমতন্ত্রের সার্বিক উন্নতিতে আঁশ কাজ করে। এজন্য খাওয়া উচিত বাদাম, বীজ, মটর, অপ্রক্রিয়াজাত পূর্ণ শষ্য- যা আঁশের যোগান দেয়।
প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে
দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার একটি অংশ হল প্রদাহ। এর মাধ্যমে শরীর বিভিন্ন আঘাত বা অসুস্থতা সারিয়ে তুলতে কাজ করে। তবে প্রদাহ দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতি হয় কোষকলার। ফলে নানান অঙ্গ প্রতঙ্গে দেখা দেয় সমস্যা। হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস-সহ নানান দীর্ঘস্থায়ী রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাই প্রয়োজন-
রঙিন ফল ও সবজি: বেরিজ, আপেল, কপি, গাজর, ব্রকলি, বিট, ক্যাপ্সিকাম-সহ যে কোনো উজ্জ্বল রংয়ের খাবারে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রদাহরোধী উপাদান।
আঁশ সমৃদ্ধ খাবার: স্বাস্থ্যকর অন্ত্র প্রদাহ দূরে রাখতে পারে। এজন্য চাই আঁশ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- ডাল, পূর্ণ শষ্য ও মটর।
স্বাস্থ্যকর চর্বি: পলিআনস্যাচুরেটেড যেমন- ওমেগা থ্রি’স ফ্যাটি অ্যাসিড এবং মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট প্রদাহ দূরে রাখতে পারে। মাছ, বাদাম, জলপাই ও জলপাইয়ের তেল থেকে মিলবে এই উপাদান।
ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: প্রদাহের বিরূদ্ধে লড়তে কাজ করে ম্যাগনেসিয়াম। পালংশাক, কুমড়ার বীজ, টুনা মাছ, বাদামি চাল, কাঠবাদাম, কালো মটর, কলা এবং ডার্ক চকলেট হল এই খনিজের উৎস।
মসলা ও লতাগুল্ম: শুধু খাবারের স্বাদই বাড়ায় না, প্রদাহের বিরূদ্ধে লড়তেও কাজ করে।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে
“হরমোন ও ‘নিউরোট্রান্সমিটার’য়ের সমন্বয় সাধনের মধ্যে পুষ্টি উপাদান সরাসরি প্রভাব রাখে”- বলেন নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক পুষ্টিবিদ লরা লু।
এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক চাপ, বিষণ্নতা ও উৎকণ্ঠার ক্ষেত্রে ভিটামিন ও খনিজ নানানভাবে কাজ করে। দুই ধরনের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডস মানসিক অস্থিরতা কমাতে পারে।
মাছ: মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি সামলাতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর চর্বি ও ভিটামিন ডি পাওয়া যায় মাছ থেকে।
ওটস: জটিল কার্বোহাইড্রেইট রয়েছে এমন শষ্য যেমন- ওটস রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রেখে মন মেজাজ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। আরও যোগান দেয় ভিটামিন বি, যা মস্তিষ্কের রাসায়নিক ‘সেরোটনিন’ উৎপাদানে প্রয়োজন। এই হরমোন মন শান্ত করতে ভূমিকা রাখে।
বাদাম ও বীজ: এগুলো ওমেগা থ্রি’স ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস যা মানসিক চাপের হরমোন সামলাতে পারে।
ডার্ক চকলেট: এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মন মেজাজের উন্নতি ঘটায়।
দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, পনির ও দই মানসিক উন্নতিতে কাজ করে। কারণ এসবে থাকা ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি ‘সেরোটনিন’ উৎপাদন বাড়িয়ে মেজাজের উন্নতি ঘটাতে পারে।
হাড়ের সুস্থতা
বয়স বৃদ্ধির সাথে পেশি ও হাড়ের ক্ষয় প্রাকৃতিকভাবেই হয়। ফলে দেখা দেয় হাড় ভঙ্গুর রোগ। পাশাপাশি নড়াচড়ার ক্ষমতাও কমে।
“এই সমস্যা ধীর করতে ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ার পাশাপাশি প্রয়োজন ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস” মন্তব্য করেন মার্কিন পুষ্টিবিদ মারিসা মুর।
এসব খনিজ হাড় গঠনে সাহায্য করে। এছাড়া দেহে ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন ডি’র প্রয়োজন হয়। ম্যাগনেসিয়াম এবং প্রোটিন হাড় ও পেশির স্বাস্থ্যরক্ষায় কাজ করে।
প্রোটিন: উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ- দুই উৎস থেকেই দেহের প্রতি ওজনের বিপরীতে ০.৬ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা দরকার। মটর, ডাল, মাছ, ডিম, মুরগির মাংস প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার: দুগ্ধজাত খাবার ও উদ্ভিদ ভিত্তিক দুধ- যেমন সয়া মিল্ক, দই, মাছ ও ডিম এসবের উৎস।
ভিটামিন কে এবং নাইট্রেট সমৃদ্ধ খাবার: এই দুই উপাদান হাড় ও পেশি স্বাস্থ্য গড়তে সাহায্য করে। পত্রল-শাক ও কপি-ধর্মী সবজিতে থাকে ভিটামিন কে। এছাড়া শাক ও বিট থেকে মিলবে নাইট্রেট।
হৃদযন্ত্রের সুস্থতায়
সঠিক ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক গতি বজার রাখতে সাহায্য করে। ফলে রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
ডা. লি বলেন, “এরজন্য কোনো নির্দিষ্ট খাবার নয় বরং পলিফেনল্স ও আঁশ আছে এরকম খাবারের দিকে নজর দিতে হবে। আর কমাতে হবে প্রক্রিয়াজাত খাবারের গ্রহণের মাত্রা।”
ফল: বেরি থেকে শুরু করে যে কোনো ফলে হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী উপাদান থাকে।
টক ফল ও ফুঁটি: এগুলো থেকে মিলবে পটাসিয়াম যা হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী। আর রক্তের স্বাভাবিক চাপ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
মটর: এতে থাকা দ্রবণীয় আঁশ কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ম্যাগনেসিয়াম স্বাস্থ্যকর হৃদগতি বজায় রাখতে পারে আর ডায়াবেটিসের হাত থেকে রক্ষা করে।
অলিভ অয়েল: এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ‘হাইড্রোক্সিটাইরোসোল’ হৃদযন্ত্র রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
টমেটো: লাল ও গোলাপি খাবার যেমন- টমেটো, গোলাপি আঙুর ও পেয়ারা, তরমুজে থাকা ‘লাইকোপেন’ হৃদ-পেশি ও ধমনির সুস্থতায় ভূমিকা রাখে।
এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম করা ও পর্যাপ্ত পানি পানের অভ্যাস দেহ সার্বিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন
খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নিজেকেই তিনটা প্রশ্ন করুন