প্রস্তর যুগ থেকেই মানুষের শরীর চর্বি জমিয়ে রাখতে অভ্যস্ত।
Published : 29 Jan 2024, 04:12 PM
যদি ভাবেন ওজন কমানো কষ্টকর তবে আপনি একা নন। সবার ক্ষেত্রেই বিষয়টা শতভাগ সত্যি।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজ’য়ের পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদে ওজন কমিয়ে রাখা বেশ কঠিন।
গবেষণার বরাত দিয়ে সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, পরিমাণে তারতম্য ঘটতে পারে, তবে বিশ্বাস করা হয় যারা ওজন কমায় তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশরই পাঁচ বছরের মধ্যে ওজন বৃদ্ধি পায়।
আর এই ক্ষেত্রে ‘ব্যর্থতা সফলতার স্তম্ভ’ কথাটা খাটে না। কারণ ওজন কমাতে অনেক কিছু করার মানসিক শক্তি থাকতে হয়। যেমন- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ক্যালরি গ্রহণ কমানো, শারীরিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো ইত্যাদি।
তবে নিষ্ঠুর বিষয় হল, মানুষের শরীর বিবর্তন থেকেই চর্বি জমিয়ে রাখার জন্য প্রোগ্রাম করা।
এই বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হিউম্যান ইভোলিউশনারি বায়োলজি’ বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ড্যানিয়েল লিবারম্যান বলেন, “ইচ্ছাকৃতভাবেই ওজন না কমানোর জন্য আমরা বিবর্তিত হয়েছি।”
জীবাশ্ম ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য নিয়ে মানুষের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা এই গবেষক (পালিওঅ্যান্থ্রোপলজিস্ট) সিএনএন’য়ের প্রধান স্বাস্থ্য-বিষয়ক সাংবাদিক ডা. সঞ্জয় গুপ্তাকে দেওয়া পডকাস্টে আরও বলেন, “সব প্রাণীর চর্বি প্রয়োজন। তবে মানুষের স্বভাবগতভাবেই বেশি মাত্রায় চর্বির দরকার হয়। এমনকি হালকা পাতলা মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। আর চর্বি জমিয়ে রাখার জন্য জৈবিকভাবেই আমরা একটা চাপে থাকি, যাতে পরে প্রয়োজন পড়লে ব্যবহার করা যায়।”
তিনি আরও বলেন, “মৌলিকভাবেই মানুষ সুখী বা সু্স্থ থাকতে নয় বরং প্রজননের জন্য সফল হতে চায়। যে কারণে আমাদের চাই চর্বি, প্রচুর চর্বি।”
এই কারণে লিবারম্যান অন্যান্য স্তন্যপায়ী ও গোত্রের জীবের সাথে তুলনা করে মানুষকে ‘একটি অদ্ভূত চর্বিযুক্ত প্রাণী’ হিসেবে আখ্যা দেন।
“আমাদের একটা বিশাল মস্তিষ্ক রয়েছে। এরজন্য প্রয়োজন প্রচুর শক্তি, বিপাক প্রক্রিয়ার প্রায় ২০ শতাংশ”- বলেন এই অধ্যাপক।
“আর নবজাতক বা শিশুদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় শরীরের অর্ধেক শক্তি। সেই কারণেও প্রচুর চর্বির প্রয়োজন। তাই মানব শিশু চর্বিবহুল হিসেবে জন্ম নেয়। যাতে তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম সঠিকভাবে চলতে পারে।”
লিবারম্যান মন্তব্য করেন, “চর্বি হল জমানো শক্তি। এটা মানুষকে বাঁচতে, শরীরে শক্তি যোগাতে, খাবার খুঁজতে ও প্রজনন ক্ষমতা ঠিক রাখতে সহায়তা করে।”
“এটা অনেকটা ব্যাংকে রাখা টাকার মতো। তাই দেখা গেছে, যারা উপযুক্ত মাত্রায় চর্বি জমাতে পেরেছে, বিবর্তনের ইতিহাসে তারাই ভালো করেছে অন্যদের তুলনায়” বলেন তিনি।
তাই সবসময় আমাদের চর্বি ধরে রাখার জন্য নির্বাচিত করা হয, কারণ সময় হলে যাতে খরচ করতে পারি।
মানুষ আসলে স্বাভাবজাতভাবে চর্বি ঝরানোর জন্য বিবর্তিত হয়নি।
তবে আমাদের আশপাশের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন জন্তু-জানোয়ারের তাড়া খেয়ে ভাগতে হয় না, অনেক দূর পায়ে হেঁটে ভ্র্রমণ করতে হয় না। বরং ফোন করলেই চলে আসে গাড়ি বা ঘরে চলে আসে রান্না করা খাবার।
ফলশ্রুতিতে ওজন বাড়ার মতো সমস্যা আমাদের মাঝে দেখা দিয়েছে।
লিবারম্যান এই সমস্যাকে ‘অসামঞ্জস্যময় রোগ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “এই ‘ওজন বৃদ্ধিকারক পরিবেশ’ প্রায় সময়ই ওজন বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
স্থূলতার সমস্যা দূর করতে তাই লিবারম্যান পাঁচটি বিষয় মাথায় রাখতে পরামর্শ দেন।
বিকাশ বা বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ
চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের মতো আকর্ষণীয় দেহের অধিকারী সবাইকে হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। টেলিভিশন, ছায়াছবি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাই আসুক- মনে রাখতে হবে সবারই চর্বি প্রয়োজন।
লিবারম্যান বলেন, “মানুষের জন্য চর্বি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি হালকা-পাতলা মানুষেও ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ চর্বি থাকে। যা কিনা অন্যান্য স্তন্যপায়ীর থেকে তিন থেকে চার গুন।”
সব সময়ই নির্দিষ্ট পরিমাণ চর্বি থাকতে হবে। আর প্রয়োজনে সেটা খরচ হবে।
চর্বির সাথে বিবর্তন সাফল্যের সম্পর্ক
বেঁচে থাকতে আর উন্নতি সাধনের জন্য আসলে চর্বি প্রয়োজন।
“শারীরিকভাবে কার্যক্রম থেকে প্রজনন ক্ষমতা ধরে রাখতে আর আমাদের বিরাট মস্তিষ্কের শক্তি যোগাতে সহজাতভাবে চর্বির খুবই প্রয়োজন”- বলেন লিবারম্যান।
তবে তিনি সাবধান করে দিয়ে বলেন, “সহজাতভাবে আমাদের পেটে কিন্তু চর্বি জমার কথা না। এর ফলে স্বাস্থ্যর নানান সমস্যা দেখা দেয়। তাই দেহের মধ্যভাগে চর্বির পরিমাণ বাড়ালে অন্য কিছুর লক্ষণ হিসেবে ধরতে হবে।”
অল্প ওজন ওঠা-নামা করা স্বাভাবিক
স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অল্প ওজন বাড়া কমা কোনো বিষয় না।
“প্রায় সময় এই পার্থক্য হয় পানির কারণে”- বলেন লিবারম্যান।
তার কথায়, “বেশিরভাগ মানব ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন তারা বেশি শক্তি গ্রহণ করে তখন খরচও করে। বেচে যাওয়া শক্তিটুকু চর্বি হিসেবে জমা হয়। আর যখন চর্বিহীন সময় যায় তখন সেখান থেকে বাড়তি শক্তি খরচ করে।”
পরিস্থিতি সবসময় আপনার বিরুদ্ধে
যদি ওজন কমানো কষ্টকর হয় তবে নিজেকে দোষ দিয়েন না- মন্তব্য করেন লিবারম্যান।
তার কথায়, “মানুষের সহজাত স্বভাবই হল প্রচুর পরিমাণে চর্বি সংরক্ষণ করা আর প্রয়োজনে খরচ করা। তবে কখনও স্বাভাবিকভাবে সেচ্ছায় ব্যবহারের চেয়ে কম শক্তি আমরা গ্রহণ করিনি- আর সেটা করলে হল ‘ডায়েট’।
তিনি জানান, ডায়েট খিদার অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। এজন্য যারা ডায়েট করেন তাদের খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। আর শক্তি সঞ্চয় করতে গিয়ে বিপাকক্রিয়া ধীর হয়ে যায়।
“তাই যখন ডায়েট করার মাধ্যমে মানুষ তার প্রাচীন, মৌলিক খাপখাওয়ানো বিষয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে ওজন কমানোর চেষ্ট করে তখন তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়।”
ডায়েট বনাম ব্যায়াম
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কারণ ভিন্ন।
“শরীরচর্চা ছাড়া ডায়েট করার মাধ্যমে বেশি ওজন কমাতে পারবেন”, বলেন লিবারম্যান।
আরও বলেন “তবে ব্যায়াম ওজন কমাতে ও পুনরায় বাড়তে দেয় না। তাছাড়া শারীরিক ও মানসিকভাবেও এর অনেক উপকার রয়েছে।”
আর সেই প্রস্তর যুগ থেকে বর্তমান আধুনিক যুগের স্থূলতাময় পরিবেশ পর্যন্ত, শরীরের এই অমিলের কারণে জন্য লিবারম্যান পরামর্শ দেন, “বিশ্ব কীভাবে আমাদের পছন্দ অনুযায়ী সাহায্য করবে সেটার কৌশল আমাদেরকেই বের করতে হবে।”
ছবির মডেল: বন্যা। আলোকচিত্র: রাইনা মাহমুদ। বিন্যাস ও পরিকল্পনা: আলি আফজাল নিকোলাস। সৌজন্যে: ত্রয়ী ফটোগ্রাফি স্টুডিও।
আরও পড়ুন