Published : 02 May 2025, 03:04 PM
প্রত্যেকের জীবনেই শব্দ যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কেউ সারাদিন টিভি চালিয়ে রাখেন, কেউ আবার ঘুমের সময়ও হেডফোনে গান শুনে থাকেন। তাই নীরবতা মানে অনেকের কাছেই অস্বস্তি হয়ে ওঠে।
তবে প্রশ্ন হল, এই নীরবতা কি আসলেই খারাপ? নাকি শরীর ও মনের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীরবতারও আছে উপকারিতা। শরীর ও মনের আরাম, চিন্তা পরিষ্কার হওয়া, এমনকি হৃদস্পন্দন কমে আসা পর্যন্ত। তবে এই উপকারিতা পাওয়া নির্ভর করে নীরবতাকে কীভাবে দেখা হয় এবং গ্রহণ করা হয়, সেটার ওপর।
নীরবতা কারও কাছে শান্তি, আবার কারও কাছে অস্বস্তির কারণ কেন?
ইতালির ‘রিসার্চ ইন্সটিটিউট ফর নিউরোসায়েন্স, এডুকেশন অ্যান্ড ডিড্যাকটিক্স’-এর স্নায়ুবিজ্ঞানী ডা. টাল ডটান বেন-সোসান ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “প্রত্যেক ব্যক্তি নীরবতার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা জড়িত রাখেন। কেউ যদি ছোটবেলায় শাস্তির অংশ হিসেবে চুপ করে বসে থাকতে বাধ্য হতেন, তাহলে তার কাছে নীরবতা মানেই মানসিক চাপ।”
অন্যদিকে, কেউ যদি ছোটবেলায় নীরব পরিবেশে খেলার আনন্দ পান, তাহলে তার কাছে নীরবতা হবে এক ধরনের আরাম।
যুক্তরাজ্যের ডারম বিশ্ববিদ্যালয়-এর মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. থুই-ভি টি উয়েন বলেন, “নীরবতা চিন্তাভাবনাকে সামনে নিয়ে আসে। যারা নিজেদের চিন্তার সঙ্গে একা সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাদের জন্য নীরবতা আরামদায়ক। তবে যাদের মানসিক উত্তেজনা বা দুশ্চিন্তা বেশি, তাদের ক্ষেত্রে নীরবতা উল্টো অস্বস্তিকর হতে পারে।”
অতিরিক্ত শব্দের ক্ষতি কী হতে পারে?
জার্মানির ‘ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স’-এর মনোবিদ ও নীরবতা-বিষয়ক গবেষক ডা. এরিক ফাইফার বলেন, “নিয়মিত বিরতিতে নীরবতা চর্চা মানসিক সুস্থতার জন্য ভালো। যারা ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি)’ বা মনোযোগের ঘাটতি ও অতিসক্রিয়তাজনিত সমস্যা-তে ভোগেন, তারা শব্দের মধ্যে স্বস্তি পান। তবে বাকিদের জন্য দিনভর শব্দে মস্তিষ্ক অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, “অবিরাম শব্দময় পরিবেশ, যেমন- গাড়ির হর্ন, সাইরেন, কিংবা উচ্চ শব্দে চলা টিভি মন ও শরীরের ওপর চাপ ফেলে।”
“গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে মাত্র ৬.৫ মিনিট নীরবতা শরীরকে শান্ত করে, হৃদস্পন্দন কমায় এবং মন ভালো করে দেয়। যদি এই নিরবতা প্রকৃতির মাঝে কাটানো যায়, তবে এর প্রভাব আরও গভীর হয়”- বলেন এই গবেষক।
তাহলে নীরবতা উপভোগের উপায় কী?
যারা নীরবতায় অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এটি শুরুতে অস্বস্তিকর লাগতেই পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা কিছু উপায় দিয়েছেন, যেগুলো অনুসরণ করলে ধীরে ধীরে নীরবতার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হবে—
ভালো কোনো নীরব স্মৃতি স্মরণ
জীবনে এমন কোনো মুহূর্ত মনে করতে হবে, যখন নীরব পরিবেশে শান্তি অনুভব করেছিলেন। সেটা হতে পারে কোনো গ্রামের বাড়ির সন্ধ্যা, কিংবা একা ছাদে বসে চায়ের কাপ হাতে থাকা কোনো মুহূর্ত।
সেই অনুভূতিগুলো মনে করে লিখে রাখা যায় কিংবা নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়। এতে নীরবতা ইতিবাচক হয়ে উঠবে।
ছোট থেকে শুরু
যদি হাঁটার সময় ‘পডকাস্ট’ শুনে থাকেন, তাহলে হাঁটার শুরুতে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের জন্য ‘পডকাস্ট’ বন্ধ রাখুন। ধীরে ধীরে সময়টা বাড়ান।
তবে শিশু পরিবারে থাকলে হয়ত পুরো নীরবতা পাওয়া কঠিন।
আর ‘ব্যাকগ্রাউন্ডে’ চলা টিভির আওয়াজ একটু কমিয়ে দিন, অথবা শিশুদের নিয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য বাইরে হাঁটতে যান। এমনকি চুপচাপ চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসাও হতে পারে নীরবতার শুরু।
অভ্যাসভিত্তিক স্থান বদলান
মনোবিজ্ঞানী ডা. উয়েন বলেন, “কোন জায়গায় কী অভ্যাস করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- যদি সোফায় বসে সবসময় ফোন ঘাঁটেন, তাহলে নীরবতার জন্য অন্য কোনো স্থান বেছে নিন। হতে পারে সেটা বারান্দা বা ছাদ। এতে মানসিকভাবে নতুন একটি পরিবেশ তৈরি হবে।”
চিন্তা করুন কেমন অনুভব করলেন
নীরবতা চর্চার পর দুয়েক মিনিট সময় নিয়ে ভাবুন কেমন লাগলো? মন কি শান্ত হল? বিরক্ত লাগল? ভালো লাগলে সেই অনুভূতিকে মনে রাখুন। এতে পরেরবার নীরবতায় আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হবে।
সবাইকে এক নিয়মে না মাপা
নীরবতা সবার জন্য একরকম উপকারী হবে, এমন নয়। কেউ কেউ মানসিক সমস্যার কারণে নীরবতা সহ্য করতে পারেন না।
সেক্ষেত্রে জার্মানির মনোবিজ্ঞানী ডা. ফাইফার বলেন, “থেরাপির অংশ হিসেবে ধীরে ধীরে যে নীরবতার ধরন সবচেয়ে কার্যকর, তা খুঁজে বের করা যেতে পারে।”
নীরবতা মানেই একাকিত্ব নয়
অনেকেই নীরবতার সঙ্গে একাকিত্বের মিল খুঁজে পান। তবে সেটা ঠিক নয়। নীরবতা মানে নিজের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, নিজেকে জানছেন, নিজের ভেতরের চিন্তাগুলো শুনছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নীরবতা শুধু স্বাস্থ্যকরই নয়, এটি হতে পারে দিনের সবচেয়ে বিলাসবহুল সময়। তবে সেটা প্রকৃতির মাঝে নাকি কফির কাপে চুমুক দিয়ে হবে- সেটা সম্পূর্ণ-ই নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে।
মোট কথা হল— নীরবতা উপভোগ করার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যেভাবে স্বস্তি পাওয়া যাবে, সেভাবেই ধীরে ধীরে চর্চা করতে হবে।
আরও পড়ুন