বর্ষামুখর দিন শেষে, ঊর্ধ্বপানে চেয়ে যখন আষাঢ়ে গল্প শোনাতে বসে ওসমান ভূঁইঞা...
Published : 11 Jul 2023, 12:37 PM
অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।
ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এ জন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের অর্থের গল্প।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘কালরাত’, ‘কালো রাত’ নয়। বলা এবং লেখার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ‘কালরাত’ একত্রে বলতে এবং লিখতে হবে। আলাদা করে বললে বা লিখলে ভিন্ন অর্থ বোঝাবে। চলো তবে এ বিষয়টি আভিধানিকভাবে জেনে নিই।
সংস্কৃত ‘কাল’ এবং বাংলা ‘রাত’ শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে ‘কালরাত’ শব্দটি। এটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ মহাবিপদের আশঙ্কাযুক্ত রাত্রি, অশুভ রাত, অমঙ্গলজনক রাত। তবে ‘কাল’ শব্দটি বিশেষণ পদ। এর অর্থ অশুভ, অমঙ্গল, বিপদের শঙ্কাযুক্ত। যেমন: ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে গণহত্যার সূত্রপাত করে।’ এমন আরও শব্দের উদাহরণ হলো: কালবেলা, কালবৈশাখী, কালমেঘ ও কালসাপ প্রভৃতি।
বাংলা ‘কালো’ এবং ‘রাত’ শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে ‘কালো রাত’ শব্দটি। এটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ অন্ধকার রাত বা কৃষ্ণরাত। সুতরাং সব রাতই ‘কালো রাত’, কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত বাঙালির ইতিহাসে গণহত্যার ‘কালরাত’।
‘কৃতী’ ও ‘কৃতি’ শব্দদ্বয় একই উচ্চারণবিশিষ্ট দুটি ভিন্ন অর্থজ্ঞাপক শব্দ। এ বানানদুটো ব্যবহার এবং এর সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহারে প্রায়ই আমরা ভুল প্রয়োগ করি। বিশেষ করে ‘কৃতী’ অর্থজ্ঞাপনে ‘কৃতি’ শব্দের ব্যবহার সর্বত্র একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। তবে চলো জেনে নেওয়া যাক এর অর্থ, পদপরিচয়, ব্যুৎপত্তি, অর্থপার্থক্য ও সমাসবদ্ধ শব্দে এর বানান কেমন হবে।
‘কৃতী’ সংস্কৃত শব্দ। বিশেষণ পদ। এর ব্যুৎপত্তি [কৃত+ইন্]। এর আভিধানিক অর্থ কাজে সফলতা লাভ করেছে এমন, কৃতকার্য, কর্মকুশল বা কর্মদক্ষ, নিপুণ, পণ্ডিত, মান্যবর প্রভৃতি। প্রয়োগ: ‘কৃতী ব্যক্তি’, ‘কৃতী লেখক’। পাশাপাশি আরেকটি নিয়মও জেনে রাখা দরকার, তা হলো সংস্কৃত ইন্ প্রত্যয়ান্ত শব্দের ঈ-কারান্ত রূপ সমাসবদ্ধ হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোতে ই/ঈ কার উভয়ই ব্যবহার করা যাবে। সুতরাং এ বিধি অনুসারে ‘কৃতীমুখ’ ও ‘কৃতিমুখ’ এবং ‘কৃতীজন’ ও ‘কৃতিজন’ উভয়ই শুদ্ধ শব্দ। তবে একইপাঠে একরকম বানান রাখাই সমীচীন। নতুবা পাঠকের কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে।
‘কৃতি’ সংস্কৃত শব্দ। বিশেষ্য পদ। এর আভিধানিক অর্থ সম্পাদিত কাজ, নির্মিত বস্তু, নির্মাণ, যত্ন, সাধনা, চেষ্টা প্রভৃতি। প্রয়োগ: ‘কৃতিস্বত্ব’, ‘কবিকৃতি’, ‘কলাকৃতি’, ‘সাহিত্যকৃতি’, ‘প্রতিকৃতি’ প্রভৃতি। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কৃতিজনের গুণাবলি প্রকাশে ‘কৃতী’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। আর ব্যক্তি যে কর্ম সম্পাদিত করে প্রশংসনীয় হয় তা ওই ব্যক্তির ‘কৃতি’। সুতরাং পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে যথাযথ শব্দের অর্থ জেনে ব্যবহার করতে হবে। ‘কৃতী’ স্থলে ‘কৃতি’ শব্দের ব্যবহার থেকে অবশ্যই বিরত থেকো।
আমরা সবাই জানি, বাংলা ভাষায় মোট বর্ণমালা ৫০টি। স্বরবর্ণ ১১টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি। সহজ ভাষায় প্যানগ্রাম বা শুক্তিবাক্য হলো এমন একটি বাক্য যেখানে একটি বাক্যে পুরো বাংলা বর্ণমালার ৫০টি বর্ণ অন্তত একবার থাকবে। অর্থাৎ বর্ণমালার সবগুলো বর্ণ ন্যূনতম একবার ব্যবহার করে বাক্য গঠনের উপায়কে প্যানগ্রাম বা শুক্তিবাক্য বলে। অনুরূপভাবে ইংরেজি বর্ণমালার বেলাতেও সর্বমোট ২৬টি বর্ণ ব্যবহার করে ইংরেজি প্যানগ্রাম তৈরি করা যায়। দুটো বাংলা প্যানগ্রাম বা শুক্তিবাক্য নিচে দেওয়া হলো:
১. বর্ষামুখর দিন শেষে, ঊর্ধ্বপানে চেয়ে যখন আষাঢ়ে গল্প শোনাতে বসে ওসমান ভূঁইঞা, ঈষাণ কোণে তখন অন্ধকার মেঘের আড়ম্বর, সবুজে ঋদ্ধ বনভূমির নির্জনতা চিরে থেকে থেকে ঐরাবতের ডাক, মাটির উপর শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ঔদাসীন্যে, এবং তারই ফাঁকে জমে থাকা ঢের পুরোনো গভীর দুঃখ হঠাৎ যেন বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে ধূসর জীবনে রঙধনু এনে দেয়।
২. উনিশে কার্তিক রাত্র সাড়ে আট ঘটিকায় ভৈরব নিবাসী ব্যাংকের ক্ষুদ্র-ঋণগ্রস্ত অভাবী দুঃস্থ প্রৌঢ় কৃষক এজাজ মিঞা হাতের কাছে ঔষধ থাকিতেও ঐ ঋণের ডরেই চোখে ঝাপসা দেখিয়া বুকের যন্ত্রণায় ঈষৎ ঊর্ধ্বে কাঁপিয়া উঠিয়া উঠানে বিছানো ধূসর রঙের ফরাশের উপর ঢলিয়া পড়িলেন।
ইংরেজি প্যানগ্রামের উদাহরণ: The quick brown fox jumps over the lazy dog.
কী! বিষয়টি মজার না! তোমরা এবার নিজেরা বাংলা ও ইংরেজি প্যানগ্রাম তৈরি করে বিষয়টি নিজেদের মধ্যে চর্চা করতে পারো।
পরীক্ষায় ৮০ নম্বর পেলে আগে বলা হতো ওই বিষয়ে সে লেটার মার্ক পেয়েছে। কিন্তু কেন বলা হতো? যদিও এখন আর বলা হয় না। কেননা ২০০১ সালের এসএসসি এবং ২০০৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষা থেকে গ্রেডিং সিস্টেম চালু করা হয়। এ পদ্ধতিতে যদিও এ+ (এ প্লাস) বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কথা হলো আগেই বা লেটার মার্ক কেন বলা হতো? এর কারণ কী? লেটার (Letter) শব্দটির সঙ্গে এর যোগসূত্র কোথায়? কখনো কি তোমাদের এ বিষয়টি নিয়ে কোনো ভাবনা তৈরি হয়েছে? চলো তবে এর রহস্য ভেদ করি।
যে কোনো একটি বিষয়ে পূর্ণ ১০০ নম্বরের মধ্যে কেউ যদি ৮০ নম্বর পেত, তবে বলা হতো সে ওই বিষয়ে লেটার পেয়েছে। এ বিষয়টিকে অন্যকিছু না বলে লেটার বলার কারণ হলো অক্ষরের অবস্থানগত সংখ্যা। অর্থাৎ A=১, B=২, C=৩... এমন করে Z=২৬। এবার খেয়াল করো লেটার শব্দে যে অক্ষরগুলো আছে, এর অবস্থানগত সংখ্যাগুলোর যোগফল কত হয়। এবার দেখো নিচে-
L=১২
E=৫
T=২০
T=২০
E=৫
R=১৮
সুতরাং ১২+৫+২০+২০+৫+১৮=৮০। এ কারণেই ৮০ নম্বর প্রাপ্তিকে ইংরেজিতে লেটার মার্ক বলা হতো। কী! মজার না!