বই: ময়ূরাক্ষী, ধরন: হিমু ধারাবাহিকের প্রথম উপন্যাস, লেখক: হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ - ১৯ জুলাই ২০১২), প্রকাশক: অনন্যা পাবলিকেশন, প্রথম প্রকাশ: ১৯৯০
Published : 13 Nov 2022, 01:28 AM
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের তৈরি এক ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র ‘হিমু’। যার পুরো নাম হিমালয়, যাকে তার বাবা হিমালয় পর্বতের মতো বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন।
এভাবে বড় করতে গিয়ে হিমুর বাবা হিমুকে দিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তারপর একসময় তিনি মারা যান, হিমু থাকতে শুরু করে তার মামাদের সঙ্গে।
মামা তিনজনই ভয়ংকর রকম খারাপ মানুষ। তারপর একসময় হিমু শহরে চলে আসে। পকেটছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি পরে সারারাত জেগে শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে থাকে। এভাবে সে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়। হিমু নিজেও তার বাবার মতো নিজেকে নিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তার ইনট্যুইশন ক্ষমতা খুব প্রখর।
এভাবে হিমুর গল্প এগোয়। তখন ‘হিমু’ বাংলাদেশের কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এক চরিত্র ছিলো। একটা প্রজন্ম হিমুর অনুকরণে পড়াশোনা মাথায় তুলে হলুদ পাঞ্জাবি পরে সত্যি সত্যি রাস্তায় ঘোরাফেরা শুরু করে।
এ মায়া কাটানোর জন্য যখনই হিমুর কোন কিছুর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে তার বাবা সেটাই ধ্বংস করে ফেলেছেন। শৈশবে একবার একটা খেলনা হিমুর খুব পছন্দ হলে সেটা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলেন। একটা লাল ঠোঁটের সবুজ টিয়াপাখির গলা টিপে হত্যা করেন।
হিমুকে মহামানব বানানোর স্বপ্ন নিয়ে হিমুর বাবা তার নিজের কিছু বাণী চামড়ায় বাঁধানো তিনশ একুশ পৃষ্ঠার একটা খাতায় মুক্তোর মতো গোটা গোটা হরফে লিখে গিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি মাত্র আঠারো পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখতে পেরেছিলেন। তারপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যেমন, উপদেশ নম্বর এগারো- ‘সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান’। এ অনুচ্ছেদে লেখা ছিলো, ‘সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান করিবে। ইহাতে আত্মার উন্নতি হইবে। সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং আত্মাকে জানা একই ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিও - বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?’
হিমুর বাবার একটা উপদেশের শিরোনাম হচ্ছে- ‘নির্লিপ্ততা’। তিনি লিখেছেন, ‘পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ এবং মহাজ্ঞানীরা এই জগৎকে মায়া বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র চিন্তা ও ক্ষুদ্র বিবেচনায় দেখিয়াছি আসলেই মায়া। স্বামী ও স্ত্রীর প্রেম যেমন মায়া বই কিছুই নয়, ভ্রাতা ও ভগ্নির স্নেহ-সম্পর্কও তাই। যে-কারণে স্বার্থে আঘাত লাগিবামাত্র স্বামী-স্ত্রীর প্রেম বা ভ্রাতা-ভগ্নির ভালোবাসা কর্পূরের মতো উড়িয়া যায়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে নির্লিপ্ত হইতে হইবে। কোনকিছুর প্রতিই তুমি যেমন আগ্রহ বোধ করিবে না আবার অনাগ্রহও বোধ করিবে না। মানুষ মায়ার দাস।’
এ মায়া কাটানোর জন্য যখনই হিমুর কোন কিছুর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে তার বাবা সেটাই ধ্বংস করে ফেলেছেন। শৈশবে একবার একটা খেলনা হিমুর খুব পছন্দ হলে সেটা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলেন। একটা লাল ঠোঁটের সবুজ টিয়াপাখির গলা টিপে হত্যা করেন। তারপর হিমুকে বলেন, ‘মন খারাপ করবি না। মৃত্যু হচ্ছে এ জগতের আদি সত্য।’
হিমুকে তার বাবা পড়াশোনাও করিয়েছিলেন, অবশ্য সেটা কোন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিলো না। তার বাবার কাছেই হিমু পড়েছিল ইংরেজি, বাংলা, গণিত, ভূগোল আর নীতিশাস্ত্র। নীতিশাস্ত্র বলতে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এসব। মিথ্যা বলা খারাপ, কিন্তু আনন্দের জন্য মিথ্যা বলায় অন্যায় নেই। মিথ্যা দিয়েই সত্যকে চিনতে পারা যায়। যেমন গল্প, উপন্যাস এসব মিথ্যা। কিন্তু এসব মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে চিনতে পারি। ইংরেজি এবং বাংলার জ্ঞানও এতো গভীর ছিলো যে ছোট বয়সেই হিমু জানতো অমাবস্যার ইংরেজি নিউমুন, মৃন্ময় শব্দের অর্থ মাটির তৈরি।
হিমুর নামকরণ বিষয়েও তার বাবার ছিলো নিজস্ব মতামত। নদীর নামে, ফুলের নামে, গাছের নামে মানুষের নাম হতে পারলে হিমালয় কেন নাম হতে পারবে না! আর হিমালয় নামকরণের কারণ যাতে ছেলের হৃদয় হিমালয়ের মতো বড় হয়। কিন্তু আকাশ রাখেননি, কারণ আকাশ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু হিমালয়কে স্পর্শ করা যায়। ষোল বছর পর যদি হিমু মনে করে তার বাবার সিদ্ধান্ত ভুল, তখন সে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
তারপর মানুষের সৎগুণ সম্পর্কে হিমুকে ধারণা দেওয়ার জন্য তার মৃত্যুর পর মামাদের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে যান, কারণ মামারা ছিল পিশাচ শ্রেণির। তারপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে তিনি বলেন, ‘শোন হিমু, কোনরকম উচ্চাশা রাখবি না। টাকাপয়সা করতে হবে, বড় হতে হবে, এসব নিয়ে মোটেও ভাববি না। সমস্ত কষ্টের মূলে আছে উচ্চাশা।’
যখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একজন তরুণী ছুটে চলে। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। এ তরুণীটি আমার মা, আমার বাবা যাকে হত্যা করেছিলেন।
এভাবে বড় হতে হতে হিমুর মধ্যে একটা স্বকীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। তার ভাষায়, ‘আমি মহাপুরুষ নই। কিন্তু এই ভূমিকায় অভিনয় করতে আমার বড় ভালো লাগে।...আমার মতে মহাপুরুষ হচ্ছে এমন একজন যাকে পৃথিবীর কোন মালিন্য স্পর্শ করেনি। এমন কেউ কি সত্যি সত্যি জন্মেছে এই পৃথিবীতে?...আমি ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলি। অসহায় মানুষদের দুঃখকষ্ট আমাকে মোটেই অভিভূত করে না।...কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় কাউকে দগ্ধ করার আনন্দের কাছে সব আনন্দই ফিকে।...মহাপুরুষরা আজীবন চিরকুমার থাকেন। বিয়ে করার পর যারা মহাপুরুষ হন তারা স্ত্রী-সংসার ছেড়ে চলে যান। যেমন বুদ্ধদেব।’
হিমুর বাবা হাতে-কলমে হিমুকে মহাপুরুষের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। যেমন তার একটা উপদেশ এমন, ‘যখনই সময় পাবি ছাদে এসে আকাশের তারার দিকে তাকাবি, এতে মন বড় হবে। মনটাকে বড় করতে হবে। ক্ষুদ্র শরীরে আকাশের মতো বিশাল মন ধারণ করতে হবে।...শুধু হৃদয় বড় হলেই চলবে না, তোকে বুদ্ধিমানও হতে হবে। তোর জ্ঞান এবং বুদ্ধি হবে প্রেরিত পুরুষদের মতো।’ হিমুকে নিয়ে তার বাবার মনে অনেক স্বপ্ন ছিলো। সেটা বোঝা যায় তার এ কথায়, ‘তোর ওপর আমার অনেক আশা। অনেক আশা নিয়ে তোকে বড় করছি। তোর মা বেঁচে না থাকায় সুবিধা হয়েছে। ও বেঁচে থাকলে আদর দিয়ে তোকে নষ্ট করতো।’
হিমু তার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য সারাদিন পথে পথে ঘুরে। মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করে। যখন খুব ক্লান্ত অনুভব করে তখন একটা নদীর স্বপ্ন দেখে। অনেকটা অবাস্তব মনে হলেও হিমুর জীবনে কাকতালীয় ঘটনার সমাবেশ অনেক বেশি। এ নদী আবিষ্কারের ঘটনাটাও কাকতালীয়। ক্লাস সিক্সে মফিজ স্যার তাদের জিওগ্রাফি পড়াতেন। একদিন ক্লাসে এসেই হিমুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই একটা নদীর নাম বল তো! চট করে বল!’ তার উত্তরে হিমু বলেছিল, ‘আড়িয়াল খাঁ’। স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর পড়ানো শেষ করে স্যারের মন খারাপ হয় এবং তখন বলেন, ‘আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম।’ তারপর হিমু হঠাৎই বলে বসে সেই নদীর নাম ‘ময়ূরাক্ষী’।
মফিজ স্যার যেদিন মারা যান সেদিন রাতেই প্রথম ময়ূরাক্ষীকে স্বপ্নে দেখে হিমু। হিমুর ভাষায়, ‘ছোট একটা নদী। তার পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। নিচের বালিগুলি পর্যন্ত দেখা যায়। নদীর দুধারে দুর্বাঘাসগুলি কী সবুজ! কী কোমল! নদীর ঐ পাড়ে বিশাল ছায়াময় একটা পাকুড় গাছ। সেই গাছে বিষণ্ন গলায় একটা ঘুঘু ডাকছে। সেই ডাকে এক ধরনের কান্না মিশে আছে।…নদীর ধার ঘেঁষে পানি ছিটাতে ছিটাতে ডোরাকাটা সবুজ শাড়ি পরা একটা মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমি শুধু তার মুখটা দেখতে পেলাম। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে খুব চেনা, খুব আপন মনে হলো। যেন কত দীর্ঘ শতাব্দী এই মেয়েটার সঙ্গে কাটিয়েছি।’
এ নদীর প্রসঙ্গে হিমুর মনে পড়ে তার মায়ের কথা। এ নদীর কোমল স্পর্শ যেন তাদের মায়ের আঁচলের শীতল পরশ। হিমুর ভাষায়, ‘আমার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য সারাদিন আমি পথে পথে ঘুরি। মহাপুরুষ হবার সাধনা করি। যখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একজন তরুণী ছুটে চলে যায়। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। এই তরুণীটি আমার মা, আমার বাবা যাকে হত্যা করেছিলেন।’
এমনসব পরিবেশে বেড়ে উঠতে উঠতে হিমু হয়ে যায় অন্য মানুষ। সেই মানুষকে আসলে কোনভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। হিমু বলে, ‘আমাকে তো আর-দশটা সাধারণ ছেলের মতো হলে চলবে না। আমাকে হতে হবে অসাধারণ। আমি সারাদিন হাঁটি। আমার পথ শেষ হয় না।’
এ উপন্যাসের শেষ লাইনটা আমাদের জীবনবোধের জায়গায় নাড়া দেয়। যার তলায় ধ্যান করে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতম বোধিলাভ করে বুদ্ধ হয়েছিলেন, সেই বোধিবৃক্ষের একটি পাতা যেন উড়ে এসে হাতের তালুতে পড়ে। মানুষের জীবন তো আসলে একটা অনির্দিষ্ট যাত্রা। কোথা থেকে শুরু আর কোথায়ই বা শেষ হবে তার উত্তর খুঁজে বেড়ানোর মধ্যেই জীবনের গূঢ় অর্থ। কিন্তু সবাই কি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়? হয়তোবা দুয়েকজন পায়, কিন্তু তারা তখন আর সাধারণ মানুষ থাকেন না। হয়ে উঠেন অসাধারণ। হিমু বলে, ‘গন্তব্যহীন গন্তব্যে যে যাত্রা তার কোন শেষ থাকার তো কথাও নয়।’
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!