রাত পেরিয়ে দিন আসে, দিন পেরিয়ে রাত। পূর্ব দিগন্তে চিকচিক করে জেগে উঠা গোলাকার বৃত্তটি পশ্চিমে অদৃশ্য হলে বলি সন্ধ্যা। ঠিক এমনই এক সন্ধ্যায় প্রায় পাঁচ বছর আগে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে পাহাড়-জঙ্গল মাড়িয়ে সীমান্তের কাঁটাতার ডিঙিয়ে অন্য সবার সঙ্গে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল রশিদা, নূর তাজ ও আসমন তারা।
দেখতে দেখতে নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তায় কেটে গেছে গুণে গুণে পাঁচটি বছর। নিজ দেশ মিয়ানমারে অস্থির এক পরিস্থিতির কবলে পড়ে যখন অজানা এক গন্তব্যে পা বাড়াচ্ছিল বড়রা, তখন ছোট্ট মীনা-রাজুরা তাদের জিজ্ঞেস করতে পারেনি কোথায় যাবে? বড়রা শুধু এটুকু বলেছিল, ‘প্রাণ বাঁচাতে হলে এই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে’।
অর্ধাহার আর অনাহারে রোহিঙ্গা মীনা-রাজুদের সেই ছুটে চলা একসময় এসে থেমে গিয়েছিল এদেশের কক্সবাজারে উখিয়ার জঙ্গলবেষ্টিত পাহাড়ে। পরে যেখানে গড়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির 'রোহিঙ্গা ক্যাম্প।'
বলছি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশু রশিদা, নূর তাজ, আসমন তারার কথা। তখন দুপুর দুটোর কাছাকাছি। উখিয়ায় জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত একটি লার্নিং সেন্টার সবে তাদের প্রথম ব্যাচ ছুটি দিয়েছে। মিনিট বিশেকের বিরতিতে দ্বিতীয় ব্যাচ আসতে শুরু করেছে। রশিদা, নূর তাজ, আসমন তারা বয়সের ফারাকে একটু এদিক-সেদিক হলেও পড়ে দ্বিতীয় ব্যাচে একই লার্নিং সেন্টারে।
একটু আশ্চর্য হয়ে আসমন তারা পাল্টা জানতে চাইলো, 'মীনা রাজু, এটা আবার কী!' আমি বললাম, 'মীনা রাজু হলো তোমাদের মতোই কার্টুন শিশু যারা সবসময় সমাজে আলোর পথ দেখায়’।
একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করার সুবাদে আমার প্রতিনিয়ত সুযোগ হয় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের মনের সহজ-সরল অনুভূতিগুলো জানার। গল্পের ছলে জানতে চেষ্টা করি সেই অনুভূতি। রশিদা আর নূর তাজ খুব সাবলীল কথা বললেও আসমন তারার চোখে-মুখে ছিল লজ্জার ছাপ। তারা তিনজনই একসঙ্গে থাকে, খেলাধুলাও করে একসঙ্গে।
যখন দেশ চেনার আগে দেশান্তরিত হতে হয়েছিল তাদের, তখন এই মীনাদের বয়স ছিল অনেক কম। তাই মিয়ানমারের স্মৃতি বলতে তেমন কিছু নেই তাদের মানসপটে। তবে তারা মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকার অধিবাসী হলেও মিলিত হয়েছে এখানে এসে। এখন তাদের পরিচয় একটাই 'রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশু’।
রশিদার কাছ থেকে জানতে চাইলাম, ‘পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’ একটু লজ্জামাখা কণ্ঠস্বরে সে বলল, 'ভালো হচ্ছে’। এবার তিনজনকে জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশোনার বাইরে আর কী কী করো? সবাই একসাথে বললো, 'খেলাধুলা করি। ঘরের কাজে মা-বাবাকে সহায়তা করি’।
রোহিঙ্গা মেয়েশিশুরা চাকতি বা ঢেলা দিয়ে আমাদের দেশের হাডুডু খেলার মতো খেলতে খুব পছন্দ করে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার রেশন সংগ্রহ করার কাজেও পরিবারকে সহায়তা করে বলে জানালো তারা। জিজ্ঞেস করলাম, মীনা-রাজুকে চেনে কিনা! একটু আশ্চর্য হয়ে আসমন তারা পাল্টা জানতে চাইলো, 'মীনা রাজু, এটা আবার কী!' আমি বললাম, 'মীনা রাজু হলো তোমাদের মতোই কার্টুন শিশু যারা সবসময় সমাজে আলোর পথ দেখায়’।
মিঠুর কথা শুনে তারা খুব মজা পেলো। সেইসঙ্গে মীনা-রাজুকে চেনে না বলে একটু হতাশাও ঝরে পড়ল তাদের কণ্ঠে। ক্যাম্পে ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে। তখনও দুপুরের আকাশ কুয়াশায় ছেয়ে আছে, বেশ ঠান্ডা।
বিপ্রদাশ বড়ুয়া মংডু ভ্রমণ কাহিনিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শহরটির অপরূপ সৌন্দর্য। দিয়েছিলেন মংডুর অধিবাসীদের খাবার-দাবার, পোশাক-আশাকের বিচিত্র সব বর্ণনা।
পাহাড়ের পাদদেশে সাবধানে পা ফেলে হাঁটছি। ত্রিশ-চল্লিশ ফুট নিচ থেকে শিস দিতে দিতে উপরে উঠে আসছে কয়েকজন শিশু। থমকে দাঁড়ালাম। তারাও লার্নিং সেন্টার থেকে আসছে। কাছে গিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। একজনের নাম মো. কাসিম, দ্বিতীয়জনের নাম হোছাইন আহম্মেদ, সবার চেয়ে ছোটজনের নাম হামিদ উল্লা।
হামিদকে জিজ্ঞেস করি, বাড়ি কোথায়? হামিদ উল্লার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর ধুমছে পাড়ায়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাংলা বইয়ে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘মংডুর পথে' প্রবন্ধ থেকে প্রথম জানতে পারি মিয়ানমারের মংডু সম্পর্কে। মংডু মিয়ানমারের পশ্চিমে রাখাইন রাজ্যের একটি সীমান্ত শহর। টেকনাফের নাফ নদীর ওপারে অবস্থিত রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসবাস সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম বিশেষ করে কক্সবাজারের সঙ্গে ওই রাজ্যটির যোগাযোগ অনেক আগে থেকেই।
বিপ্রদাশ বড়ুয়া মংডু ভ্রমণ কাহিনিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শহরটির অপরূপ সৌন্দর্য। দিয়েছিলেন মংডুর অধিবাসীদের খাবার-দাবার, পোশাক-আশাকের বিচিত্র সব বর্ণনা। মরিচ পোড়া আর তেঁতুলের টক, কলার থোড় দিয়ে নুডলস পরিবেশনের বর্ণনা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। পুরনো শহরের কথা আবারও নতুন করে শোনার আগ্রহ জাগল আমার মনে।
হামিদ উল্লার বয়স এখন দশ। তারা এদেশে এসেছে প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। তাই ওপারের কথা খুব একটা মনে নেই তার। কাসিমের কাছে জিজ্ঞেস করি। তার বাড়িও মংডু শহরে, তবে প্রাইংসেং এলাকায়। কাসিমের বয়স তেরো। তার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল প্রাইংসেং-এ ফেলে আসা স্মৃতিগুলো।
কাসিমের বাড়িটি ছিল কাঠের দোতলার। তার মতে, বাড়িটা ইট-পাথরের বাড়ির চেয়ে মজবুত ছিল। রোজ সকালে পাড়ার ছেলেরা দলবেঁধে মক্তবে পড়তে যেতো। পড়া শেষ করে দলবেঁধে শুরু হতো ছোটাছুটি। কখনও সবুজক্ষেতের আইল মাড়িয়ে মাছ ধরত। আবার কখনও মাঠের ধুলোবালি গায়ে মেখে পুকুরে ঝাঁপিয়ে স্নান করত। কমতি ছিল না ফুল-ফলেরও। আমের সময় আম, লিচুর সময় লিচু।
কিন্তু এখন ওসব অতীত। কথার ফাঁকে যোগ দিল হোছাইন আহম্মেদ। তারা চার ভাইবোন। হোছাইনের বাড়ি আবার বুথিডং শহরের গুদাম পাড়ায়। বুথিডংও রাখাইন রাজ্যের একটি শহর। তবে বুথিডং শহর নিয়ে খুব একটা জানাশোনা নেই আমার। শুনেছি বুথিডং শহরে অনেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। কাসিমের মতো হোছাইন আহম্মেদেরও স্পষ্ট মনে আছে বুথিডংয়ে ফেলে আসা স্মৃতি। রোজ দলবেঁধে মক্তবে যাওয়া, একসঙ্গে দিঘির স্বচ্ছ পানিতে ঝাঁপ দেওয়া। বাড়ির পাশের পেয়ারা বাগানে গিয়ে ইচ্ছেমতো পেয়ারা খাওয়া। আরও কতরকম তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ওসব নিয়ে কেউ কোনোদিন বারণও করেনি তাকে।
জিজ্ঞেস করলাম, লার্নিং সেন্টারে কী কী বিষয়ের উপর পড়াশোনা করো? হামিদ উল্লা বললো, ‘ইংলিশ, ম্যাথ, বার্মিজ, লাইফ স্কিল’। বললাম, কোন বিষয়টা তোমাদের সবচেয়ে প্রিয়। তিনজনই সমস্বরে বলে উঠল, 'লাইফ স্কিল’।
মিয়ানমারের ভাষায় জাতীয় সঙ্গীতকে ‘কব্যয়া’ বলা হয়। তিনজন সমবেত কণ্ঠে সুর করে গেয়ে উঠল নিজের দেশের কব্যয়া।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের জন্য লাইফ স্কিল হলো মজার একটি বিষয়। এ বিষয়ের মূলকথা হলো প্রথাগত পড়াশোনার বাইরে গিয়ে বাস্তব জ্ঞান পেতে শিশুদের সাহায্য করা। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, সাঁতারের বিস্তারিত কৌশল, দৈনন্দিন চলাফেরায় নিজে কীভাবে সতর্ক ও সংযত থাকবে এমন সব মজার বিষয়বস্তু দিয়ে বইটি সাজানো বলে তাদের সবার এত প্রিয়।
হোছাইন আহম্মেদকে বললাম, লার্নিং সেন্টার ছুটি হওয়ার পর কী করো? পাশ থেকে কাসিম বললো, ‘স্কুলের ব্যাগটি বাসায় রেখে মাঠে চলে যাই’। ফুটবল আর ভলিবল তাদের খুব প্রিয়। জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিকেট খেলো কিনা? হামিদ উল্লা জানালো, ‘ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে এখানে এসে জানতে পেরেছি। তবে কীভাবে খেলতে হয় এটা একটু একটু জানলেও খুব একটা খেলা হয়ে উঠে না ক্যাম্পে’। বুঝতে পারলাম, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের মাঝে এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি ক্রিকেট।
তবে ভলিবল আর ফুটবল খুব জনপ্রিয়। রোহিঙ্গা শিশুদের ভলিবল দেখতে কিন্তু সাধারণ ভলিবলের মতো নয়। প্লাস্টিক দিয়ে বিশেষ কায়দায় মিয়ানমারে তৈরি বলটি ওজনে খুব হালকা। আর এ হালকা বল দিয়ে মূলত তারা খেলে। তাদের অনুরোধ করলাম একটা বর্মী ছড়া শুনাতে। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই মিলে মিয়ানমারের জাতীয় সঙ্গীত গাইবে বলে মনস্থির করলো।
মিয়ানমারের ভাষায় জাতীয় সঙ্গীতকে ‘কব্যয়া’ বলা হয়। তিনজন সমবেত কণ্ঠে সুর করে গেয়ে উঠল নিজের দেশের কব্যয়া। ওপারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুরা নিজেদের সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে এসে আজ আশ্রয় নিয়েছে এদেশে। নিশ্চিত জীবন থেকে অনিশ্চিত গন্তব্যের শুরুতে বেশ কষ্ট হলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মীনা-রাজুরা এখন মানিয়ে নিতে শিখেছে। ধীরে ধীরে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়তে মনোনিবেশ করেছে। যে পৃথিবীতে তারা পড়ালেখা শিখবে, আনন্দ নিয়ে খেলবে, রঙিন সব স্বপ্ন দেখবে, আর সেই স্বপ্নের ডানায় ভর করে হয়তো একদিন ফিরে যাবে নিজের জন্মভূমিতে।
পাহাড় ঘিরে কুণ্ডুলী পাকিয়ে কুয়াশা ছেয়ে আছে। হাওয়ায় গায়ের চাদরটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলাম নিজের শরীরে। বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা মীনা-রাজুদের বিদায় জানিয়ে পা বাড়ালাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!