নজরুল তার স্ত্রী নার্গিসকে এক চিঠিতে লিখেছেন, 'তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি’।
Published : 27 Aug 2022, 01:29 AM
ফুল ফুটিয়ে বাহারি সৌরভ ও রঙে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য জানান দেয়। ফুল থেকেই আমরা কোমলতার ধারণা পাই।
ফুল নেই- পৃথিবীর কোন কবির এমন কোন কবিতা-সমগ্র পাওয়া যাবে না মনে হয়। তবে কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনাবলী যেন আস্ত ফুলবাগান। তার যে কোন পৃষ্ঠা উল্টোলেই নানা ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে।
‘বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি যূথী বেলি’, অথবা ‘সাত ভাই চম্পা জাগোরে, কেন বোন পারুল ডাকোরে’ গান দুটি নিশ্চয়ই তোমরা শুনে থাকবে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। নজরুলের এরকম অসংখ্য গান নাম জানা বা না-জানা ফুল-ফলে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে রচিত হয়েছে। ‘শাল-পিয়ালের বনে’ গীতিনাট্যের গানে ঝিঙে ফুল নিয়ে কবি বলেছেন, ‘হলুদ বরণ ঝিঙে ফুলের কাছে, দেখনা কেমন দুটি ফিঙে নাচে’।
কেবল একটি ফুল দিয়ে যেমন মালা গাঁথা যায় না, তেমনই এক ফুল দিয়ে বাগানও হয় না। নজরুলের সাহিত্য যেন পুরো ফুলের মালা কিংবা ফুলের উদ্যান।
নজরুলের স্ত্রী নার্গিস তার কবিতায় কখনও প্রিয়তমা, কখনও ফুল হিসেবে এসেছে। নজরুল গেয়েছেন, ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে, ঝরা বন-গোলাপের বিলাপ শোনে’। মোঘলদের হাত-ধরে আসা নার্গিস ফুল পৃথিবীজুড়ে নার্সিসাস নামেই বেশি পরিচিত। নার্গিসকে লেখা এক চিঠিতে নজরুল বলছেন, 'তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি’।
কেবল একটি ফুল দিয়ে যেমন মালা গাঁথা যায় না, তেমনই এক ফুল দিয়ে বাগানও হয় না। নজরুলের সাহিত্য যেন পুরো ফুলের মালা কিংবা ফুলের উদ্যান। নজরুল-সাহিত্য ও সঙ্গীতে যেসব ফুলের নাম ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কামিনি, বেলী, সোনালু, বনদেবী, চৈতালি-চাঁপা, গিরিমল্লিকা, কুন্দ, কাশ, দোলনচাঁপা, ফণীমনসা, রাঙা-জবা, শিউলি, সজনে, পদ্ম, শাপলা, শতদল, বাঁশ, সরিষা, কমল, গোলাপ, আম মুকুল, চন্দ্রমল্লিকা, মঞ্জরী, মালতী, ঢোলকলমী, পারিজাত, পারুল, ধুতুরা, সন্ধ্যামালতী, সন্ধ্যামণি, সোঁদাল, রঙন, সূর্যমুখী, শিরীষ, গাঁদা, কদম, মাধবী, মহুয়া, কেয়া বা কেতকী, বকুল, দোপাটি, কনকচাঁপা, শিরীন, চন্দ্রাহার, বল্লরী, নাগকেশর, ঝিঙে, অতসী, নয়নতারা, অপরাজিতা, ঝুমকো লতা, অর্জুন, নার্গিস, লালা, রজনীগন্ধ্যা, জামরুল, মহুল, ডালিম, পলাশ কিংবা কিংশুক, রজনীগন্ধ্যা, শিমুল, পিয়াল, টগর, হাসনাহেনা, জুঁই, চাঁপা, মল্লিকা, মোতিয়া, ভুঁই, লোধ, মৌরি, ডুমুর ও কুসুম ইত্যাদি।
ফুল মনকে দেয় প্রশান্তি। কিন্তু সেই ফুল সবসময় পরিষ্কার জায়গায় নাও ফুটতে পারে। আমরা ঝোড়ঝাড়ে অবহেলায় ফুল ফুটে থাকতে দেখি, আবর্জনার মধ্যেও ফুল ফোটে।
ফুল না থাকলে সৌন্দর্যই যেন অধরা রয়ে যায়। তাই আমরা কিছু ফুল পড়ার টেবিলে বা বসার রুমে ফুলদানিতে রাখি। ফুল মনকে দেয় প্রশান্তি। কিন্তু সেই ফুল কিন্তু সবসময় পরিষ্কার জায়গায় নাও ফুটতে পারে। আমরা ঝোড়ঝাড়ে অবহেলায় ফুল ফুটে থাকতে দেখি, আবর্জনার মধ্যেও ফুলে ফোটে। এমনকি পিচঢালা পথ কিংবা পুরনো বাড়ির দেয়ালেও মানুষের অজান্তে ফুল ফুটে থাকে।
কবি নজরুলও যেন তার গানের চরণে চরণে ফুলের এমন বহুমাত্রিক ব্যবহার করেছেন। চিত্রকল্প জীবন্ত করেছেন অপূর্ব কারিশমায়। তিনি ফুলকে ভালোবেসেছেন গভীরভাবে, প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে। তার কবিতা-গানে নানাভাবে ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে কখনও উপমায়, কখনও সরাসরি। বিভিন্ন ফুলের নাম এসেছে নজরুলের এমন কিছু গানের খণ্ডাংশ-
১.
‘আজকে দোলের হিন্দোলায়
আয় তোরা কে দিবি দোল
ডাক দিয়ে যায় দ্বারে ওই
হেনার কুঁড়ি আমের বোল।’
২.
এ গানটিতে মোট এগারটি ফুলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বৈচিত্র্যময় বিন্যাস শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে-
‘কে নিবি ফুল, কে নিবি ফুল,
টগর যূথী বেলা মালতী চাঁপা গোলাপ বকুল,
নার্গিস ইরানী গুল
...এ ফুল ঝামেলা, চামেলী পারুল’।
৩.
এ গানে আমাদের আশপাশের তেরোটি ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে-
‘বেল ফুল এনে দাও চাইনা বকুল
চাই না হেনা আনো আমের মুকুল।
গোলাপ রঙ গরবী, এনে দাও করবী
চাইতে যূথী আনো টগর কি ভুল।
কি হবে কেয়া দেয়া নেই গগনে
আনো সন্ধ্যামালতী গোধূলি লগনে।
গিরি মল্লিকা কই? চামেলী পেয়েছ সই?
চাঁপা এনে দাও, নয় বাঁধব না চুল।’
৪.
আরও একটি ফুলময় গান-
‘চৈতালি-চাঁপা কয় মালতী শোন
শুনেছিস বুঝি মধুকর গুঞ্জন
তাই বুঝি এত মধু সুরভী উথলে মধু মালতী বনে’।
৫.
এবার একটি সাঁওতালি গান শুনি যা বেশ জনপ্রিয়ও। এ গানে সাঁওতাল জাতির পছন্দের ফুলগুলো চয়ন করা হয়েছে সুন্দরভাবে-
‘হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল,
এনে দে এনে দে নইলে বাঁধবো না বাঁধবো না চুল।
কিনে দে হাট থেকে, এনে দে মাঠ থেকে
বাবলা ফুল আমের মুকুল।’
ফুল কিন্তু নিজে কিছু বলে না, সে তার সৌন্দর্যের মাধ্যমে আমাদের মোহিত করে।
নজরুল তার লেখনীতে তুলে এনেছেন আমাদের চারপাশের সব চেনা ফুল, যেসব ফুলের সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। ‘ফাল্গুনী’ কবিতার মাঝেও সজিনার ফুলকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে- ‘ডগমগ তরুপুরী, পথে পথে ফুল ঝরি, সজিনা ফুলে’। আরও কিছু কবিতা বা ছড়ার অংশবিশেষ-
১.
‘পড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই,
মধুপ দেখে যাদের শাখা আপনি যেত নুই।
হাতে তুমি দুলিয়ে ডাল,
গোলাপ হয়ে ফুটতো গাল
থরকমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই!
বকুল শাখা-ব্যাকুল হত টলমলাত ভুঁই!
...পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ!
...খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখি বউ গো কথা কও।’ (চৈতী হাওয়া)
২.
‘অর্জুন মঞ্জরী কর্ণে
গলে নীপ-মালিকা...’- কবিতায় উল্লিখিত ‘নীপ’ মানে আমাদের বহুল পরিচিত কদম ফুল, বর্ষাকালের প্রতীক, অতি পরিচিত ফুল।
৩.
‘ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল
ঝিঙে ফুল।’ (ছড়া, ঝিঙে ফুল)
৪.
‘ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকি ছোটরে!’ (ছড়া, প্রভাতী)
বিশ্বের আর কোনো সাহিত্যিক এতো বেশি ফুলের ব্যবহার তার সাহিত্যে করতে পারেননি বোধ হয়। নজরুল এর দক্ষ ব্যবহারে পাঠককে মুগ্ধ করতে পেরেছেন। ফুল কিন্তু নিজে কিছু বলে না, সে তার সৌন্দর্যের মাধ্যমে আমাদের মোহিত করে। নজরুলের গানে বা কবিতায় আমরা ফুলকে ভালোবাসতে শিখি, সেইসঙ্গে ভালোবাসতে শিখি মানুষকেও।
আবু আফজাল সালেহ: লেখক ও প্রাবন্ধিক
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!