‘ফাও পেতে চাও ফাও? ওয়াসার কাছে চাও। পানির সঙ্গে পাবে গুবরে পোকার ছা-ও।’
Published : 29 Oct 2022, 09:59 AM
কবি শামসুর রাহমানকে (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ – ১৭ অগাস্ট ২০০৬) ‘নাগরিক কবি’ বলা হয়। কারণ কবিতায় নগরকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। ব্যক্তিজীবনেও তিনি আপাদমস্তক শহুরে ছিলেন। তার বলার ভঙ্গি ও কবিতার উপকরণ তাই স্বভাবসুলভ নগরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে।
প্রায় একই সময়ের অন্যতম কবি আল মাহমুদ যখন গ্রামীণ ও লোকজ উপাদানে কবিতা লিখছেন, শামসুর রাহমান লিখছেন নগরের সুখ-দুঃখ নিয়ে, স্বাধীনতা পাওয়ার ব্যাকুলতা নিয়ে। শামসুর রাহমানের কবিতার সংখ্যা কম নয়, বিপুলায়তনের কবিতার বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে নগর, নগরের বিভিন্ন বিষয়, জীবনযাত্রা প্রভৃতি। শহর কেবল ইট-সিমেন্টের নয়, বরং শহর যেন মানুষের চিড়িয়াখানা। শহর হলো লাখো মানুষের বাসস্থান, তবে প্রত্যেকেই যেন একা-
‘শহর জেগেছে, দূরে ঘণ্টায় প্রাণের ধ্বনি,
রোগীর শরীরে নামলো নিদ্রা হাসপাতালে,
যারা কোনো দিন ভুলেও পেলো না আপন জন,
ছেঁড়াখোঁড়া সেই ক’জন রাতের জুয়োশেষের
ক্লান্তিতে ফের ভিড়লো ধোঁয়াটে রেস্তোরাঁয়।’
(আত্মজীবনী খসড়া)
বেশিরভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন শহরে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। আর এর প্রভাব পড়েছে কবিতায়। নগর, স্বাধীনতা-আন্দোলন অনেক সময় মিশে একাকার হয়ে গেছে। কখনও নগর অসহ্য হয়ে উঠে এসেছে তার কবিতা বা ছড়ায়। অনেক কবিতা হয়ে গেছে শ্লোগানধর্মী, আন্দোলনের পারদে উত্তাপ ছড়িয়ে।
আজীবন ঢাকা শহরে বেড়ে ওঠা শামসুর রাহমানের অধিকাংশ কবিতা তাই নাগরিকতার উপাদানে লেখা। তার বিশেষত্ব হলো তিনি সব ঘটনাকে কবিতা করে তুলতেন। সংবেদনশীল কবিসত্তা, জীবনাসক্তি ও আধুনিক কবিতার কলাকৌশল সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তিনি। কবিতায় তিনি দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, হতাশাকে সহজ ও সুদূরপ্রসারী করে বর্ণনায় মূর্ত করে তোলেন। শব্দ নির্মাণ ও প্রয়োগ সংহত এবং মিতব্যয়ী কবিতাশিল্পী, মানুষের ভাঙাগড়া শূন্যতাও বিষণ্নতার পরিপূর্ণ রূপকে অভাবনীয়ভাবে কবিতায় প্রকাশের ফলে তার কবিতা পাঠকপ্রিয় হয়েছে শুরু থেকে।
‘ভাদ্রের দুপুর চিল্লাচ্ছে পুরানো ঢাকার
কলতলার ঝগড়াটে যুবতীর মতো।’
(প্রামাণ্যচিত্রের অংশ, স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার)
৫০-দশকের সমকালীন কবিবন্ধু সুহৃদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান ছিলেন অনেকটাই আলাদা। তিনি কবিতাকে সহজবোধগম্য করার প্রয়াস নিয়েছেন প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশের শুরুতে তিনি সমকালীনদের থেকে আলাদা ভাষার সন্ধান করেছেন। ‘নিজ বাসভূমে’, ‘বন্দি শিবির থেকে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘ফিরিয়ে দাও ঘাতক কাঁটা’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’ বাংলা কবিতার দীর্ঘকালীন সময়ের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশমান অবয়ব পাওয়া যায় তার কবিতায়।
একটা শহর ছোট না বড় তা আয়তন দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, করতে হয় সেখানকার মানুষের স্বপ্ন দিয়ে। শহর তো তা-ই যা তার নাগরিকরা তাকে বানায়। নগরসভ্যতার পচন ও অবক্ষয় রাহমানকে ভাবিয়ে তুলত, গভীরভাবে ব্যথিত করত। ঢাকা শহরকে মনে হত মরুভূমির মতো নিঃসঙ্গ। অনেক কবিতায় মিশে আছে কবির তীব্র বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে ঘৃণায়, কবিতার পাশাপাশি রাজপথেও-
‘শহরে রোজ ট্রাফিক গর্জায়
চতুর্দিকে চলছে কী হুজুগ;
কত চৈত্র, কত শ্রাবণ যায়
তোমাকে আমি দেখি না কত যুগ।’
(জন্মভূমিকেই)
নগর সভ্যতায় সবকিছু হারিয়ে ফেলেছেন কবি শামসুর রাহমান। চৈত্র কাটে, শ্রাবণও কেটে যায়। ফ্রেমের মধ্যে মেশিনের মতো গতানুগতিক কেটে যায় নগরজীবন। এলিয়টের মতো ফাঁপা নগরজীবনের অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন কবিতায়। প্রেমিকাকে স্মরণ করেছেন নগরে ক্লিষ্ট হয়ে, যানবাহনের চাপে পিষ্ট হয়ে। ঢাকা যেন প্রতিধ্বনির শহর, মরীচিকার শহর। যদি তুমি ঢাকার দিকে তাকাও দেখবে আশা-গৌরব সবাই নিজের মাঝে লালন করছে। ঢাকার রাস্তায় বাসে বসে থাকা এবং জানালা দিয়ে শহর দেখা সত্যিই চমৎকার এক কাজ-
‘স্বর্গদীপ্ত প্রাণ নিয়ে এসে এ কোথায় কোন দেশে
হারিয়ে ফেলেছি রূপ পশুর রোমশ অন্ধকারে?
এখানে মরার খুলি ধুলোয় গড়ায় চারদিকে,
খেলার ঘুঁটির মতো অসহায়, ভবিষ্যৎহীন।’
(পূর্বলেখ/ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)
ঢাকার কাব্যজগতের স্বনামধন্য বরেণ্য কবি হিসেবে তার সময়ের সম্মান অর্জন করেছেন রাহমান। কী রাষ্ট্র, কী বি-রাষ্ট্র, কবিতা আড্ডা, কবির জন্মদিন, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, প্রকাশনা উৎসব, বইমেলা, বৈশাখী মেলা সবক্ষেত্রে শামসুর রাহমান ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। তিনি কবিতা নিয়ে কথা বলতেন। নগরজীবনের দ্বন্দ্ব, নৈরাজ্য, অসঙ্গতি প্রেম, বিরহ সবকিছু ধারণ করেছেন তিনি কাব্যভাষা নির্মাণে। নগরের হতাশা, বেদনা, অপ্রাপ্তি নিয়ে তার বিভিন্ন কবিতার কয়েক ছত্র-
১. ‘বৃথাই আমি তোমাকে কাছে চাই
অত্যাচারী দিন, স্বৈরাচারী রাত
আমাকে রোজ পুড়িয়ে করে ছাই
পাই না আর তোমার সাক্ষাৎ।’
(জন্মভূমিকেই)
২. ‘এক কোণে নিন্তেজ কুপিটা কোনো বিলুপ্ত প্রেমের মতো
জ্বলছে এক বিষণ্ন আচ্ছন্নতায়’
(সেই ঘোড়াটা)
৩. ‘চতুর্দিকে শুধু
বেজে ওঠে ক্যানেন্তারা। জীবন দু'হাতে ঢাকে কান।’
(কমা-সেমিকোলনের ভিড়ে)
৪. ‘জীবন মানেই
তালে তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলা, নিশান ওড়ানো
জীবন মানেই
অন্যায়ের প্রতিবাদ শূন্যে মুঠি তোলা।’
ছড়ায় শামসুর রাহমান রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দেশের সামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। ছড়াতেও সময় বা কালকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ছড়া ‘ফাও-’এর বিষয় পানির অব্যবস্থাপনা-
‘ফাও পেতে চাও ফাও?
ওয়াসার কাছে চাও।
পানির সঙ্গে পাবে
গুবরে পোকার ছা-ও।’
নগরের বিচিত্র চিত্র, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি শব্দের বুননে চিত্রের রূপ দিয়েছেন শামসুর রাহমান। হতাশার পাশাপাশি নগরকেন্দ্রিক নিস্ফলা যান্ত্রিকজীবনে দিকভ্রান্ত না-হয়ে স্বপ্নও দেখেন মাঝেমধ্যে। কল্পনায় রঙ মেখে স্বপ্নকে রাঙিয়ে তুলতে চান এভাবেই-
‘আমার মগজে সারাক্ষণ
প্রকাণ্ড, উজ্জ্বল এক রাজহাঁস পাখা ঝাঁপটায়,
কেবলি হোঁচট খায় দেখি স্বপ্নলোকের চৌকাঠে।’
(অপচয়ের স্মৃতি)
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!