পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানার বাগানে

পয়ষট্টি হেক্টর জমিতে দুটো অংশ মিলে এ বাগান তৈরি। এটি গ্যারিক হকিন্সের পারিবারিক এস্টেট গার্ডেন।

মো. ইয়াকুব আলীমো. ইয়াকুব আলী
Published : 20 May 2023, 09:28 AM
Updated : 20 May 2023, 09:28 AM

বলা হয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায় একইদিনে চার ঋতুরই দেখা পাওয়া যায়। এদেশের ঋতুগুলো হলো- সামার, অটাম, উইন্টার এবং স্প্রিং। আলাদাভাবে বর্ষা, শরৎ বা হেমন্তকাল নেই।

তবে শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়। সেই বৃষ্টি শীতের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়, তাই সেটা আমাদের দেশের মতো উপভোগ্য নয়। আর অটামের সময়টাকে শরৎ এবং হেমন্ত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এসময় শীতকালকে স্বাগত জানানোর জন্য গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়া শুরু করে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই পাতা ঝরে পড়ার আগে বাহারি রঙ ধারণ করে।

অনেক গাছের পাতায় বাহারি রঙের সাজ দেখা যায়। তার মধ্যে জাপানিজ ম্যাপল, এসার, সুগার ম্যাপল, আমেরিকান সুইটগাম, চাইনিজ পিস্টাসিয়ো, চাইনিজ টালো, স্কারলেট ওক, টাপেলো, ইউরোপিয়ান অ্যাশ, ক্লারেট অ্যাশ, পিয়ার, হানি লোকাস্ট এবং পারসিমন অন্যতম। এসব গাছের পাতা ঝরে পড়ার আগে পাতাগুলো সবুজ থেকে বিভিন্ন ধরনের রঙ ধারণ করে।

অটামে অস্ট্রেলিয়ার রাস্তাঘাটের দু'পাশে, পার্কে তাই বাহারি রঙের সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। আর ফুটপাতগুলো ঢেকে যায় ঝরা পাতায়। সেখান দিয়ে হাঁটলে শুকনো পাতা পায়ের নিচে পড়ে মচমচ শব্দ করে। সাতসকালে ঝাড়ুদাররা তাদের ঝাড়ু-গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পাতা পরিষ্কার করতে। গাছের ফুল ছাড়াও যে পাতার বাহারি রঙ দেখার মতো একটি বিষয় হতে পারে সেটা অস্ট্রেলিয়ার অটামে টের পাওয়া যায়।

অস্ট্রেলিয়াতে অটামের এই রঙের মেলাকে একেবারে অফিসিয়ালি উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন বাগানে এসময় অটামের টিকেট ছাড়া হয়। মানুষ টিকেট কেটে সেইসব বাগানে যায় সপরিবারে, অনেকটা বনভোজনের আমেজে। সারাদিন ঘুরেফিরে বাগানের রঙের বাহার দেখেন, ছবি তোলেন, খাওয়া দাওয়া করেন এবং দিনশেষে বাসায় ফিরে আসেন।

আমরাও এবার এমনই একটা বাগানে বেড়াতে গিয়েছিলাম, নাম ‘মেফিল্ড গার্ডেন’। এটি নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যের ওবেরন সাবার্বে অবস্থিত। এটি অস্ট্রেলিয়ার এমনকি দক্ষিণ গোলার্ধের সর্ববৃহৎ ব্যক্তি-মালিকানাধীন বাগান। একে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানার শীতল জলবায়ুর বাগান। পয়ষট্টি হেক্টর জমিতে দুটো অংশ মিলে এ বাগান তৈরি। এটি গ্যারিক হকিন্সের পারিবারিক এস্টেট গার্ডেন। পয়ষট্টি হেক্টরের মধ্যে পনের হেক্টর বছরের প্রতিদিনই খোলা থাকে। আর বাকি পঞ্চাশ হেক্টর বছরে চারবার খুলে দেওয়া হয় উৎসবকে কেন্দ্র করে।

সিডনি থেকে মেফিল্ড গার্ডেনের দূরত্ব গাড়িতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। আমাদের বাসা থেকে দুই ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট। শুরুতে মোটরওয়ে এম৭ ধরে আধঘণ্টা চলার পর শুরু হয় মোটরওয়ে এম৪। তারপর মোটরওয়ে এম৪ একসময় 'গ্রেট ওয়েস্টার্ন হাইওয়ে' নাম নিয়ে শেষ হয়ে যায়। গ্রেট ওয়েস্টার্ন হাইওয়ে ধরে ঘণ্টাখানেক চলার পর শুরু হয় স্থানীয় রাস্তা। এই এক ঘণ্টার ড্রাইভ দারুণ উপভোগ্য এবং রোমাঞ্চকর। রাস্তাটা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে ছুটে চলেছে। তাই ড্রাইভারকে সাবধানতা অবলম্বন করে ড্রাইভ করতে হয়।

তবে আপনি যদি দুপাশের দৃশ্য দেখে সময় পার করতে চান তাহলে ড্রাইভ না করে জানালার পাশে বসে যাওয়াই উত্তম। কচ্ছপের পিঠের মতো পাহাড়গুলো ঘুমিয়ে আছে। তার গায়ে কোথাও ঘন গাছের বন, আবার কোথাও বাদামি সবুজ ঘাসের মাদুর। সেই মাদুরের মধ্যে চড়ে বেড়াচ্ছে গরু, ভেড়া বা ঘোড়া। আবার কোথাও সেই পাহাড়গুলোর ফাঁকে ফাঁকে উপত্যকার মধ্যে কাকচক্ষু জলের সুন্দর হ্রদ, অনেকটা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি অঞ্চলের মতো। এই রাস্তা ধরে যতই আপনি এগোবেন সবুজ ততই বাদামি থেকে বাংলাদেশের সবুজের চেহারা নেবে। একটা সময়ের পর মনে হবে আপনি যেন শ্রীমঙ্গলের রাস্তা ধরে যাচ্ছেন।

তারপর একসময় আপনি ওবেরন সাবার্বে পৌঁছে যাবেন। সেখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের মধ্যে দিয়ে যখন যাবেন তখন মুগ্ধ হয়ে কারখানার চিমনির মুখগুলো দেখতে হবে। কারণ চিমনি দিয়ে অবিরাম সাদা মেঘের মতো ধোঁয়া বেড়িয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেটা আরও ভালোভাবে দেখতে আমরা সেখানে কিছুক্ষণ থেমে থাকলাম। এটা দেখে আমি ছেলেমেয়ে দুটোকে বললাম দেখো, মেঘের কারখানা। ওরাও আমার সঙ্গে একমত হলো। তারপর একসময় মেফিল্ড গার্ডেনের রাস্তায় পড়বেন। সেই রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক গেলেই কাঙ্ক্ষিত বাগানের প্রবেশপথ।

এই প্রবেশপথটা ঠিক পাকা নয়, আবার কাঁচাও নয়। তাই সামান্য একটা দুইটা গাড়ি গেলেই ধুলো উড়ছে। সেটা পার হয়ে মেফিল্ড গার্ডেনের পার্কিং। সেখানে গাড়ি পার্ক করার জন্য একজন সাহায্যকারি আছেন। আমরা কর্তা-গিন্নী, মেয়ে তাহিয়া আর ছেলে রায়ান মা দিবসের দিন বেড়িয়ে পড়লাম। তাই যথেষ্ট ভিড় ছিল। আমাদেরকে পার্ক করতে হলো মূল পার্কিংয়ের বাইরে সবুজ ঘাসের উপর। পার্কিং করে গেটে গিয়ে আপনি টিকেট করতে পারেন। আর আগে থেকে টিকেট করা থাকলে সেটা দেখালেই হবে। হাতের তালুর বিপরীত পাশে স্ট্যাম্পের মতো একটা সিল লাগিয়ে দেবে।

প্রবেশপথের পাশেই আছে খাবার দোকান। সেখানে আরও আছে গাছগাছালি এবং মুরগির খামার। আছে একটা চেকপোস্টের মতো উঁচু পাটাতন। তার পাশেই আছে বড় দাবার কোর্ট। আর এক পাশে একটা বড় চিমনিতে জ্বলছে আগুন। শীতের সময় গেলে সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু উষ্ণ করে নিতে পারেন। তারপর প্রসাধনকক্ষে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে বাগানে ঢুকে পড়তে পারেন। টিকেট কাউন্টার থেকে দেওয়া মানচিত্র ধরে আপনার মনমতো ঘুরে বেড়াতে পারেন।

বাগানটা আবার বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট বাগানে ভাগ করা। পনের হেক্টরের বাগানটার বিভিন্ন অংশের নামগুলো এমন- ওয়াটার গার্ডেন দ্য কি ফিচার অব মেফিল্ড গার্ডেন, দ্য ভ্যালি অব ফাইভ পন্ডস, দ্য ব্লুস্টোন ব্রিজ, দ্য গ্রোটো, দ্য আয়রন অ্যান্ড স্টোন অ্যান্ড ওয়েস্টেরিয়া ওয়াক, দ্য কপার ট্রি ফাউন্টেইন, দ্য ১২.৫ মিটার ওবেলিস্ক পন্ড, এলি অব লন্ডন প্লেইন ট্রিস এবং স্যান্ডস্টোন গ্যালারি। পঞ্চাশ হেক্টরের ব্যক্তি-মালিকানাধীন বাগানের অংশগুলোর নাম হচ্ছে- ক্যাসকেড অ্যান্ড টেম্পল, অস্ট্রেলিয়াস লারজেস্ট প্রাইভেট বক্স হেজ মেজ, এম্ফিথিয়েটার, ফ্যামিলি চ্যাপেল, দ্য স্টাম্পেরি, চাইনিজ প্যাগোডা অ্যান্ড মেফিল্ড লেক, ক্রকুয়েট কোর্ট অ্যান্ড রোজ গার্ডেন, হার্বেসিয়াস বর্ডার, গ্লাস হাউস অ্যান্ড পোটজার, সাংকেন গার্ডেন রুমস, ল্যাভেন্ডার পার্টরি এবং বির্চ ওয়াক।

আমরা এবারের ভ্রমণে শুধু পনের হেক্টরের বাগানটা ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেটুকু দেখেই মনপ্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল। দেখে বোঝা যাচ্ছিল ওয়াটার গার্ডেনের পানিতে অনেক শাপলা ফুটেছে। এখন তাপমাত্রা কমে যাওয়াতে সেগুলো বুজে গিয়েছে। কিন্তু ওয়াটার গার্ডেনের পাড়ের বাহারি রঙের গাছগুলোর আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার প্ৰতিচ্ছবি পানিতে পড়ে সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে দিয়েছে। একটা ঢালু জায়গার মধ্যে উপর থেকে নিচে সারিধরে ছোট ছোট পাঁচটা পুকুর। ছোট্ট রায়ান পুকুরগুলো দেখে বলে উঠলো এগুলো হার্ট আকৃতির। পুকুরের চারপাশে ঘাসের সবুজ মখমলের বিছানা। সেখানে বাচ্চারা অনেকেই গড়াগড়ি খেলছে। রায়ানও কয়েকটা গড়ান দিয়ে দিল।

নীল পাথরের সেতুটা দারুণ। সেতুর নিচ দিয়ে একটা ঝর্ণা বয়ে চলেছে। সেতুর উপর থেকে নিচে তাকালে গাছগুলোর পুরোটা দেখা যায়। সবাই সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। হ্রদের পাড় ধরে হাঁটলেই সামনে পড়ে ‘দ্য গ্রোটো’। এখানেও একটা ঝর্ণা আছে এবং এই ঝর্ণার পেছনে গুহার মতো জায়গা দিয়ে চলাচল করা যায়। ওখান ঢুকলেই শরীরে একটা শীতল হাওয়া লেগে শরীর জুড়িয়ে যায়। সেদিক দিয়ে এগিয়ে গেলেই ‘স্যান্ডস্টোন গ্যালারি’। গ্যালারির দেয়ালে প্রদর্শন করা হচ্ছে পুরো মেফিল্ড বাগানের ইতিহাস। কারা, কীভাবে, কবে, কোথা থেকে উৎসাহ পেয়ে এটা প্রতিষ্ঠিত করেছিল আছে তার বিশদ বিবরণ। এছাড়া আছে হকিন্স পরিবারের প্রতিষ্ঠাতাদের সবার ছবিও। আর মেঝেতে উঁচু বেদির উপর আছে বাগানের একটা বিশাল মানচিত্র।

স্যান্ডস্টোন গ্যালারির সামনে দাঁড়ালে চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ ভিউ দেখতে পাওয়া যায়। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে ওবেলিস্ক পন্ড। অন্যপাশে সবুজ কচ্ছপের পিঠের পাহাড়ের গায়ে চড়ে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা বিন্দুর মতো ভেড়ার পাল। নিচে নেমে এসে আমরা গেলাম ‘কপার ট্রি ফাউন্টেইন’ দেখতে। সেখানে একটা ধাতব গাছের সারা শরীর থেকে ঝর্ণার মতো পানি বের হচ্ছে। আমি শুরুতে মনে করেছিলাম এটা প্রাকৃতিক গাছ। কিন্তু তাহিয়া আমার ভুলটা ভাঙিয়ে দিল। তখন আমি বললাম, পুরো বাগানে তাহলে এটাই একমাত্র কৃত্রিম গাছ।

কপার ট্রির সামনেই ওয়েস্টেরিয়া ওয়াক। সেখানে সুন্দর ধনুকের মতো করে জাপানিজ ওয়েস্টেরিয়া গাছ লাগানো। তারমধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় যেন গাছগুলো সামনের দিকে ঝুকে আমাদের কুর্নিশ করছে। এখন অটাম, তাই ওয়েস্টেরিয়া গাছে কোন ফুল নেই, শুধুই সবুজ পাতা।

হ্যাম্পটন হাফওয়ে হোটেলে পৌঁছে চারটা চিকেন স্নিটজেল বার্গার অর্ডার করে হোটেলের পেছনে রাখা টেবিলে গিয়ে বসলাম আমরা। সেখানে পাহাড়ের একটা দুর্দান্ত ভিউ। পাহাড়ের মাঝে সবুজ উপত্যকা। আর উপরে মেঘের ভেলা। খাওয়া শেষ করে আমরা কফি নিয়ে নিলাম, কারণ আরও দুঘণ্টার রাস্তা ড্রাইভ করতে হবে। কাউন্টারের ভদ্রমহিলাকে গল্প প্রসঙ্গে বললাম, আমরা মেফিল্ড গার্ডেনে গিয়েছিলাম। শুনে উনি বললেন, আমাদের এতো কাছে, কিন্তু যাওয়া হয় না। প্ৰতিবারই পরিকল্পনা করি, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যায়। আমি বললাম, এখন যেতে পারো, দারুণ রঙ ছড়াচ্ছে গাছগুলো। শুনে উনি বললেন, ধন্যবাদ। তোমার বাসায় ফেরাটা নিরাপদ হোক। আমি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।