তরুণ কবির প্রতি

ফিলিস্তিনের কবি মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১-২০০৮), গোটা আরবজুড়েই তার সুখ্যাতি। ফাদি জুদাহ-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে তার এ কবিতাটি বাংলায় ট্রান্সক্রিয়েশন করা হয়েছে।

রাব্বী আহমেদরাব্বী আহমেদ
Published : 12 May 2023, 06:24 PM
Updated : 12 May 2023, 06:24 PM

তোমার পূর্বের কবিরা যে আঙ্গিকে কবিতা লিখেছে
তুমি সেগুলো ভুলে যাও।
তুমি তোমার শব্দ দিয়ে শুরু করো
যেন তুমিই প্রথম কিংবা সর্বশেষ কবি
তোমার আগে কেউ কখনও কবিতা লেখেনি।

তোমার পূর্বের কবিদের কবিতা তুমি পড়তে পারো,

কিন্তু সেই একই লেখার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।

সতর্ক থেকো— তোমার বাতাসে যেন ঢুকে না পড়ে

অন্য কারো বাতাস।

বরং জীবন নিংরে চূড়ান্ত-বেদনার যে বই

তোমার পূর্বের কবিরা লিখে গেছে,  
তুমি তার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করে দিও।

কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করো না, কে আমি?

তুমি তো জানো কে তোমার মা
তুমি জানো তোমার জন্মের ইতিহাস 
অন্য কারো মত হওয়ার দরকার নেই তোমার।

তুমি হও একজন মৌলিক মানুষ
ঠিক যেমন তোমার বাবা।

সত্য যখন সাদা, তার উপর লেখো কাক-কালো কালির কলমে
সত্য যখন কালো, লেখো তার উপর ঝলমলে আলোর পেন্সিলে।

যদি তুমি বাজপাখির সাথে থাকতে চাও

তবে বাজপাখির সঙ্গেই তোমাকে উড়তে হবে।

যদি তুমি কোনো নারীর প্রেমে পড়, তবে তুমি সত্যিকারের ‘তুমি’ হয়ে ওঠ
কখনও সে নারীর মত হতে যেও না।
আর ভালোবেসে একাত্মা হয়ে যাও,
হও এমন— যে আত্মবিনাশের আকাঙ্ক্ষা করে
আমরা যা ভাবি জীবন তার চেয়েও ছোট।

কিন্তু সেটা নিয়ে চিন্তা করলে শুধু ভেঙেই পড়বো,

মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু তাই বলে
জীবনকে তো থামিয়ে রাখা যায় না।

তুমি যদি একটা গোলাপ নিয়ে দীর্ঘ-সময় চিন্তা কর,

তবে প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও তুমি এক চুল নড়বে না।  

তুমি ঠিক তোমার পূর্ববর্তী কবিদের মত,

শুধু পার্থক্য এই যে তাদের পথ ফুরিয়ে গেছে।  

কিন্তু তোমার সামনে রহস্যে ঘেরা অবারিত পথ

কোনোদিন যা শেষ হবার নয়।

যদি পথে কখনও পিছিয়ে যাও, আবার এগিয়ে যেও,   

কখনও যদি একটু নামো, আবার উঠে দাঁড়াও।

এসব চড়াই-উৎরাই, উত্থান-পতন নিয়েই জীবন।

তারুণ্যের শেষকে তুমি বলতে পারো পরিণত-প্রতিভা বা প্রজ্ঞা,
নিঃসন্দেহে এটা প্রজ্ঞা— তবে তা স্থির কোনো গদ্য কবিতার।

হাতের এক হাজার পাখি কখনও সমান হতে পারে না

সেই পাখিটির— যে ধারণ করে আছে পুরো বৃক্ষকে।

দুঃসময়ের একটি কবিতা

কবরস্থানে ফোটা যেকোনো ফুলের মত সুন্দর।

উদাহরণ তৈরি করা মোটেও সহজ নয়

কাজেই, নিজের মত হও— সব সীমা ছাড়িয়ে যাও।

তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনারও নির্দিষ্ট সীমা আছে
একটা সময়ের পর তারও মেয়াদ ফুরিয়ে যায়
কাজেই হৃদয়ের জন্য উৎসাহী হও,   
আর একে অনুসরণ করো
তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত।
যাকে ভালোবাসো তাকে কখনও বলো না,
‘তুমি হচ্ছ আমি, আর আমি হচ্ছি তুমি’

বরং এর বিপরীতটা বলো, ম্রিয়মাণ কোনো
মেঘের মত আমরা দু’জন ক্ষণিকের অতিথি।

বিচ্যুত হও— তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে
শৃঙ্খল থেকে বিচ্যুত হও।
একই উচ্চারণে কখনও একাধিক তারকাকে রেখো না।

তোমার হৃদয়ে যে উচ্ছ্বাস জেগে উঠছে
তাকে পূর্ণ করতে সবচেয়ে অপরিহার্যের পাশে
রাখো নিকটবর্তী প্রান্তিককে।

আমাদের নির্দেশাবলীর যথাযথতায়
বিশ্বাস রেখো না।
তুমি বিশ্বাস রেখো শুধু কাফেলার পদচিহ্নে।

যেকোনো নৈতিকতা-ই আত্মঘাতী জ্ঞান  

কবির হৃদয়ে যা বুলেটের মত আঘাত করে,
যখন রেগে যাও, হও দুরন্ত ষাঁড়ের মত শক্ত।

যখন ভালোবাসো
হও কাঠ-বাদামের কুঁড়ির মত নরম।
আর যখন কোনো বদ্ধ রুমে প্রাণখুলে

তুমি নিজের জন্য গান গাও,

তখন কিছুই না, কিচ্ছু হয়ো না।

প্রাচীন কোনো কবির রাতের মতো-ই দীর্ঘ এ-পথ,

সমতল ভূমি ও পাহাড়, নদী আর উপত্যকায় ভরা।
তুমি তোমার স্বপ্নের পরিধি জেনে হেঁটো,

হয় কোনো পদ্ম তোমাকে অনুসরণ করবে
না হয় কোনো ফাঁসির কাষ্ঠ।

তুমি কী কাজ করছ, এ-নিয়ে আমি চিন্তিত নই
আমার চিন্তা হয় তাদেরকে নিয়ে
যারা নৃত্য করে তাদের নিজের সন্তানের কবরের উপর।
আমার চিন্তা সেই লুকানো ক্যামেরার জন্য
অলক্ষ্যে যা ধারণ করছে তোমার যা কিছু গোপন।
তুমি আমাকে হতাশ কোরো না,

যদি তুমি অন্যদের বা আমার থেকেও
দূরত্ব বজায় রেখে চলো,

তবে সেগুলোকেই তোমার সুন্দর মনে হবে
যা দেখতে ঠিক আমার মতো নয়।

আজ থেকে উপেক্ষিত ভবিষ্যৎ-ই

তোমার একমাত্র অভিভাবক।

তোমার জীবনে যখন গভীর দুঃখ আসে
আর তুমি মোমবাতির কান্নার মত গলে যাও,
ভেবো না, এর মাঝেই তুমি তোমাকে দেখতে পাবে।

তুমি তখন তোমার অন্তর্দৃষ্টির আলোকে অনুসরণ করো।  

ভাবো নিজেকে নিয়ে, ‘এই কি আমার পুরোটা?’

কবিতা সবসময়-ই অসম্পূর্ণ,

প্রজাপতি তাকে পূর্ণ করে।

প্রেম বিষয়ে কোনো উপদেশ কাজে লাগে না
কারণ এ হলো অভিজ্ঞতা,

কবিতা নিয়েও কোনো পরামর্শ নেই
কারণ এ হলো প্রতিভা।

জেনে রেখো,
তুমি ছাড়া তোমার কেউ নেই।

সবশেষে—
তরুণ কবি, তোমাকে সালাম।