'বইয়ের গল্পই যদি নিজের জীবনের গল্প মনে করিস, তাহলে তোদের জীবনের গল্প কোনোদিন পরিবর্তন হবে না।'
Published : 12 Oct 2023, 05:36 PM
এই শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে যখন স্কুলে পড়তাম, তখন প্রায়ই আমাদের ইংরেজি কিংবা বাংলা পাঠে ‘জীবনের লক্ষ্য’ লিখতে হত। দেখা যায়, আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই ভাগই একই ধরনের গল্প লিখেছে। বাজারে পাওয়া গাইডবইগুলোতে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে কোথাও শিক্ষক, কোথাও চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কিংবা খুব বেশি উদার হলে কৃষক হওয়ার গল্পগুলো আমাদের বেশি পড়তে হতো এবং পরীক্ষার খাতায় তা উগড়ে দিতে হত।
পরীক্ষার খাতায় আমাদের জীবনের লক্ষ্য লেখা দেখে একদিন আমার এক শিক্ষক বললেন, “আচ্ছা তোরা যদি সবাই ডাক্তার হতে চাস, তাহলে পুরো দেশটাকেই একটা হাসপাতাল বানাতে হবে। শিক্ষক হতে চাস ভাল কথা, তো এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে গেলে দেশটাই তো ভরে যাবে। তোরা পাইলট হতে চাস, কিন্তু বাস চালক হতে চাস না। তোরা জাহাজের নাবিক হতে চাস, কিন্তু ট্রেন চালক হতে চাস না, কেন? এই যে এতগুলো ছাত্র-ছাত্রী তোরা, তোদের মধ্যে কেউ লিখলি না যে সে গবেষক কিংবা বিজ্ঞানী হবি! বইয়ের গল্পই যদি নিজের জীবনের গল্প মনে করিস, তাহলে তোদের জীবনের গল্প কোনোদিন পরিবর্তন হবে না। নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগার বিষয়ে এখন থেকে ভাবতে থাক, দেখবি এই পৃথিবীটাকে নিয়ে ভাবতে পারবি।”
আমার সেই শিক্ষকের স্মৃতি এখন খুব মনে পড়ে। স্কুল-কলেজের সেই লক্ষ্য আর ধরা দেয় না। সারাজীবন চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে চাওয়া ছেলে কিংবা মেয়েটিকে পড়তে হচ্ছে সমাজবিজ্ঞান কিংবা প্রাণিবিদ্যা। যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই কলেজের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে স্বপ্নগুলো ডানা মেলার সুযোগ পায়। পছন্দ কিংবা আগ্রহের বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ মেলে।
অধিকাংশ সময় আমরা যা ভাবি যা চাই তা হাতের নাগালে আসে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়। ভালোলাগার বিষয় না হলেও সেখানে অনেকটা জোর করেই পড়াশোনা করে জীবনযুদ্ধে নামতে হয়। ফলে অসীম চাহিদার সাগরে জীবনের প্রকৃত সুধা আমরা ভোগ করতে পারি না। বড়জোড় জীবনযুদ্ধে চারদিকের প্রতিযোগিতার চাপে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তা আমাদের ভালো না লাগলেও সেইগুলো গ্রহণ করতে হবে? কেন গণিত ভালোবাসা শিক্ষার্থীকে উদ্ভিদবিদ্যা পড়তে হবে? কেন পদার্থবিজ্ঞান ভালোবাসা মানুষদের চারুকলা পড়তে হবে? কেন রসায়ন পড়তে ভালোলাগাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে হবে?
যে কাজে আনন্দ নেই, সেই কাজে সাফল্যও ধরা দেয় না। জীবনে সফলতার অন্যতম মূলমন্ত্র হল- মন যা চায় তার বিরুদ্ধে কখনো যেও না।
আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবনের লক্ষ্য অন্যদের কাছে বর্গা দেয়। পরিবারের সদস্যদের মন রক্ষা করে। বাবা-মা চায় তার সন্তান অমুক স্কুলে ভর্তি হোক, তমুক নামি-দামি কলেজে গিয়ে পড়ুক। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির পর থেকেই বাবা-মা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তাদের সন্তান চিকিৎসক হবে, প্রকৌশলী হবে এমন স্বপ্নে বিভোর থাকেন। ফলশ্রুতিতে, বাবা-মায়ের চাপিয়ে দেওয়া স্বপ্ন ঘরে তুলতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা মাঝপথে ভেঙ্গেচুরে মুষড়ে যায় কিংবা স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। কারণ, পিতা-মাতারা ধরেই নিয়েছেন, তাদের সন্তানদের জীবনের লক্ষ্য স্থির করার অধিকার নেই। নিজেদের দক্ষতা-মন্দ মূল্যায়নের সক্ষমতা তাদের হাতে থাকে না।
আমি জানি না, এই লেখাটি কেবল কিশোর-কিশোরীরাই পড়বে কিনা। যদি তাদের বাবা-মা এই লেখাটি পড়েন, তবে তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, সন্তানদের জীবনের লক্ষ্য আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া বন্ধ করুন। সন্তানদের স্বীয় চাহিদা ও স্বপ্নগুলো মনোযোগ সহকারে শুনুন। আর সন্তানকে সেই পথই দেখাতে সহায়তা করুন। আপনি হয়ত মনে করছেন, আপনার সন্তান জীবনের ভালো-মন্দ বোঝার সক্ষমতা রাখে না কিংবা বয়সের তুলনায় সিদ্ধান্তটি অগ্রহণযোগ্য, তাহলে মনে রাখবেন এটা অন্যায়। সন্তানদের মানসিক দিক থেকে এটা কেবল অস্বাস্থ্যকরই নয়, নৈতিকতা বিবর্জিত।
এ কথা সত্য, আমাদের বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কিশোর-কিশোরীদের মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধা দেয়। চারদিকে অনেক খারাপের ভিড়ে সন্তানদের ভালো রাখার সংগ্রাম যেন প্রতিটি মা-বাবাকে করতে হয়। এ কারণে, সন্তানের জীবনের লক্ষ্য নিয়ে অভিভাবকদের ভাবতে হয়। তবে সন্তানদের মৌলিক চিন্তা চেতনার প্রতি সম্মান জানানোর অভ্যাস আমাদের গড়া উচিত। মনে রাখতে হবে, মনের বিরুদ্ধে থাকা লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অধিকাংশ লাইনচ্যুত হন। জীবনযুদ্ধে যেখানে নিজেকে মেলে ধরার দরকার সেখানে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে।
আপনি যদি আপনার চারপাশের সফল হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে দেখবেন, তাদের সফলতার পেছনে মূলনীতি হলো, নিজেদের পছন্দ বা ভালোলাগার বিষয়ে কাজ করা বা লেগে থাকা। এদের বড় অংশই বলবে, তারা ছোটবেলায় যেটা হতে চেয়েছিলেন সেটি তারা হতে পারেননি। বরং যা হতে চেয়েছিলেন, যেটিতে বাবা-মা বাধা দিয়েছে সেটিই দিনশেষে হয়েছেন। যে কাজে আনন্দ নেই, সেই কাজে সাফল্যও ধরা দেয় না। জীবনে সফলতার অন্যতম মূলমন্ত্র হল- মন যা চায় তার বিরুদ্ধে কখনো যেও না।
কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিজের ইচ্ছের মূল্যায়ন করতে বাধা দেয়। আমরা চাইলেও উচ্চশিক্ষায় নিজেদের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে পারি না। ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আস্থা ও মেধাবীদের সংকট প্রকটতর হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞ থাকলেও চিন্তাশীল মানুষের অভাব দেখা দিয়েছে।
আমরা চাই, আমাদের কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের ভাগ্যের বিধাতা নিজেরাই হয়ে উঠুক। যার যেটা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয় তারা সেটাই করুক। রাষ্ট্র আমাদের সেই পথ বাতলে দিক। মানসিক বিকাশে অন্তরায় হয় এমন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ছাঁটাই করি। আমার বিশ্বাস আজকের শিশুরা আগামীতে আরও বেশি চাক্ষুষ হবেন, নিজেদের ভালোমন্দের বিচার-বিশ্লেষণে সেরাটা দিয়ে এই দেশ ও পৃথিবীকে আনন্দময় ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলবেন।