করিমের প্রয়াসের কারণে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের ৪০০ বছরের ইতিহাস বদলে যায়।
Published : 26 Nov 2024, 02:11 AM
আমার মামার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদন্ডী। এখানে এক সুঠামদেহী পুরুষের সঙ্গে দেখা হতো। তিনি আমার মামার সহপাঠী ও বন্ধু। মায়ের কাছে শুনেছি, তিনি সাহিত্যবিশারদের নাতি। কে এই সাহিত্যবিশারদ? ‘সাহিত্যবিশারদ’ একটি উপাধি। পুরো নাম আবদুল করিম। চট্টল ধর্মমন্ডলী তাকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ খেতাব দেয়। পরে তিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ নামে পরিচিতি পান।
আবদুল করিম ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্ম নেন। তখন ছিল ব্রিটিশ সরকারের শাসনকাল। পুঁথিসাহিত্যের প্রতি আবদুল করিমের আগ্রহ ছাত্রাবস্থা থেকেই ছিল। তখন তিনি ভাবতেন, শিক্ষকদের প্রশ্ন করতেন, এসব পুঁথিসাহিত্যের রচয়িতা কে?
এ ধরনের আত্মজিজ্ঞাসা থেকেই আবদুল করিমের পথচলা শুরু। কৌতূহলী মানুষ ছিলেন। এই মন তাকে পুঁথি সংগ্রাহক হতে তাড়িত করে। তিনি বলেন, “পুরাতন পুঁথি কঙ্কালেরই মত। কিন্তু আমি তাহার ভিতর যুগ যুগান্তের রক্তধমন ও নিঃশ্বাসের প্রবাহধ্বনি শুনিয়াছি।”
করিমের সংগৃহীত প্রথম পুঁথিসাহিত্যের নাম ‘পদ্মাবতী’। লেখক আলাওল। আনোয়ারায় এক কৃষকের ঘরে খুঁজে পেয়েছিলেন এটি। সে কি অনাবিল আনন্দ! প্রথম পাওয়ার আনন্দ পরিণত বয়সেও ভুলতে পারেননি করিম। তখন তিনি ছাত্র। খুঁজে পাওয়া এ পুঁথিতে কী লেখা আছে তখনও জানতেন না। তবুও তার মনে হলো, এ অমূল্য সম্পদ। তাই চাষি ভাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তিনি বাড়ি এনে পাঠোদ্ধারের চেষ্টা চালান।
সাতদিন পর তিনি বুঝে উঠলেন, এটি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’। তার আনন্দে আত্মহারা হওয়ার সেই দৃশ্য দেখেছিলেন আরেক লোকগবেষক মুহম্মদ এনামুল হক। তিনি বলেন, “আবদুল করিম যখন বৃদ্ধ বয়সে এ কাহিনি বলতেন, তখন তার দন্তহীন মুখে যে হাসি ফুটে উঠতো, তা দেঁতো হাসিকেও মাত করে দিতে দেখেছি।”
হক আরও বলেন, “পদ্মাবতীর প্রাচীন পাণ্ডুলিপির আবিষ্কার আবদুল করিমের জীবনের প্রথম ও স্মরণীয় ঘটনা। এটি জাতির পক্ষেও এক মূল্যবান আবিষ্কার। এই আবিষ্কারকে ভিত্তি করে আজ জাতির প্রাচীন সাহিত্য সাধনার সৌধ গড়ে উঠেছে।”
এই মহান সৌধ নির্মাণে আবদুল করিমকে গ্রামের পর গ্রাম হাঁটতে হয়েছে, ঘুরতে হয়েছে অনেক জনপদ। বহুজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবার কাছ থেকে মধুর ব্যবহার পাননি। মন্দ কথা শুনেছেন, গালমন্দ করেছে অবুঝেরা। অর্থবিত্তের কোনো হাতছানি ছিল না, বরং উপার্জিত সীমিত অর্থ ব্যয় করছেন এ কাজে।
করিম থেমে যাননি। প্রাচীন সাহিত্য সাধনার এক ঝোঁক তাকে পথ চলতে সাহস জুগিয়েছে। পুঁথি সংগ্রহের জন্য কোনো পদ্ধতিগত জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ তার ছিল না। কোনো পথপ্রদর্শকও ছিলেন না। নিজেই নিজের পথ নির্মাণ করেছেন। চলার পথে অনেক পুঁথি সংগ্রাহক, পুঁথিপ্রেমিকের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের সান্নিধ্য তাকে পুঁথি সংগ্রহের কাজে সহায়তা করে।
পুঁথিপাঠের আসরের খবর শুনলেই ওখানে গিয়ে হাজির হতেন আবদুল করিম। মুগ্ধ হয়ে পুঁথিপাঠ শুনতেন। প্রশ্ন করে করে পৌঁছে যেতেন উৎসমুখে। চট্টগ্রাম জেলার শিলাইগড়া গ্রামের মহুরি বাড়ির বুধা গাজী ছিলেন আবদুল করিমের খোঁজ পাওয়া তেমনি এক পুঁথিপ্রেমী। প্রতি সন্ধ্যায় বুধা গাজীর বাড়িতে পুঁথিপাঠের আসর বসত। তার সংগ্রহে অনেক প্রাচীন পুঁথিও ছিল।
আবদুল করিম একদিন মহুরি বাড়িতে গিয়ে বুধা গাজীর সঙ্গে দেখা করেন। বুধা গাজীর বাড়িতে পুঁথিপাঠের আসরে অংশ নেন। করিম এই প্রবীণ পুঁথিপ্রেমিকের সংগ্রহে দেখতে পেলেন অনেক পুঁথি। এতো পুঁথি দেখে অবাক হলেন। কী করে পুঁথিগুলো নিজের সংগ্রহে আনা যায়, সে বুদ্ধি আঁটতে থাকেন। বুধা গাজী করিমের এমন উৎসাহে খুব খুশি হলেন। তিনি করিমকে তার বাড়িতে কয়েকদিন আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ করেন। করিম থেকে গেলেন। তারপর তিনি বুধা গাজীর কাছ থেকে সব পুঁথি নিজের সংগ্রহে নিয়ে আসেন।
আবদুল করিম এমন সহায়তা পেয়েছিলেন আনোয়ারা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রাজচন্দ্র সেনের কাছ থেকেও। তিনি ছিলেন ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা মুক্তারাম সেনের বংশধর। করিম ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যটি তার কাছ থেকেই সংগ্রহ করেন। এসময় তিনি আনোয়ারার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রচুর পুঁথি সংগ্রহ করেন। এভাবে করিমের প্রাচীন সাহিত্য, পুঁথি সংগ্রহের ভান্ডার দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়।
আবদুল করিম তার সংগৃহীত পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে সতেরোশ পুঁথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারে জমা দিয়েছিলেন। অবশিষ্ট পুঁথিগুলো তার মৃত্যুর পর অধ্যাপক আহমদ শরীফ (আবদুল করিমের ভাইয়ের ছেলে) রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরকে দেন। করিম ২ হাজারের বেশি পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ করেন। আহমদ শরীফ লিখেন, “পুঁথিও সংগ্রহ করেছেন হিন্দু-মুসলিম অভেদে, তার আগে এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে কেউ পুঁথি সংগ্রহ করেননি।”
প্রাচীন পুঁথিসাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আবদুল করিমকে ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন পুঁথি সংগ্রাহক। ‘পদ্মাবতী’ সংগ্রহের পর প্রায় অর্ধশতকের বেশি সময় করিম পুঁথি সংগ্রহের ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রায় শতাধিক কবি-সাহিত্যিককে খুঁজে বের করেন।
পনেরো শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীর, ষোলো শতকের দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, সতেরো শতকের কাজী দৌলত, মাগন ঠাকুর, আলাওল, আঠারো শতকের আলী রেজা, ষোলো শতকের দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী ও গোবিন্দ দাস প্রমুখ কবির পুঁথি ও পদের তিনিই ছিলেন প্রথম আবিষ্কর্তা। এদের অনেকেই ছিলেন আরাকান রাজসভার কবি।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের রচিত বাংলা পুঁথির তালিকা ‘বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ শিরোনামে দুখণ্ডে প্রকাশ করে। এছাড়াও করিম নিজে নয়টি প্রাচীন বাংলা কাব্য সম্পাদনা করেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও মুহম্মদ এনামুল হক যৌথভাবে ১৯৩৫ সালে ‘আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য’ বইটি প্রকাশ করেন।
১৯১৮ সনে চট্টগ্রাম সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দেওয়া তার ভাষণের সংশোধন ও সম্প্রসারণ করে তিনি ‘ইসলামাবাদ’ নামে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেন। পরে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। তিনি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কারের পর সম্পাদনা করেন। এটি বই আকারে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
করিমের সম্পাদনায় ১৩০৮ বঙ্গাব্দে ‘শ্রীমতি রাধিকার মানভঞ্জন’ বই আকারে প্রকাশ করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মারা যান। করিমের প্রয়াসের কারণে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের ৪০০ বছরের ইতিহাস বদলে যায়। লেখা হয় বাঙালি জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন আরেক ইতিহাস।
তথ্যসূত্র
১. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ: জীবন ও কর্ম, বাংলা একাডেমি
২. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ঐতিহ্য-অন্বেষার প্রাজ্ঞ পুরুষ, আবুল আহসান চৌধুরী (সম্পাদিত)
৩. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আহমদ শরীফ
৪. দীপ্ত আলোর বন্যা, আজহার উদ্দিন খান
৫. আলোর পাখি, আলী ইমাম