কাণ্ডজ্ঞান কোনো সুলভ বস্তু নয়। এজন্যই বলা হয় ‘কমন সেন্স ইজ ভেরি আনকমন’।
Published : 26 Jul 2023, 10:20 PM
অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।
ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এ জন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের অর্থের গল্প।
আমরা প্রায়ই কথায় কথায় বলি ‘তোমাকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াব’। কিন্তু এই চৌদ্দ শিকের অর্থ কী? আবার মনে প্রশ্ন জাগে চৌদ্দ শিক কেন? ষোলো শিক বা আঠারো শিক কেন নয়। এর পেছনের গল্প কী? তবে চলো জেনে আসি এই চৌদ্দ শিকের গল্প।
‘শিক’ শব্দটি ফারসি। ফারসি ভাষায় এর অর্থ লৌহদণ্ড, গরাদ, জেলখানা, কারাগার প্রভৃতি। বাংলা অভিধানমতে এর অর্থ লোহা বা অন্য ধাতুর তৈরি শলাকা, গরাদ। চৌদ্দ শিক শব্দবন্ধে শিক শব্দের অর্থ বন্দিশালা, কারাগার, জেলখানা প্রভৃতি। সুতরাং, চৌদ্দ শিক শব্দবন্ধের অর্থ হলো চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড। যদিও শিক কারাদণ্ড অর্থে আলাদা কোনো ব্যবহার নেই।
তবে এ বিষয়ে যে ভুল অনেকে করেন সেটি হলো, অনেকে ধরে নেন, চৌদ্দ শিক অর্থ চৌদ্দ শিকের তৈরি বন্দিশালা। প্রকৃতপক্ষে এটি ভুল। মূলত চৌদ্দ শিক বলতে চৌদ্দ শিকের তৈরি কারাগারকে বোঝায় না, বোঝায় চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড।
এবার আসা যাক চৌদ্দ শিক কেন? ষোলো শিক বা আঠারো শিক কেন নয়। এ বিষয়টির ব্যাখ্যা হলো ব্রিটিশ ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বলতে সর্বোচ্চ চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ডকে বোঝায়। সেটি ষোলো বা আঠারো বছর নয়। এ বিষয়টির সূত্র ধরেই চৌদ্দ শিক কথাটির উদ্ভব হয়েছে যার অর্থ চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড।
জ্ঞানই শক্তি এই প্রবাদবাক্যের সঙ্গে শৈশব থেকেই আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান কী? এটি কোন গাছের কাণ্ড থেকে আগত? কাণ্ডের সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক কী? চলো তবে এ বিষয়ে জেনে নিই।
সাধারণত কাণ্ডজ্ঞান বা কমন সেন্স বিশেষায়িত কোনো জ্ঞান নয়, এটি কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও অর্জিত হয় না। কোনো সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তির বর্তমান ও অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটি সহজাতভাবেই অর্জিত হয়ে থাকে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত তাত্ত্বিক বা দার্শনিক আলোচনা বা সংশয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
কাণ্ড এবং জ্ঞান শব্দদুটোর সমন্বয়ে ‘কাণ্ডজ্ঞান’ শব্দটির উৎপত্তি। গাছের কাণ্ড বিষয়ে জ্ঞান, কাণ্ডের অবস্থা, বিষয়বোধ, স্থান-কাল-পাত্রানুসারে বিষয়বিশেষের কর্তব্যবোধই হলো কাণ্ডজ্ঞান বা কমন সেন্স। গাছের কাণ্ড বা শাখা থেকেই শব্দটির উৎপত্তি। কেননা কোনো গাছের কাণ্ডই পুরো গাছটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। গাছের কাণ্ডের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই এর শাখা-প্রশাখাসহ সবই সচল থাকে। এ বোধ থেকেই কাণ্ডজ্ঞান শব্দটির উৎপত্তি। খণ্ডজ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি কখনোই জ্ঞানের সামগ্রিক বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারে না। তখনই তাকে বলা হয় ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’। কী বুঝতে পারলে তো?
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের অংশবিশেষ একইসঙ্গে সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশ্বজনীন হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তপ্ত ধাতব পাত্রে হাত দিলে যে হাত পুড়ে যাবে, তার জ্ঞান থাকা এক ধরনের বিশ্বজনীন কাণ্ডজ্ঞান। আবার কিছু কিছু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সমাজ, অঞ্চল, দেশ বা সম্প্রদায় নির্ভর হতে পারে। যেমন: কোনো দেশে প্রচলিত বিশেষ ধর্মের প্রার্থনালয়ে প্রবেশ করার পূর্বে জুতা বাইরে রেখে আসতে হয়, সেটি ওই দেশের নাগরিকদের জন্য সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হলেও বিদেশি বা বহিরাগত ব্যক্তির জন্য সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান নাও হতে পারে।
সুতরাং কাণ্ডজ্ঞান কোনো সুলভ বস্তু নয়। এজন্যই বলা হয় ‘কমন সেন্স ইজ ভেরি আনকমন’। ক্ষেত্রবিশেষে জ্ঞান না থাকলেও চলে, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া আমরা অচল।
সুধী ও সুধি শব্দদ্বয় একই উচ্চারণবিশিষ্ট দুটি ভিন্ন অর্থজ্ঞাপক শব্দ। এ বানানদুটো ব্যবহারে প্রায়ই ভুল প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ‘সুধী’ অর্থজ্ঞাপনে ‘সুধি’ শব্দের ব্যবহার সর্বত্র একটু বেশিই পরিলক্ষিত হয়। তবে চলো জেনে নেওয়া যাক শব্দ দুটোর অর্থ, ব্যুৎপত্তি ও অর্থপার্থক্য।
সুধী: ‘সুধী’ সংস্কৃত শব্দ। বিশেষ্য ও বিশেষণ পদ। এর ব্যুৎপত্তি [সু+ধী]। এর আভিধানিক অর্থ জ্ঞানী বা বিদ্বান ব্যক্তি, শ্রদ্ধেয়, বিদ্বান, জ্ঞানী, পণ্ডিত, মান্যবর প্রভৃতি। প্রয়োগ: উপস্থিত সুধী, সম্মাননীয় সুধী।
সুধি: ‘সুধি’ বাংলা শব্দ। বিশেষ্য পদ। এর আভিধানিক অর্থ চেতনা, বোধ, কাণ্ডজ্ঞান, অনুভব, স্মৃতি, অনুধাবন প্রভৃতি। সুতরাং বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে কোনো ধরনের আমন্ত্রণপত্রে সম্বোধনাত্মক শব্দ প্রয়োগে ‘সুধী’ লিখবো, ‘সুধি’ নয়।
উচ্চারণগত এবং দৃশ্যত কিছুটা মিল থাকা সত্ত্বেও কাঠবিড়ালী ও কাঁখবিড়ালি শব্দদুটোর মধ্যে অর্থগত কোনো সাদৃশ্য নেই। চলো তবে চমৎকার শব্দদুটো সম্পর্কে জেনে নিই।
কাঠবিড়ালী: বাংলা ‘কাঠ’ এবং সংস্কৃত ‘বিড়াল’ শব্দ সহযোগে গঠিত শব্দ ‘কাঠবিড়াল’। এর স্ত্রীবাচক শব্দ হলো ‘কাঠবিড়ালী’। এটি বিশেষ্য পদ। এটি অতি সুপরিচিত বৃক্ষচারী প্রাণীবিশেষ যা ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন এবং বিশেষত বিভিন্ন ধরনের বীজ খেয়ে জীবনধারণ করে। যেটিকে আমরা ইংরেজিতে বলি স্কুইরেল।
কাঁখবিড়ালি: ‘কাঁখ’ ও ‘বিড়ালি’ শব্দ সহযোগে গঠিত শব্দ ‘কাঁখবিড়ালি’। এটি বাংলা শব্দ এবং বিশেষ্য পদ। এর অর্থ হলো বগলের ফোড়া। কাঁখ এবং কাঁক শব্দদুটো সমার্থক। এর অর্থ বগল। সুতরাং বিশেষভাবে মনে রাখবে ‘বিড়ালী’ শব্দটি ‘বিড়াল’ শব্দের স্ত্রীবাচক হলেও ‘কাঁখবিড়ালি’ শব্দের সঙ্গে ‘বিড়াল’-এর কোনো সম্পর্ক নেই। কী, ব্যাপারগুলো দারুণ না!