যে যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেকেই। অনেকেই হারিয়েছেন তাঁদের মূল্যবান সহায়-সম্পদ। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বাঙালির উপরে যে অত্যাচার করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল নতুন রাষ্ট্র, নতুন মানচিত্র ‘বাংলাদেশ’।
Published : 15 Dec 2013, 10:43 PM
আমাদের স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ, তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধ কেন করতে হয়েছিল আমাদের?
ভারত ছিল অবিভক্ত। ১৯৪৭ সালে ভারতকে দুভাগ করে আলাদা দুটি দেশ সৃষ্টি করা হয়। একটার নাম ‘পাকিস্তান’ অন্যটা ‘ভারত’। পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ। একটা পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটা পশ্চিম পাকিস্তান। আমাদের বাস ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। দেশ এক হলেও পশ্চিম পাকিস্তান সবসময় পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করত। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের লোকজনকে নানাভাবে শোষণ করে গোলাম বানিয়ে রাখার চেষ্টায় থাকত। এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের মাতৃভাষার উপর হস্তক্ষেপ ঘটনায়।
পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও তাদের মাতৃভাষা ‘বাংলাকে’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই সময়ে রাষ্ট্রনায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই ঘোষণার প্রতিবাদ জানান আমাদের টগবগে ছাত্র সমাজ।
১৯৫২ সালের পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের পূর্ব বাংলার মানুষকে নতুনভাবে শোষণের চেষ্টায় মেতে উঠল। পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের চা, চামড়া, পাট ইত্যাদি দিয়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় উন্নত করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানকে। এ অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হল পূর্ব বাংলার জনগণ। ধীরে ধীরে আন্দোলন তীব্রতর হতে লাগল। শুরু হল একটার পর একটা প্রতিরোধ।
১৯৬২ সালে সংঘঠিত হল শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন আর ১৯৬৯ সালে হল গণঅভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানে ফিল্ড মার্শাল আইউব খানের বিদায় হলে ক্ষমতায় এলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
তাদের সেই ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তড়িঘড়ি করে ঢাকায় আসেন আলোচনার উদ্দেশে। আলোচনা তো লোক দেখানো। মূল উদ্দেশ্য ছিল সময়ক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানি করা। পূর্ব বাংলার মানুষ আলোচনা থেকে একটা শুভ সংবাদ প্রত্যাশা করেছিল; মনে করা হল এবার হয়তো আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে।
২৬ মার্চ কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান ও পরে ২৭ মার্চ মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এই বেতার ঘোষণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তীব্র গতি সঞ্চার করে। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সাধারণ জনতা একযোগে কাজ করেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামে (বর্তমান নাম মুজিবনগর) স্বাধীনতার সনদ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠনিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচন করা হয়।
১৯৭১ সালে ৩ ডিসেম্বর ভারত সরাসরি আমাদের সহায়তায় নামে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণের সঙ্গে আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা যুক্ত হলে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। পরপর হামলায় দুই চোখ যখন অন্ধ, তখন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির হাজার প্রাণের অগ্নি তরুণদের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাদের পরাজয়ে উদিত হয় একটি নতুন দেশের সূর্য। সূচিত হয় নতুন ইতিহাস। আমরা পাই স্বতন্ত্র ভূখ-, সার্বভৌম জাতিসত্তা, নতুন দেশ। তার নাম বাংলাদেশ।