এক দেশে এক সম্রাট ছিলেন। হয়তো এখনো আছেন।
Published : 03 Feb 2025, 01:27 PM
ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক উমবের্তো একো (১৯৩২-২০১৬)। একাধারে তিনি ছিলেন সাংবাদিক, অধ্যাপক, অ্যাকাডেমিক ও বহুমুখী তাত্ত্বিক। একো সেমিওটিকসের (সংকেতবিদ্যা) ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং অর্থের দর্শনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তার অন্যতম প্রধান রচনা ‘অ্যা থিওরি অফ সেমিওটিকস’। তার দুটি বিখ্যাত উপন্যাস হলো- ‘দ্য নেম অব দ্য রোজ’ ও ‘ফুকো’জ পেন্ডুলাম’।
শিশু-কিশোরদের জন্যও গল্প লিখেছেন এ দার্শনিক। ‘দ্য বম্ব অ্যান্ড দ্য জেনারেল’, ‘দ্য থ্রি অ্যাস্ট্রোনটস’ ও ‘দ্য নওমস অফ ন্যু’ এর মধ্যে অন্যতম। এসব বইয়ের অলঙ্করণ করেছেন ইউজেনিও কার্মি। ‘নওমস’ (Gnomes) বলতে ছোট আকারের কাল্পনিক প্রাণীদের বোঝানো হয়, যাদের সাধারণত গল্প-উপকথায় দেখা যায়। তারা প্রকৃতি ও বনভূমির রক্ষক হিসেবে পরিচিত। আর ‘ন্যু’ (Gnù) হলো গল্পের একটি কাল্পনিক গ্রহ বা স্থানের নাম। সুতরাং, ‘দ্য নওমস অফ ন্যু’ বলতে বোঝানো হয়েছে ‘ন্যু গ্রহের বামুনরা’।
এক দেশে এক সম্রাট ছিলেন। হয়তো এখনো আছেন। তিনি নতুন এক ভূখণ্ড আবিষ্কার করতে চান।
“আমি কেমন সম্রাট,” তিনি চেঁচিয়ে বলতেন, “যদি আমার জাহাজগুলো নতুন কোনো মহাদেশ না খুঁজে পায়? এমন এক ভূখণ্ড, যা সোনা-রূপায় সমৃদ্ধ, উর্বর মাঠে ভরা, এমন এক ভূমি যেখানে আমি আমাদের সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারি?”
তার মন্ত্রীরা উত্তর দেয়, “কিন্তু মহামান্য, এই পৃথিবীতে আবিষ্কারের মতো কিছুই আর বাকি নেই। একবার এই গ্লোবটা দেখুন।”
“ওই নিচের ছোট্ট দ্বীপটা কী?” সম্রাট উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“যদি এটা গ্লোবে দেখা যায়, তবে নিশ্চয়ই বহু বছর আগেই কেউ না কেউ এটি আবিষ্কার করেছে,” মন্ত্রীরা বললেন।
“সম্ভবত ওখানে এখন ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স আর মেরিনা রয়েছে। আর আজকাল নাবিকরা আর সমুদ্রপথে নতুন দ্বীপ বা মহাদেশ খুঁজতে যায় না, তারা এখন মহাকাশযানে গ্যালাক্সি ভ্রমণ করে!”
“তাহলে তাই হোক,” সম্রাট একরোখা হয়ে বললেন, “একজন মহাকাশ অনুসন্ধানকারীকে পাঠাও, এবং তাকে বলো আমার জন্য একটি বাসযোগ্য গ্রহ আবিষ্কার করতে। ছোট হলেও চলবে।”
সুতরাং মহাকাশ অনুসন্ধানকারী (সংক্ষেপে এমএ) মহাকাশের বিশালতা চষে বেড়ালেন, এমন কোনো গ্রহের সন্ধানে যা বসবাসযোগ্য করে তোলা যায়। কিন্তু তিনি কেবল আগ্নেয়গিরি, ধুলো আর পাথরে ভরা গ্রহই খুঁজে পেলেন। একটিও সুন্দর, প্রাণবন্ত গ্রহের দেখা মিলল না।
অবশেষে একদিন, গ্যালাক্সির সবচেয়ে দূরবর্তী কোণে, এমএ তার মেগাগ্যালাকটিক মেগাটেলিস্কোপে তাকিয়ে এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখলেন…। একটি চমৎকার ছোট্ট গ্রহ, নীল আকাশের নিচে কয়েকটি তুলোর মতো সাদা মেঘ ভাসছে, সবুজ উপত্যকা আর বনভূমি এক অপরূপ সৌন্দর্য তৈরি করেছে।
আরও কাছে গিয়ে তিনি দেখলেন, সেই উপত্যকায় নানারকম সুন্দর প্রাণী লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর ছোট ছোট কিছু মানুষ, অদ্ভুত রকমের কৌতুকপূর্ণ কিন্তু আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় গাছ ছাঁটছে, পাখিদের খাওয়াচ্ছে, ঘাস কাটছে। আবার কেউ কেউ স্বচ্ছ নদী ও ঝর্ণার জলে সাঁতার কাটছে, যেখানে নিচে বালির বিছানার ওপর রঙিন মাছের ঝাঁক খেলা করছে।
এমএ সেখানে অবতরণ করলেন। মহাকাশযান থেকে বেরিয়ে এলেন এবং দেখলেন কিছু মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাসিমুখে তারা বলল, “শুভ সকাল, মহাশয়। স্বাগতম, বিদেশি! আমরা ন্যু-এর নওম। আমাদের গ্রহের নাম ন্যু, আর আপনি কে?”
“আমি,” এমএ বললেন, “পৃথিবীর মহান সম্রাটের মহাকাশ অনুসন্ধানকারী, আমি তোমাদের আবিষ্কার করতে এসেছি!”
“আরে, দারুণ কাকতালীয় ব্যাপার!” প্রধান নওম বলল। “আমরা তো ভেবেছিলাম আমরাই আপনাকে আবিষ্কার করলাম!”
“না,” এমএ বললেন, “আমি তোমাদের আবিষ্কার করছি, কারণ আমরা পৃথিবীর লোকেরা তোমাদের অস্তিত্বের কথা জানতাম না। সুতরাং, আমি এই গ্রহটিকে আমার সম্রাটের নামে দাবি করছি, যাতে আমরা তোমাদের এখানে সভ্যতা নিয়ে আসতে পারি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে,” প্রধান নওম বলল, “আমরা তো জানতামই না যে তোমরা আছো। কিন্তু এ নিয়ে আমরা তর্ক করব না, কারণ এতে আমাদের দিনটাই মাটি হবে। বলো তো, এই সভ্যতা জিনিসটা কী?”
“সভ্যতা!” এমএ বললেন, “সভ্যতা হলো এমন সব আশ্চর্যজনক কিছু, যা পৃথিবীর মানুষ আবিষ্কার করেছে, এবং আমার সম্রাট ইচ্ছা করেছেন তা বিনামূল্যে তোমাদের দিয়ে দেবেন।”
“বিনামূল্যে!” নওমরা আনন্দে বলল, “আমরা এক্ষুণি গ্রহণ করতে রাজি! তবে, দয়া করে আমাদের একটু বুঝিয়ে বলুন, এই সভ্যতা কেমন?”
এমএ একটু বিরক্ত হলেন, কারণ তার স্কুলে শেখানো হয়েছিল যে, একসময় যখন অভিযাত্রীরা নতুন ভূমিতে সভ্যতা নিয়ে যেত, তখন আদিবাসীরা বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করত। তবুও, তিনি তার গর্বিত পৃথিবীর সভ্যতা দেখানোর জন্য মহাকাশযান থেকে মেগাগ্যালাকটিক মেগাটেলিস্কোপ বের করলেন এবং পৃথিবীর দিকে তাক করলেন।
“এসো, নিজ চোখে দেখে নাও।”
“কি দুর্দান্ত যন্ত্র! কী প্রযুক্তি!” নওমরা বিস্ময়ে বলল। একে একে তারা এতে চোখ রাখল।
“কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!” প্রথম নওম বলল, “শুধু ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি।”
এমএ নিজেও দেখলেন, তারপর বললেন, “ওহ! ভুল হয়ে গেছে! আমি একটা শহরের দিকে তাক করেছিলাম। সব কারখানা, চিমনি, ট্রাক আর গাড়ির ধোঁয়ায় একটু স্মগ (দূষণ) তৈরি হয়েছে…”
“বুঝতে পারছি,” নওম বলল, “আমাদের এখানেও মেঘলা দিনে পাহাড় দেখা যায় না। কিন্তু কাল হয়তো আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন আমরা এই শহর ব্যাপারটা ভালো করে দেখতে পারব।”
“আফসোস, সেটা সম্ভব নয়,” এমএ বললেন। “ওখানে স্মগ তো রোববারও কমে না।”
“কী দুঃখজনক!” নওম বলল। এভাবে নওমরা একে একে পৃথিবীর বায়ুদূষণ, জলদূষণ, বন উজাড়, প্লাস্টিকের আবর্জনা, যানজট ও দুর্ঘটনা দেখতে লাগল। সবকিছু দেখে তারা বলতে লাগল, “কী লজ্জার ব্যাপার!”
অবশেষে প্রধান নওম বলল, “মিস্টার আবিষ্কারক, আমরা আর কিছু দেখতে চাই না। তোমাদের সভ্যতা নিঃসন্দেহে চমৎকার, কিন্তু যদি এটি এখানে নিয়ে আসো, তবে আমাদের বন-জঙ্গল, নদী-ঝর্ণা সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের দয়া করে আবিষ্কার করো না!”
শেষে প্রধান নওম একটি প্রস্তাব রাখল, “আমরাই বরং পৃথিবীতে গিয়ে তোমাদের আবিষ্কার করি! তারপর তোমাদের শেখাবো কীভাবে প্রকৃতি পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়, গাছ লাগাতে হয়, আর দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হয়। হয়তো কয়েক বছর পর, পৃথিবী আবার ন্যু-এর মতো সুন্দর হয়ে উঠবে!”
এমএ ভাবতে লাগলেন, সত্যিই যদি পৃথিবী এমন হয়! তিনি সম্রাটের কাছে ফিরে এসে পুরো গল্প বললেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বললেন, “ওসব নওমদের আমাদের দেশে আসতে দিতে হলে প্রচুর অনুমতি লাগবে! ভিসা, ট্যাক্স, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, বন্দরের অনুমতি- সব ঠিক করতে হবে!” এই বলে প্রধানমন্ত্রী নিজের থুতু ফেলা চুইংগামে পিছলে পড়ে গেলেন, হাত-পা ভেঙে একগাদা আবর্জনার মধ্যে পড়লেন এবং গাড়ির ধোঁয়ার ধাক্কায় ঢেকে গেলেন।
এই গল্পের আপাতত এখানেই শেষ। তবে আমরা একটা প্রশ্ন রেখে যেতে চাই- যদি ন্যু-এর নওমরা না আসে, তাহলে আমরাই কেন তাদের মতো হতে পারি না?