আল মাহমুদের গ্রাম

পৃথিবীটাকে যেন নিজের একটি ছোট্ট গ্রাম বানিয়ে ফেলেছেন কবি আল মাহমুদ তার কবিতায়।

আবু আফজাল সালেহআবু আফজাল সালেহ
Published : 2 Oct 2022, 05:27 PM
Updated : 2 Oct 2022, 05:27 PM

ছোট ছোট গ্রাম মিলে আমাদের এই দেশ, বিশাল পৃথিবী। গ্রামের আছে নিজস্ব জীবনীশক্তি। পৃথিবীটাকে যেন নিজের একটি ছোট্ট গ্রাম বানিয়ে ফেলেছেন কবি আল মাহমুদ তার কবিতায়। তার ‘পাখির মতো’ কবিতাটি কতই না সুন্দর! শৈশবের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এ কবিতা।

‘আম্মা বলেন, পড়রে সোনা

আব্বা বলেন, মন দে;

পাঠে আমার মন বসে না

কাঁঠালচাঁপার গন্ধে

তোমরা যখন শিখছো পড়া

মানুষ হওয়ার জন্য,

আমি না হয় পাখিই হবো,

পাখির মতো বন্য।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসপাড়ের গ্রামে বেড়ে ওঠা আল মাহমুদ নিবিড় গ্রাম্য প্রকৃতি, তিতাসের মতো ছোট-বড় অনেক নদ-নদী, খাল-বিল, খড়ের গম্বুজ, নর-নারী, নিসর্গ গ্রামীণ দৃশ্য ও প্রকৃতি নিয়ে কবিতা বা কথাসাহিত্য রচনা করেছেন।  

প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে। কিন্তু সবাই গ্রামের দিকে ইতিবাচকভাবে তাকাতে পারে না। কবি আল মাহমুদ পেরেছিলেন।

গ্রাম হলো এমন জায়গা যেখনে এখনও মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, একে অপরের খবর নেয়। গ্রামে মাটির স্পর্শ মেলে। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে। কিন্তু সবাই গ্রামের দিকে ইতিবাচকভাবে তাকাতে পারে না। কবি আল মাহমুদ পেরেছিলেন। গ্রামের চিরচেনা দৃশ্য ও প্রকৃতি তাকে একাকার করে ফেলেছিল। অন্যদিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নাগরিকতা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে গ্রাম ও গ্রামীণ জনপদকে। চিন্তিত আল মাহমুদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে তাই মিশে থাকার প্রবল আকুতি:

‘কতদূর এগোলো মানুষ!

কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে

আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে

কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে

ভাবলাম, এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার…’ (প্রকৃতি, সোনালী কাবিন)

একটি নতুন শিশু বেড়ে উঠতে পারে একটি সুন্দর গ্রামে। কোনরকম পরিকল্পনা না করেই একটি ছোট্ট গ্রামে হারিয়ে যাওয়া সম্ভব। কোলাহল নেই এমন কোন গ্রামের মৃদুমন্দ বাতাস অনুভূতিতে দোলা দেয়। পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ, তিনি যেন সেই অনুভূতিকেই শব্দে রূপান্তরিত করেছেন।

তার প্রবেশলগ্নের দেশজ উপাদান দিয়েই আকৃষ্ট করেছিলেন পাঠককে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ এর বেশকিছু কবিতায় গ্রামীণ ঐতিহ্যলগ্নতার আভাস পাওয়া যায়। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কলস’ এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’-এ এসে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।

‘তোমাকে বসতে হবে এখানেই

আদরে এগিয়ে দেওয়া হুঁকোটাতে সুখটান মেরে

তাদের জানাতে হবে কুহলি পাখির পিছুপিছু

কতদূর গিয়েছিলে পার হয়ে পানের বরুজ।’ (প্রকৃতি/ সোনালী কাবিন)

ছোট্ট গ্রাম থেকেই আল মাহমুদের চিন্তা যেন বড় পরিসর পেয়েছিল, গ্রামের সৌন্দর্য ছবির চেয়েও আরও বাস্তব হয়ে ওঠেছে তার কাব্যছন্দে।

গ্রাম আছে বলে আমাদের চিন্তা দৃশ্য পায়, গ্রাম হারিয়ে গেলে মানুষের নিজেকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ছোট্ট গ্রাম থেকেই আল মাহমুদের চিন্তা যেন বড় পরিসর পেয়েছিল, গ্রামের সৌন্দর্য ছবির চেয়েও আরও বাস্তব হয়ে ওঠেছে তার কাব্যছন্দে। গ্রামের সৌন্দর্য যাকে মুগ্ধ করে মাহমুদের কবিতাও তাকে মুগ্ধ করবে।

আল মাহমুদের ‘কবিতা এমন’ কবিতায় গ্রামই যেন কবিতা, গ্রামীণ পরিবেশ ও দৃশ্য নিয়ে সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশের কবিতা। কবিতার শরীরে থাকবে গ্রামের বিভিন্ন দৃশ্য, অনুভূতি আর পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা, অনুষঙ্গ। তার কাছে কবিতা মানেই গ্রাম-

‘কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী

কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন

পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ

মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর

বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।

কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস

ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর

গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর

কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’ (কবিতা এমন/ সোনালী কাবিন)

গ্রামীণ ও লোকজ উপাদানে ভরপুর কবিতা নতুন পাঠক সৃষ্টি করছে। এসব গুণের কারণে আল মাহমুদের কবিতার আলোচনা ও সমালোচনা বেড়ে যাচ্ছে, জীবনানন্দের মতো দ্রূত না বাড়লেও শিল্পমান নিয়ে নতুন করে আলোচনা বেড়েছে। তার কবিতায় যেমন মানুষ আছে তেমনই গ্রাম আছে মিশে।

গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে তার লৌকিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনাচরণ। কবি আল মাহমুদ এসব নিয়েই ছড়া-কবিতা বা সাহিত্যরচনা করেছেন। তিনি লোকজ-উপাদানে শৈল্পিক করে তুলেছেন কবিতা ও ছড়া। তার স্মৃতিকাতর এমন কবিতা পড়লে পাঠক ফিরে যাবেন অতীতে। মেঘনার জল, ফসলের আদিগন্ত সবুজ, গরুর গোয়াল, জলপ্রিয় পাখি, কৈশোরের স্মৃতি, মায়ের মুখ, হলুদ পাখি, পাতার আগুন, রাতজাগা ছোট ভাই-বোন, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি, হাঁটুজল নদী, কুয়াশা-ঢাকা পথ, ভোরের আজান, নাড়ার দহন, তিলের সৌরভ, মাছের আঁশটে গন্ধ, বাঁশঝাড়ে দাদার কবর, বইয়ের মলাট, অসুখী কিশোর, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান, দাঙ্গার আগুন, নিঃস্ব অগ্রজের কাতর বর্ণনা, চরের পাখি, হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস, দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর, গোপন চিঠির প্যাড, নীল খাম, মক্তবের চুলখোলা মেয়ে, ঢেউয়ের পাল ইত্যাদির মতো স্মৃতিকথার উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তার কবিতায়।

গ্রামে কোন আড়াল নেই। আজ শহুরে মানুষেরা গ্রাম-পাগল। আমরা নিজের সম্পর্কে অনেককিছু কেবল গ্রামে গেলেই আবিষ্কার করতে পারি। গ্রামে আমরা পাই শান্ত পরিবেশ, ধীর হাওয়া এবং হৃদয়ের গভীর তলদেশের প্রতিধ্বনি। গ্রাম ও গ্রামীণ উপাদান, পরিবেশ-প্রতিবেশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আল মাহমুদের কবিতা ও ছড়ায়। তার লেখা এমন কবিতা ও ছড়ার সংখ্যা কিন্তু কম নয়, অনেক বেশি। 

আল মাহমুদ ‘এভাবে সন্ধ্যা নামে, সব পাখি ফিরে যায় নীড়ে...' (প্রকৃতি), ‘কোনো নারী কোনোদিন তার তরে মাখেনি কাজল' (প্রকৃতি), ‘আমার চেতনা যেন শাদা এক সত্যিকারের পাখি/ বসে আছি সবুজ অরণ্যে' (লোক-লোকান্তর), ‘ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা/ সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে/ কবিতা বোঝে না!' (অবুঝের সমীকরণ), ‘দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী/ উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি' (প্রত্যাবর্তন), ‘পাখির ছতরে/ চুম্বনী রাশী' (সোনালী কাবিন), ‘বাতাসের ফেনা' (বাতাসের ফেনা)’ ইত্যাদির মতো গ্রামীণ শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন। বাংলার মানুষ আর প্রকৃতিকে তিনি অভিন্ন করে ফেলেছেন। তাই আল মাহমুদ অনায়াসে বলতে পারলেন, ‘পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই’।

‘নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল

ডাবের মত চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল।

পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লালদিঘির ঐ পাড়

এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার  

আমায় দেখে কলকলিয়ে দিঘির কালো জল

বললো, এসো, আমরা সবাই না-ঘুমানোর দল—

পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।‘ (পাখির কাছে ফুলের কাছে) 

আল মাহমুদ তার কবিতায় পুরো পৃথিবীটাকে যেন নিজের একটি ছোট্ট গ্রাম বানিয়ে ফেলেছেন। আকাশ, মেঘমল্লা, গাছপালা, পাখি, বিভিন্ন ফলমূল, সবজি, পুকুর, নদী, বিল, খেত, মাছধরা, বর্ষা, আগান-বাগান, ঘুড়ি, গান প্রসঙ্গ চলে এসেছে অবলীলায়। কবিতা ও ছড়ায় এসব উপাদানের বিস্তৃত ব্যবহার পাঠকের মনে স্থায়ী হয়েছে। ফলে আল মাহমুদ অধিক পঠিত হচ্ছেন, ক্রমশ উজ্জ্বলতর হচ্ছে তার কবিতা, গোটা কথাসাহিত্য। 

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!