অনূদিত গল্প
কাঠুরে বলে, ‘তুমিই তো আমার হারিয়ে যাওয়া ভাই, যে কিনা আগে মানে জন্মের সময় মানুষ ছিলে।’
Published : 29 Sep 2024, 01:34 AM
বই: টেইলস অফ কোরিয়া, লেখা: ইম ব্যাং ও উই ইয়া, ইংরেজি অনুবাদ: জেমস এস গেইল, প্রকাশনী: টাটল পাবলিশিং
অবশ্যই অনেক অনেক দিন আগের কথা। কোরিয়ার পাহাড়ের উপত্যকায় বাস করতো এক কাঠুরে আর তার মা। কাঠুরে দিনের বেলা পাহাড়ি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতো।
একদিন ভালো কাঠের সন্ধানে কাঠুরে পাহাড়ের অনেক উপরে উঠে গেলো আর আচমকা সে দেখতে পেলো বিশাল এক বাঘ! বাঘটাকে দেখে তো কাঠুরের অবস্থা খারাপ। ভয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সে মনে মনে ভাবে, আজ বুঝি বাঘের পেটেই যেতে হবে।
বাঘটা আরো খানিক এগিয়ে এলে কাঠুরেকে দেখতে পায় আর নিজের নিশানা কাঠুরের দিকে স্থির করে এগিয়ে আসতে থাকে। কাঠুরে মনের মধ্যে একটা ফন্দি আঁটে আর ভাবে, নাহ! কিছুতেই বাঘের পেটে যাওয়া যাবে না।
কাঠুরে বুদ্ধি নেড়ে ফন্দি আঁটতেই বাঘটা অনেকটা কাছে চলে আসে। আর তখনই কাঠুরে বলে উঠে, ‘আহা ভাই আমার! কতদিনের আশা আমার পূরণ হলো। আয় ভাই আমার কাছে আয়’।
কাঠুরের কথা শুনে বাঘ চমকে যায়। যে কাঠুরের বাঘকে ভয় পাওয়ার কথা সে কিনা কাছে ডাকছে? দ্বিধায় পরে বাঘ জিজ্ঞেস করে, ‘এই লোক! তুমি আমাকে ভাই বলে ডাকছো কেন?’
কাঠুরে তখন বলে, ‘তুমিই তো আমার হারিয়ে যাওয়া ভাই, যে কিনা আগে মানে জন্মের সময় মানুষ ছিলে।’ কাঠুরের কথা শুনে বাঘ আরো চিন্তায় পড়ে যায়, ‘মানে? কী বলছো তুমি এইসব!’
কাঠুরে তখন বলতে থাকে, ‘আমি মায়ের কাছে শুনেছি, আমার এক বড় ভাই ছিলো যে কিনা মানুষ থেকে বাঘ হয়ে যায় আর সে দেখতে অনেক লম্বা, লম্বা তার লেজ আর লেজের মধ্যে কালো চাকতির দাগ। তোমাকে কত খুঁজেছি, আজ পেলাম। চলো ভাই মায়ের কাছে চলো। মা তোমাকে দেখে চোখ জুড়াক।’
বাঘ সব কথা শুনে আবেগী হয়ে পড়ে আর ভাবতে থাকে আসলেই হয়তো সে আগে মানুষ ছিলো, পরে বাঘ হয়ে গেছে। বাঘের চোখে পানি চলে আসে।
বাঘটা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘না ভাই। আমাকে এই অবস্থায় দেখে মা ভয় পাবে। তার চেয়ে সঠিক সময়ের আগ পর্যন্ত তুমিই মায়ের খেয়াল রাখো। আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। একটু আগে আমি কিনা তোমাকে খাওয়ার কথা ভাবছিলাম। বিদায় ভাই।’
এ কথা বলেই বাঘটা বনের ভেতরে উধাও হয়ে যায় আর কাঠুরে প্রাণ নিয়ে দ্রুত নিজের বাড়ি চলে আসে।
পরদিন সকালে কাঠুরের বাড়ির পেছনে এক আজব কাণ্ড ঘটে। কেউ একটা বন্য শূকর শিকার করে রেখে গেছে তাদের খাবার হিসেবে। ভালো মতো খেয়াল করে কাঠুরে বুঝতে পারে এটা তার পাতানো বাঘ ভাইয়ের কাজ। বাঘটা মন থেকেই তাকে নিজের ভাই বলে মেনে নিয়েছে আর নিজের ভাই আর মায়ের জন্য খাবার দিয়ে গেছে।
কাঠুরে মনে মনে ভাবলো, ভালোই হয়েছে। এখন আর বনের মধ্যে যেতেও কোন ভয় নেই। তবে এখন থেকে দুই ভাইয়ের পক্ষ থেকে আমাকেই আরো বেশি করে মায়ের খেয়াল রাখতে হবে, মায়ের যত্ন নিতে হবে।
এভাবেই দিন চলতে লাগলো। কিছুদিন পরপরই বাঘ ভাই এসে কাঠুরের বাড়ির পেছনে নানা রকম প্রাণী শিকার করে রেখে যেতে লাগলো। কাঠুরে আর তার মা বাঘের কাছ থেকে পাওয়া উপহারে আরো ভালোমতো দিন কাটাতে লাগলো। এভাবে নির্বিঘ্নে কেটে গেলো অনেক দিন।
তিন বছর পর, পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কাঠুরের মা মৃত্যুবরণ করলো। মনের কষ্ট চাপা দিয়ে বনের মধ্যে মাকে কবর দিয়ে কাঠুরে একা একা দিন কাটাতে লাগলো। একদিন কাঠুরে খেয়াল করলো, এখন আর বাঘটা কোন উপহার রেখে যায় না। কাঠুরে ভাবলো, বাঘটা হয়তো জেনে গেছে মা আর নেই। তাই হয়তো সে উপহার পাঠানো থামিয়ে দিয়েছে। সেই কারণে অবশ্য কাঠুরে কোন দুঃখ পেলো না।
তারও কিছুদিন পর কাঠুরে আবার পাহাড়ি বনের দিকে গেলো আর দেখতে পেলো তার মায়ের কবর ঘিরে ঘুরছে পাঁচটা বাঘের ছানা। বাঘের ছানাগুলোর লেজে কালো চাকতির মতো দাগ। কাঠুরেকে দেখে বাঘের ছানাগুলো দৌড়ে কাছে এলো আর বলতে লাগলো, ‘চাচা! তুমি এসেছো? আমরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। জানো চাচা? দাদি মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরই বাবা মারা যায়। বেঁচে থাকতে বাবা বলতো সেও নাকি তোমার মতো একজন মানুষ ছিলো!
সব শুনে কাঠুরে স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে তখন বুঝতে পারে তার বাঘ ভাই তাদের মায়ের কতটা কর্তব্যপরায়ণ ছেলে ছিলো। এখন তার মায়ের জন্য উপযুক্ত নাতি-নাতনিদের রেখে গেছে যারা কবরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে আসে।