কাটিমের সুতার মতো যখন আমরা কথার সূত্র হারিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করি তখনই মূলত কথার খেই হারিয়ে ফেলি।
Published : 13 Oct 2023, 07:46 AM
অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।
ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এ জন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের অর্থের গল্প।
বাংলায় ‘প্রেক্ষিত’ ও ‘পরিপ্রেক্ষিত’ বহুল ব্যবহৃত দুটো শব্দ। সাম্প্রতিক সময়ে শব্দদুটোর ভুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধারণা করা যায়, পরিপ্রেক্ষিত স্থলে প্রেক্ষিত শব্দ ব্যবহারের প্রবণতাই তুলনামূলক বেশি। অনেকে জেনে বা না জেনে শব্দদুটো একটি অপরটির স্থলে ব্যবহার করে চলেছেন। তবে চলুন শব্দদুটোর অর্থ, ব্যুৎপত্তি, উচ্চারণ এবং যথাযথ প্রয়োগক্ষেত্র সম্পর্কে জেনে নিই।
প্রেক্ষিত: এটি সংস্কৃত শব্দ। শব্দটির ব্যুৎপত্তি [স. প্র+√ঈক্ষ্+ত]। শব্দটি মূলত সংস্কৃত ‘প্রেক্ষণ’ শব্দের বিশেষণ। ‘প্রেক্ষণ’ শব্দের অর্থ দর্শন বা দৃষ্টি; চোখ, নয়ন প্রভৃতি। সে হিসেবে প্রেক্ষিত অর্থ হলো প্রেক্ষণ বা দর্শন করা হয়েছে এমন; দেখা হয়েছে এমন। যেমন: ‘প্রেক্ষিত স্থান’ অর্থাৎ দর্শন করা বা দেখা হয়েছে এমন স্থান।
পরিপ্রেক্ষিত: এটি সংস্কৃত শব্দ। শব্দটির ব্যুৎপত্তি [স. পরি+ প্র+√ঈক্ষ্+ত]। শব্দটি বিশেষ্য। পরিপ্রেক্ষিতের অর্থ প্রেক্ষাপট, পটভূমি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অনুষঙ্গ প্রভৃতি। যেমন: ‘এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আবার আলোচনায় বসা প্রয়োজন’ বা ‘বিষয়টি বিচার করতে হবে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে’ অর্থাৎ বাক্য দুটোতে পরিপ্রেক্ষিতে মানে হলো ‘এ প্রেক্ষাপটের আলোকে’ বা ‘এ অবস্থাদৃষ্টে’। এর ইংরেজি হলো Perspective। পরিপ্রেক্ষিত শব্দটির আরেকটি বিশেষায়িত অর্থ (পদার্থবিজ্ঞানে) হলো দৃশ্যমান বস্তুর বিভিন্ন অংশের আকৃতি তুলনামূলক দূরত্ব, ঘনত্ব, নৈকট্য প্রভৃতি চিত্রের মাধ্যমে প্রতিফলন।
‘প্রেক্ষিত’ ও ‘পরিপ্রেক্ষিত’ শব্দদুটো ব্যবহারের ভ্রান্তি দূর করতে আরেকটি খেয়াল রাখার মতো বিষয় হলো এর উচ্চারণ। দুটো শব্দের উচ্চারণ স্পষ্টতই আলাদা। ‘পরিপ্রেক্ষিত’-এর উচ্চারণ হলো /পরিপ্রেক্খিত্/ আর ‘প্রেক্ষিত’-এর উচ্চারণ হলো /প্রেক্খিতো/। অর্থাৎ ‘পরিপ্রেক্ষিত’ শব্দের শেষে ‘ত’ উচ্চারিত হয় আর ‘প্রেক্ষিত’ শব্দে শেষে ‘তো’ উচ্চারিত হয়। সুতরাং উচ্চারণগত দিক থেকেও কিন্তু শব্দদুটো একটি আরেকটির বিকল্প হতে পারে না। অর্থ তো অনেক দূরের কথা!
সারকথা হলো ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অর্থে ‘প্রেক্ষিত’ লেখা স্পষ্টতই ভুল। সুতরাং প্রেক্ষাপট, অনুষঙ্গ, পটভূমি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, দৃশ্যপট প্রভৃতি অর্থে অবশ্যই পরিপ্রেক্ষিত লিখুন, প্রেক্ষিত নয়।
আমরা যখন কোনো প্রসঙ্গে ‘থ হই’ সেটি এই বর্ণমালার ‘থ’ নয়। ‘থ’ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো পর্বত। যেটি এসেছে সংস্কৃত ‘স্থির’ শব্দ থেকে।
আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে প্রায়ই বলি “তোমার কথা শুনে আমি ‘থ’ হয়ে গেলাম।” এই ‘থ হওয়া’ মানে কী? ‘থ’ তো বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের একটি বর্ণ। আমি ‘থ’ কেন? ব্যঞ্জনবর্ণের অন্য কোনো বর্ণ কেন নয়? তবে চলুন জেনে নিই কেন এই ‘থ’ হওয়া।
থ: ‘থ’ বাংলা বর্ণমালার সতেরোতম ব্যঞ্জনবর্ণ এবং দন্তদ্বারা উচ্চার্য ‘ত’-এর অঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনির দ্যোতক। শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, আমরা যখন কোনো প্রসঙ্গে ‘থ হই’ সেটি এই বর্ণমালার ‘থ’ নয়। ‘থ’ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো পর্বত। যেটি এসেছে সংস্কৃত ‘স্থির’ শব্দ থেকে। পর্বত অর্থে ‘থ’ শব্দের ব্যবহার অন্ত্যমধ্যযুগের বাংলা কবিতায় শেষবারের মতো দেখতে পাওয়া গেলেও তারপর এর দেখা আর তেমনভাবে পাওয়া যায়নি। এরপর থেকে শুরু হয় ‘থ’ শব্দের আলংকারিক বা উপমাঘটিত প্রয়োগ।
‘থ’ শব্দের অর্থ ১. হতভম্ব, অভিভূত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় (‘কিন্তু তার পরের অবস্থা দেখে সে থ’-সৈয়দ মুজতবা আলী); ২. নির্বাক, স্তম্ভিত (‘কাল ওস্তাদের হাতে সঁপে দিয়ে সে থ’-শওকত ওসমান); ৩. অবাক; বিস্মিত; অপ্রতিভ (‘ওকে ধমকিয়ে থ বানিয়ে দাও’-সদ)। ৪. পাষাণ; পর্বত; অচল (‘থকারে পাথর তুমি থকারের মেয়ে’-ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর) প্রভৃতি।
মূলত এই চার নম্বর অর্থটির আলংকারিক প্রয়োগ থেকেই ঘটনাচক্রে আমরা ‘থ’ হওয়া শিখি। ‘থ’ যেমন নিশ্চল-নীরব হয়ে থাকে, তার এই ভাবটিই আমরা গ্রহণ করি পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে যখন আমাদের মুখে আর কোনো কথা আসে না, আমরা হয়ে পড়ি পর্বতবৎ মৌন ও স্থির।
খেই শব্দের একটি অর্থ হলো সুতার প্রান্ত বা মুখ। তাঁতিদের কাপড় বোনার সময় টানা কিংবা পোড়েনের সুতা ছিঁড়ে গেলে তাঁতি সুতার খেই হারিয়ে ফেলেন।
আমাদের দৈনন্দিন আলাপ-আলোচনায় ‘খেই হারানো’ শব্দবন্ধটি প্রায়ই ব্যবহার করি। সাধারণত কোনো বিষয়ে কথা বলার সময় আমরা যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়টি ব্যতিরেকে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করি তখনই এ শব্দবন্ধটির ব্যবহার আমরা করতে দেখি। আমরা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলি ‘তুমি বোধহয় কথার খেই হারিয়েছ।’ এখন প্রশ্ন হলো এই খেই শব্দের মানে কী? আর কেন আমরা বারবার এই ‘খেই’ হারিয়ে ফেলি। তবে চলুন জেনে নিই ‘খেই হারানো’ মানে কী।
‘খেই’ শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে সংস্কৃত ‘ক্ষেপ’ শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো: ১. সুতার প্রান্ত বা মুখ। ২. সুতার সংখ্যা (পাঁচ খেই)। ৩. ধারা, প্রসঙ্গ, সূত্র (কথার খেই হারানো)। ৪. সন্ধান (হঠাৎ হারায় তোমার পথের খেই)। ইতোমধ্যে নিশ্চয় আপনারা খেই শব্দের এক নম্বর অর্থটি পড়েছেন। ঠিক এ অর্থটি থেকেই এই খেই হারানোর প্রসঙ্গটির অবতারণা।
খেই শব্দের একটি অর্থ হলো সুতার প্রান্ত বা মুখ। তাঁতিদের কাপড় বোনার সময় টানা কিংবা পোড়েনের সুতা ছিঁড়ে গেলে তাঁতি সুতার খেই হারিয়ে ফেলেন। এতে তাঁতিকে পড়তে হয় মহা ঝামেলায়। এই খেই খুঁজে বের করে পুনরায় জোড়া দিয়ে আবার বুননকর্ম শুরু করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া কাটিম থেকে সুতা বের করার সময় যদি খেই খুঁজে না পাওয়া যায় তখনও তাঁতিকে ঝামেলা পোহাতে হয়। মূলত সুতার এই খেই হারানোর বিষয়টিই আলংকারিক রূপে তাঁতশিল্প থেকে উঠে এসেছে আমাদের দৈনন্দিন মুখের ভাষায়।
আমরা অনেক সময় কথা বলা বা গল্প করার সময় প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলি। কাটিমের সুতার মতো যখন আমরা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কথার সূত্র হারিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করি তখনই মূলত কথার খেই হারিয়ে ফেলি। ইংরেজিতে এ বিষয়টিকে আমরা বলতে পারি Lose one's clue; miss a link; be confounded; be at one's wit's end।
খেই হারিয়ে যেমন কাপড় বুনন অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে তেমনি কথার খেই হারিয়ে আমরা হয়ে উঠতে পারি অন্যের বিরক্তি বা ভুল বোঝাবুঝির কারণ। সুতরাং খেই হারানো চলবে না, সতর্ক থাকুন।