অনূদিত গল্প
লোইজ এগিয়ে চলল শহরের রাস্তা দিয়ে। দেখলো, রাস্তার পাশে একজন উন্মুল মানুষ মুখে হারমোনিকা নিয়ে আপন মনে বাজিয়ে চলেছে।
Published : 14 Nov 2024, 10:51 AM
১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী টনি মরিসনের লেখা ৮টি গল্পের বই নিয়ে সংকলন ‘অ্যা টনি মরিসন ট্রেজারি’, ২০২৩ সালে এটি প্রকাশ করে মার্কিন প্রকাশনী সংস্থা ‘সাইমন অ্যান্ড শুস্টার’। আজ প্রকাশিত হলো সেই বইয়ের অনূদিত অষ্টম পর্ব ‘প্লিজ লোইজ’।
একসময় এক শহরে লোইজ নামে একটা মেয়ে বাস করতো। তাদের পরিবারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই সবাইকেই সংসারের কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে হতো।
কিন্তু লোইজ ছিল খুব ভিতু। তার আত্মবিশ্বাস ছিল না একটুও। সে কোনোকিছু কল্পনা করতে ভীষণ ভয় পেত। সে সবসময়ই মনে মনে অজানা আতঙ্কে ভুগতো।
বর্ষাকালের একদিন সে শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, যদি কোনকিছু কুড়িয়ে পাওয়া যায়! যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে, তাই সে রেইনকোর্ট আর পায়ে গামবুট পরে নিল। তার এক হাতে ছিল ছাতা আর অন্যহাতে ছিল তার ছোট্ট টানা গাড়ি।
বের হওয়ার সময় তার মনে ভয় কাজ করতে শুরু করলো। সে মনে মনে বলল, কোনো জিনিসকে আমরা যা ভাবি সেটা তা না-ও হতে পারে। সে মনে মনে ভাবলো, আমি মাঝেমধ্যে একাকিত্ব এবং দুঃখিত বোধ করতেই পারি। তাই বলে তো আর পুরো পৃথিবী খারাপ হয়ে যাচ্ছে না।
আকাশটা ধূসর হয়ে আছে, কিন্তু সেটাতো আর সারাক্ষণ স্থায়ী হবে না। আর বৃষ্টির পরে পাখিরা আবার ডাকবেই। সে নিজেকে নিজে বুঝাতে শুরু করলো, এই গাছগুলোর ভেতর কোনকিছুই লুকিয়ে নেই।
লোইজ এগিয়ে চলল শহরের রাস্তা দিয়ে। দেখলো, রাস্তার পাশে একজন উন্মুল মানুষ মুখে হারমোনিকা নিয়ে আপন মনে বাজিয়ে চলেছে। শুরুতে সে যথারীতি ভয় পেয়েছিল। পরে চিন্তা করলো একটু দাঁড়িয়ে শুনেই দেখি না কেমন লাগে।
তার কাছে সুরটা বেশ ভালোই লাগলো। রাস্তার পাশে পার্ক করা পুরোনো গাড়ির দিকে সে আড়চোখে তাকালো। এখানে একটা ছোট কুকুর সবসময়ই তাকে দেখে ডেকে ওঠে।
সে আরও একটু এগিয়ে গেলে পুরোনো বাড়িটা দেখতে পেল। যেটাকে তার কাছে সবসময়ই ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হয়। পরে তার মনে হলো, এটার একটু যত্ন নিলেই তো সুন্দর একটা বাড়ি হতে পারে। আর সেখানে অনেক মজার ঘটনা ঘটতে পারে।
আরও একটু এগিয়ে গেলেই সে একটা জাংক ইয়ার্ড দেখতে পেল। সেখানে সব পুরোনো জিনিসপত্র গাদাগাদি করে রাখা। সেটাকে দেখলেই তার কাছে একটা ফাঁদ মনে হয়। নিশ্চয়ই এখানে ভূতেরা আর দৈত্য-দানোরা বসে বসে ঝিমায়। তখন তার মনে হলো, এগুলো শুধুই আমার মনের কল্পনা। কারণ আমি এগুলো সম্পর্কে কিছুই জানি না।
আরও একটু এগিয়ে গেলেই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। তখন সে আশ্রয়ের জন্য একটা জায়গা খুঁজতে শুরু করলো। সামনেই সে একটা ভবন দেখতে পেল। তার চূড়ায় সে একটা পাখি দেখতে পেল। তার মনে হলো এটা কোন শিকারি পাখি নয় তো!
পরক্ষণেই মনে হলো, এটাতো একটা সাধারণ ঈগল পাখিও হতে পারে! সে ভয়ে ভয়ে ভবনের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। সেখানে সারি সারি আলমারিতে থরে থরে হাজার হাজার বই সাজানো ছিল। লোইজের মনে হলো, সে এখানে আর একা নয়। কারণ তার চারপাশে রয়েছে অনেক অনেক বই।
সে একটা করে বই নিয়ে পড়তে শুরু করলো। তার মনে হলো, বই সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বই তাকে স্বপ্ন দেখায়। বই থেকে সে অনেককিছু জানতে পারে। নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করতে পারে। বই তার চিন্তাশক্তি বাড়িয়ে দেয়। তার কল্পনাগুলো তখন পাখা মেলে। সে তার টানাগাড়ি ভর্তি করে বই নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
এরপর সে অনবরত পড়তে থাকলো। সে জানতে পারলো, ভেনিস শহর সমুদ্রের উপর বসে আছে। যখন জলদস্যুদের জাহাজগুলো সমুদ্রে পাড়ি জমায় তখন ডলফিনদের দল তাদের সাহায্যে করে। কোনো এক রাজপ্রাসাদে এক বন্দিনী রাজকুমারী অবিরাম কেঁদে চলেছে। জুজু নামের এক সিংহ শাবক তার বনের মধ্যে তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে।
যখন লোইজ গল্পগুলো পড়তে থাকলো, তার মনে হলো এগুলোই তার পৃথিবী। তার মনে হলো, বই পড়া খুবই আনন্দদায়ক। কারণ বইয়ের পাতায় সৌন্দর্য ও বিস্ময় লুকিয়ে থাকে। এরপর তার মনের মধ্যে আর কোন ভয়ডর রইলো না। সে আশপাশের সবকিছুই নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করলো।
পথের পাশের দৃশ্যগুলো তার কাছে তখন খুবই উপভোগ্য মনে হলো। রাস্তার পাশের মানুষগুলোকে দেখে তখন আর ভয় লাগলো না। ছোট কুকুরের ডাককেও আর ভীতিকর লাগলো না। সে নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে পারলো। কারণ বই তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। এভাবেই বই ছোট্ট লোইজের দুনিয়া আনন্দময় করে তুলল।