নীলের গান

রাধাকৃষ্ণের দল নিয়ে যারা আসে তাদের দেখে দেবুর ভয় লাগে না। ছেলেদের রাধা সেজে নাচতে দেখে উল্টো হাসি পায়।

তাপস রায়
Published : 13 April 2023, 05:19 PM
Updated : 13 April 2023, 05:19 PM

অচিন্তদাকে দেবু প্রথমে চিনতে পারেনি। মাথাভর্তি চুল নুডলসের মতো জট পাকিয়ে আছে। গলায়, বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা। কোমরে প্যাঁচানো বাঘের ছাল; রং করা। হাতে ত্রিশূল নিয়ে রোগা-পটকা অচিন্তদা শিব ঠাকুর সেজে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে!

চৈত্রে এ সময় গ্রামে শিব ঠাকুরের দল আসে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কালী নাচায়। অনেকে আবার নেচে নেচে রাধাকৃষ্ণের গান শোনায়। ঠাম্মা বলেন, এ হলো নীলপূজা। আজ দেবুদের বাড়িতেও এসেছিল। ঢাকের শব্দ শুনে ঘর থেকে দৌড়ে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল দেবু। কিন্তু তালে তালে শব্দ যত বাড়ছিল, মনের মধ্যে ভয় ক্রমেই উঁকি দিচ্ছিল। তার ভয় শিব ঠাকুরকে নয়; ভয় মা কালীকে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, কালীর ওই মুখোশটাকেই দেবুর ভয়!

মুখোশটা কাঠের। কালো কুচকুচে। তেল চিটচিটে। কত বছরের পুরনো কে জানে! লাল টকটকে জিভ নেমে এসেছে থুতনি পর্যন্ত। দেখলেই গা ছমছম করে! শিব ঠাকুর ধ্যানে বসলে তাকে ঘিরে ওই মুখোশ পরে কালী নাচে। তখন সে কি তার রুদ্রমূর্তি! ক্রোধে উঠানজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়। হাতের উদ্যত খড়গ রোদে ঝলসে ওঠে। বড়রা বলে, এ হলো তাণ্ডব-নৃত্য। মা নেচে শিবের ধ্যান ভাঙানোর চেষ্টা করছেন।

প্রতি চৈত্রমাসে এরা দল বেঁধে গ্রামে আসে। চড়কের মেলা শেষে আবার ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায়। আজ হঠাৎ শিব ঠাকুরের দল দেখে শখটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দেবুর।

ওদিকে ভয়ে তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসে দেবুর। উঠান ছেড়ে সে বারান্দায় উঠে আসে। নাচ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত নামে না। শেষ হলে আড়ালে দাঁড়িয়েই টুপ করে প্রণামটা সেরে নেয়। অথচ রাধাকৃষ্ণের দল নিয়ে যারা আসে তাদের দেখে দেবুর ভয় লাগে না। ছেলেদের রাধা সেজে নাচতে দেখে উল্টো হাসি পায়। সবচেয়ে ভালো লাগে রাধার সখীদের। কৃষ্ণকে ঘিরে তারা গোল হয়ে নাচে। নাচে আর গলা ছেড়ে গান গায়। প্রত্যেকের হাতে রঙিন রুমাল। নাচের সময় রুমাল চড়কির মতো ঘুরিয়ে বাতাসে ওড়ায়। নাচ-গান শেষে যে যা দক্ষিণা দেয় তাই নেয়। তারপর রুমাল শূন্যে নাচাতে নাচাতে চলে যায়। তখন ওদের চেয়ে সুখী আর কাউকে মনে হয় না।

দেবু গতবার প্রণাম করে এক টাকা দিয়েছিল। যে রাধা সেজেছিল, সে খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, বেঁচে থাকো। কৃষ্ণপ্রেমী হও। দেবুর খুব শখ ওরকম নীলের দল গড়ে পাড়াময় গান গেয়ে বেড়ানোর। বাড়িতে বাড়িতে কৃষ্ণ ঠাকুরের সে কি আদর! সন্দেশ থেকে শুরু করে কদমা, বাতাসা তো রয়েছেই, কোনো কোনো বাড়িতে ক্ষীরের পায়েসও পাওয়া যায়।

প্রতি চৈত্রমাসে এরা দল বেঁধে গ্রামে আসে। চড়কের মেলা শেষে আবার ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায়। আজ হঠাৎ শিব ঠাকুরের দল দেখে শখটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দেবুর। সুমন, শুভ, নিতাই, পরিতোষ ওদের নিয়ে রাধাকৃষ্ণের দল গড়লে কেমন হয়? নিতাইয়ের বাবা পাকা ঢুলি। নিতাই কাঁচা হলেও ঢোল মন্দ বাজায় না। পরিতোষের গানের গলা আছে। মন্দিরা বাজানোয় পটু। বারোয়ারি মন্দিরে ও বারোমাস মন্দিরা বাজায়। তাহলে আর চিন্তা কী?

বিকেলে খেলতে গিয়ে দেবু বন্ধুদের সামনে কথাটা তোলে। শুনে এক বাক্যে রাজি হয় সবাই। শুধু গোল বাধে রাধাকে নিয়ে। রাধা হতে কেউ রাজি নয়! দেবু খুব করে বোঝায়, এ তো সত্যি কিছু নয়- অভিনয়। যাত্রাপালায় কত ছেলে মেয়ে সেজে অভিনয় করে!

তাহলে তুই হ, নিতাই বলে।

বললেই হলো! কৃষ্ণের চেয়ে রাধা লম্বা হলে মানাবে? লোকে হাসবে। দেবু যুক্তি দেয়।

বন্ধুদের মধ্যে দেবু লিকলিকে। শুভ দেখতে-শুনতে মন্দ নয়। বেশ মানাবে। সবাই শুভকে জোর করে ধরলে রাজি না হয়ে উপায় থাকে না। তবে এক শর্তে, সে নাচতে-টাচতে পারবে না।

ছোট কাকার কথা শুনে ভয়ে দেবুর গলা শুকিয়ে যায়। মুখ দিয়ে রা বের হয় না। এমন সময় বাড়িতে ঢোকে সকালের সেই শিব ঠাকুরের দল।

শুভর কথা শুনে নিতাইয়ের হাসি থামতেই চায় না, বলে কি! রাধা কৃষ্ণের মান ভাঙানোর জন্য গাইবে অথচ নাচবে না, তাই কখনও হয়?

অ্যাঁ, আবার গাইতেও হবে নাকি? শুভ ঘাবড়ে যায়।

আরে না না, দেবু আশ্বস্ত করে- গান সবাই মিলে গাইবো। তুই শুধু লিপসিং করবি।

অসম্ভব। লিপস্টিক আমি মাখতে পারব না।

লিপস্টিক কে বলেছে! লিপসিং। দেবু শুভর মাথায় গাট্টা মেরে বলে, সবাই যখন গাইবে তুই ঠোঁট মেলাবি- বুঝেছিস? 

কিন্তু নাচতে গিয়ে যদি শাড়ি খুলে যায়? শুভ মরিয়া হয়ে বলে।

শুভকে বুদ্ধি বাতলে দেয় পরিতোষ- ধুর! এ কোনো সমস্যাই না। শাড়ির নিচে হাফপ্যান্ট থাকলে আর ভয় কী?

এরপর আর কথা চলে না। পরদিন কথা মতো দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে নিতাইদের বাড়ি জড়ো হয় সবাই। আগেই বলে দেওয়া ছিল, বাড়ি থেকে যে যার পোশাক নিয়ে আসবে। দেবু শরীরে গুঁড়ো নীল মাখছে আর থেকে থেকে আয়নায় নিজেকে দেখছে। মাথায় ময়ূরের পালক, পায়ে ঘুঙুর আর জরির পাড়ের কটকটে হলুদ ধুতিতে দেবুকে চেনা যাচ্ছে না। শুভর বাটিছাট চুলের ওপর লম্বা আলগা চুলও মানিয়েছে বেশ। সখীরাও তৈরি। ঢোল, মন্দিরা নিয়ে সবাই বের হবে এমন সময় নিতাইয়ের চোখে ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে। সে চেঁচিয়ে ওঠে- কি রে কেষ্ট ঠাকুরের বাঁশি কই?

তাইতো! দেবুর টনক নড়ে। বাঁশির কথা একদম মনে ছিল না। এখন উপায়? ‘দাঁড়া আসছি’ বলেই সুমন দৌড়ে বাড়ি যায়। চট করে ফিরে এসে দেবুর হাতে বাঁশি গুঁজে দেয়- নে ধর, ভাগ্যিস আমার কাছে ছিল! তার মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। ওদিকে বাঁশি দেখে দেবুর হাসি উবে যায়। মুখে ভর করে রাজ্যের বিরক্তি। অন্যদেরও একই অবস্থা। সুযোগ পেয়ে পরিতোষ টিপ্পনি কাটে- রেফারির বাঁশি দিয়ে কেষ্ট ঠাকুর! 

পরিতোষের কথা শুনে হেসে ওঠে সবাই। দেবুর গা জ্বলে। বোকামির জন্য নিজের গালেই চড় দিতে ইচ্ছে করে। শেষমেশ বাঁশির জন্য পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে- এ হতেই পারে না। ধমক দিয়ে সবাইকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে দেবু। এরপর বাঁশি আনার জন্য নিজেই বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সন্ধ্যার খুব বেশি দেরি নেই। সাজতে গিয়ে এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। ফলে শর্টকার্ট পথে দেবু বাড়ির পেছন দিয়ে এসে চুপিসারে ঘরে ঢোকে। 

এদিকে কাচারিতে বসে একজনকে ঘরে ঢুকতে দেখে দেবুর ছোটকাকার সন্দেহ হয়। তিনি পা টিপে এগিয়ে আসেন। নিঃশব্দে বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে দেন। তারপর ‘চোর চোর’ বলে সে কি চিৎকার! মুহূর্তেই পাড়ার লোক জড়ো হয় দেবুদের উঠানে। সবাই উত্তেজিত এবং মারমুখী!

পুরো ঘটনায় দেবু এতটাই ঘাবড়ে যায় যে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। কৃষ্ণ সাজতে গিয়ে তার এই দশা! বিপদে সেই কৃষ্ণ ঠাকুরই ভরসা। দেবু প্রাণ বাঁচাতে এক মনে কৃষ্ণ নাম জপতে থাকে- হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।

ওদিকে চোরের মুখে কৃষ্ণ নাম শুনে সবার আক্কেলগুড়ুম! ছোটকাকা গর্জে ওঠেন- চুরি করতে এসে কৃষ্ণ নাম! ব্যাটা ভণ্ড সাধু। দরজা খোল। নইলে এমন মার দেব!

ছোট কাকার কথা শুনে ভয়ে দেবুর গলা শুকিয়ে যায়। মুখ দিয়ে রা বের হয় না। এমন সময় বাড়িতে ঢোকে সকালের সেই শিব ঠাকুরের দল। তারা দিন শেষে ফিরতি পথে বাড়ির পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। যে লোকটা কালী সেজেছিল ‘ভোম ভোম ভোলানাথ’ বলে সে এগিয়ে আসে। খড়গ হাতে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ধমকে ওঠে- সরে যা সব, সরে যা। তারপর সজোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে, এই কে রে, দরজা খুলবি নাকি ভেঙে ঢুকব?

দেবুর সাজ দেখে অচিন্তদার বুঝতে বাকি থাকে না কি ঘটেছে। এতক্ষণে দেবুকে চিনতে পেরে ছোট কাকার মুখেও আর কথা সরে না।

দেবু দরজা খুলবে কি, ভয়ে নড়াচড়া করতেও যেন ভুলে গেছে! কথা কানে যায় না। দরজা ভাঙলে কিন্তু তুই আর আস্ত থাকবি না বলে দিলাম। ভোলেবাবা আব নেহি পার করেগা।  

ভোলাবাবাই হোক অথবা কৃষ্ণবাবা, এক বাবা এই বিপদ থেকে পার করলেই হলো- দেবুর মনে তখন একটাই চিন্তা। সে ‘ছোটকা’ বলে চিৎকার দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলে। গলার কাছে শব্দগুলো জট পাকায়। এদিকে মানুষের জটলা বাড়ছে। একেক জনের একেক মন্তব্য। কেউ বলছে, দরজা ভাঙো। কেউ বলছে, পুলিশে খবর দাও। কারো কণ্ঠে অবিশ্বাস। তারা ছোট কাকার কাছে নিশ্চিত হতে চায়- তুই ঠিক দেখেছিস? হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। আমি নিজে দেখেছি। ছোটকাকা নাছোড়বান্দা- দেখছ না দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

তাই তো! ভেতরে কেউ না থাকলে দরজা বন্ধ করলো কে? মা-কাকীরাও ততক্ষণে ছুটে এসেছেন। অনেক প্রশ্ন, অজানা আশঙ্কায় একে অপরের দিকে তাকাচ্ছেন। ফের ধমক দেয় লোকটি- কি রে দরজা খুলবি নাকি ভাঙব?

ছো-ট-কাআআ আঁ আঁ আঁমিইই...।

চৈত্রের ভরসন্ধ্যা। চারপাশে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। এই অবেলায় দেবুর কণ্ঠ অদ্ভুত শোনায়। ‘ভূত-টুত নয় তো?’ ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। আরে না না। অচিন্তদা এবার ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে। হাঁ করে কী দেখছিস?

দরজা ভাঙতে হবে- লোকটিকে তাড়া দেয়। 

হুম, কথায় চিড়ে ভিজবে না। বলতে বলতে লোকটি খড়গ দিয়ে সজোরে কোপ বসিয়ে দেয় দরজার ওপর। হাঁ হয়ে খুলে যায় কপাট। দরজায় মুখোশ পরা খড়গ হাতে লোকটিকে দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠে দেবু। পাংশু মুখে নিঃশ্বাসের সঙ্গে শুধু হেঁচকি ওঠে।  

দেবুর অবস্থা দেখে লোকটির মায়া হয়। সে মুখোশ খুলে ফেলে। তারপর হঠাৎ চারপাশ কাঁপিয়ে হেসে ওঠে- আরে! এ যে দেখছি কেষ্ট ঠাকুর গো। 

দেবুর সাজ দেখে অচিন্তদার বুঝতে বাকি থাকে না কি ঘটেছে। এতক্ষণে দেবুকে চিনতে পেরে ছোট কাকার মুখেও আর কথা সরে না। হাসির রোল ওঠে চারদিকে। ওদিকে দেবু তখন পালাতে পারলেই বাঁচে। বারান্দায় মেয়েদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সব দেখছিল ঠাম্মা। লাঠিতে ভর দিয়ে কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্য করেনি কেউ। 

চুরি করে মাখন খেতে এসে মা যশোদার হাতে ধরা পড়েছিল কেষ্ট ঠাকুর। আমাদের ঠাকুর তো বাঁশি নিতে এসেই ধরা পড়ে গেল। তা কেষ্ট ঠাকুরের রাধা কই? ঠাম্মা এদিক-ওদিক চায়। ওদিকে উঠানে জড়ো হওয়া সবার মধ্যে আরেকবার হাসির ঢেউ ওঠে।