ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা।
Published : 09 Aug 2023, 01:54 AM
অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।
ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এ জন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের অর্থের গল্প।
ইদানীং ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারে ‘ব্যক্তি’ এবং ‘ব্যক্তিত্ব’ শব্দের ভুল প্রয়োগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন: ‘কাজী নজরুল ইসলাম আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব’, বাক্যটি কি শুদ্ধ? নাকি ‘কাজী নজরুল ইসলাম আমার প্রিয় ব্যক্তি’, এ বাক্যটি শুদ্ধ? তবে চলো আভিধানিকভাবে শব্দদুটোর ব্যুৎপত্তিসহ যথাযথ অর্থ ও প্রয়োগ জেনে নিই।
ব্যক্তি: সংস্কৃত শব্দ। বিশেষ্য পদ। এর ব্যুৎপত্তি (বি+√অনজ+তি) অর্থ: ১. লোক, মানুষ (রবিঠাকুর আমার প্রিয় ব্যক্তি)। ২. প্রকাশ (অভিব্যক্তি)। ৩. (দর্শনশাস্ত্রে) বিশেষ; ব্যষ্টি, Individual (ব্যক্তিবিশেষে প্রভেদ করা সমীচীন নয়)।
ব্যক্তিত্ব: সংস্কৃত শব্দ। বিশেষ্য পদ। এর ব্যুৎপত্তি (স. ব্যক্তি+ত্ব) অর্থ: ব্যক্তিবিশেষের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য, Personality। যেমন: তাঁর ব্যক্তিত্ব অনুসরণযোগ্য বা লোকটি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।
ব্যক্তি বলতে শুধু মানুষকেই বোঝায়, কিন্তু ব্যক্তিত্ব বলতে ব্যক্তির আচার-ব্যবহার, চালচলন, দোষগুণ প্রভৃতির সামগ্রিক অবয়বকে বোঝায়। মূলত ব্যক্তি হচ্ছে বস্তুগত অর্থাৎ যা স্পর্শ করা যায় বা ছোঁয়া যায় আর ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ভাবগত অর্থাৎ স্পর্শ করা যায় না, তবে অনুভব করা যায়। সুতরাং এই ভাব এবং বস্তু নিয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো অর্থাৎ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের বিষয়টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সমাজের ভিত্তিই হচ্ছে ব্যক্তি। সমাজের বাইরে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারে না। কারণ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে সামাজিক আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে।
সুতরাং পরিস্থিতিভেদে কোনো মানুষের প্রসঙ্গের অবতারণায় ‘ব্যক্তি’ এবং ব্যক্তিবিশেষের স্বাতন্ত্র্য বা বৈশিষ্ট্য উল্লেখে ‘ব্যক্তিত্ব’ শব্দটি ব্যবহার শুদ্ধ। সে হিসেবে ‘কাজী নজরুল ইসলাম আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব’ বাক্যটি আভিধানিকভাবে শুদ্ধ নয়। এর শুদ্ধ রূপ হবে ‘কাজী নজরুল ইসলাম আমার প্রিয় ব্যক্তি’।
সাম্প্রতিক ভাষা ব্যবহারে তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করেছ ‘প্যারা’ শব্দটি আমরা প্রায়শই ব্যবহার করি। কী অর্থে? যেমন: ‘এ কাজটি আমাকে অনেক প্যারা দিচ্ছে।’ আচ্ছা, এই যে আমরা ‘প্যারা’ শব্দটা এত ব্যবহার করি, কখনো কি এটা ভেবে দেখেছি, এই শব্দটা এলো কোথা থেকে? এটি কী অর্থে কোন প্রসঙ্গে ব্যবহার করছি? দিনদিন ভাষার চেহারাটা কীভাবে যেন বদলে যাচ্ছে। তাই না! তবে চলো জেনে নিই কীভাবে এবং কী অর্থ নিয়ে এসেছে ‘প্যারা’ শব্দটি।
এর আগে জেনে নিই প্যারা শব্দটি অভিন্ন উচ্চারণে আর কোথায় কোথায় কী কী অর্থে আমরা ব্যবহার করি। প্রথমেই মনে পড়ছে প্যারা নামে একটি সন্দেশের কথা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে মন্দিরে এই প্যারাকে ঠাকুরের ভোগারতির প্রসাদ হিসেবে পরিবেশন করা হয়। এটিকে আবার অঞ্চলভেদে প্যারা সন্দেশও বলে থাকে। সন্দেশ সাধারণত গোলাকৃতির ও চ্যাপটা হয়ে থাকে। কিন্তু প্যারা সন্দেশ কিছুটা লম্বাটে ধরনের হয়ে থাকে।
আরেকটি প্যারা হলো ইংরেজি ‘প্যারাগ্রাফ’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। মূলত এই প্যারার অর্থ হলো একাধিক বাক্যে রচিত গদ্যের অংশ। যেমন: তুমি আমাকে এ বিষয়ে এক প্যারা লিখে দাও। সুতরাং এই প্যারা শব্দটি গদ্যের অংশবিশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত। অভিন্ন উচ্চারণে কিন্তু ভিন্ন বানানে আরেকটি প্যারা রয়েছে। যার শুদ্ধ বানান ‘প্যাড়া’ এর অর্থ হলো বেতের তৈরি বড়ো ঝাঁপিবিশেষ। এটি সংস্কৃত শব্দ।
তো আমরা কথা বলছিলাম ‘প্যারা’ নিয়ে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত প্যারার অর্থ তো এখনো পেলাম না। যেমন: ‘এ কাজটি আমাকে অনেক প্যারা দিচ্ছে।’ এখানে প্যারা মানে যন্ত্রণা, বেদনা, ক্লেশ, কষ্ট প্রভৃতি। আসলে প্যারা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পীড়া’ শব্দ থেকে। আমরা যদি এ শব্দের বিবর্তনটি খেয়াল করি তাহলে দেখবো পীড়া>প্যাড়া>প্যারা রূপ ধারণ করেছে। মানে পীড়া শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে প্যারা রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু পীড়ার যে অর্থ তা প্যারা শব্দে অপরিবর্তিত রয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ পীড়া থেকে প্যারা শব্দটি উচ্চারণ অপেক্ষাকৃত সহজ।
তোমরা সবাই নিশ্চয় ‘ফাতরা’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। কখনো কথায় কথায় বন্ধুদের বলেছো ‘যা ফাতরামি করিস না’। এই ফাতরা শব্দ থেকেই এসেছে ফাতরামি শব্দটি। শব্দটি কোনো বিদেশি ভাষার শব্দ নয়। এটি দেশি শব্দ।
‘ফাতরা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো (বিশেষ্যরূপে) কলাগাছের শুকনো পাতার খোল। আবার এর আরেকটি অর্থ হলো বৃষ্টির সময় গ্রামাঞ্চলে মাথা ও পিঠের আবরণ হিসেবে ব্যবহৃত কলাগাছের শুকনো পাতার খোল। আর (বিশেষণরূপে) বাজে, তুচ্ছ, খেলো; ধূর্ত; বাচাল প্রভৃতি।
এক কথায় বলা যায় শব্দটির উৎপত্তি কলাগাছ থেকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কলাপাতা একটি দরকারি বস্তু। কলাপাতা সংগ্রহের জন্য গাছ থেকে কলাগাছের পাতা ধরে টান দিলে পাতার সঙ্গে শুকনো বাকল ফড়ফড় শব্দে উঠে আসে। এই ফড়ফড় শব্দের কারণেই এটিকে ফাতরা নামে অভিহিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে শব্দের অর্থটি আক্ষরিক থেকে আলংকারিক অর্থে রূপ পরিগ্রহ করেছে।
কলাপাতার সঙ্গে উঠে আসা শুকনো বাকল অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর এবং মূল্যহীন। এখান থেকেই ফাতরার উল্লিখিত অর্থগুলোর উৎপত্তি। কী দারুণ নৈপুণ্যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনপ্রণালি থেকে এমন মজার মজার শব্দ অভিধানে ঠাঁই করে নিয়েছে। ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হই!