‘যখন পৃথিবী জেগে উঠেছিল বিদ্রোহে, তখন তার কলম লিখেছিল ইতিহাস।’
Published : 09 Jan 2025, 03:28 PM
ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০) ছিলেন রাশিয়ান সোভিয়েত কবি ও নাট্যকার। তিনি জর্জিয়ার বাঘদাতি (বর্তমানে মায়াকোভস্কি) শহরে জন্মগ্রহণ করেন, তখন এটি রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। মায়াকোভস্কি ১৯০৬ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের সঙ্গে মস্কোতে চলে আসেন।
১৫ বছর বয়সে তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টিতে যোগ দেন এবং দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। একাকী কারাবাসে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯১০ সালে তিনি মস্কো আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তিনি কবি ডেভিড বারলিউকের সঙ্গে পরিচিত হন এবং রাশিয়ান ফিউচারিস্ট আন্দোলনের নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
মায়াকোভস্কি বেশকিছু আলোচিত কবিতা লিখেছেন, যেমন ‘অ্যা ক্লাউড ইন ট্রাউজার্স’ (১৯১৫), ‘ব্যাকবোন ফ্লুট’ (১৯১৬), ‘১৫০,০০০,০০০’ (১৯২১), ‘ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন’ (১৯২৪) এবং ‘অল রাইট!’ (১৯২৭)। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তার সমর্থন তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে, যেমন ‘ওড টু রেভোলিউশন’ (১৯১৮) এবং ‘লেফট মার্চ’ (১৯১৯)।
এছাড়া তার নাটক ‘মিস্ট্রি-বউফ’ (১৯২১) এবং রুশ টেলিগ্রাফ এজেন্সির সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি কার্টুন ও পোস্টারে তার এই সমর্থন দেখা যায়। এসময় তার কবিতা বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং তিনি সোভিয়েত জাতির মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। মায়াকোভস্কি প্রেমের কবিতাও লিখেছেন, যেমন ‘আই লাভ’ (১৯২২) এবং ‘অ্যাবাউট দ্যাট’ (১৯২৩)।
জনপ্রিয়তার কারণে মায়াকোভস্কি ১৯২০-এর দশকে লাটভিয়া, ব্রিটেন, জার্মানি, মেক্সিকো, কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন, যার অভিজ্ঞতা তিনি ‘মাই ডিসকভারি অফ আমেরিকা’ (১৯২৫) প্রবন্ধে লিখেছেন। ১৯২২ থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে তিনি সোভিয়েত অ্যাভান্ট-গার্ড লেফট ফ্রন্ট অব দ্য আর্টস আন্দোলনে যুক্ত হন এবং আন্দোলনের সাময়িকী ‘এলইএফ’ সম্পাদনা করেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি দুটি ব্যঙ্গ নাটকও লিখেছেন, ‘দ্য বেডবাগ’ (১৯২৮) ও ‘দ্য বাথহাউস’ (১৯২৯)। ১৯৩০ সালে আত্মহত্যা করেন এ কবি।
মায়াকোভস্কির কবিতাসমগ্র থেকে দুটি দীর্ঘ কবিতা এখানে ভাবানুবাদ ও বিনির্মাণ করা হলো-
কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ
দুর্দান্ত একটা দিনে
ছোট্ট এক ছেলে তার বাবার কাছে এসে
জানতে চাইল,
“বাবা,
বলো আমাকে কোনটা ভালো
আর খারাপ-ই বা কীসে?
সেদিন ওর বাবা যা বলল,
আমার কানও সেই কথাগুলো
নিগুঢ়ভাবে শুনল।
বাচ্চারা,
তোমরা সবাই বসো কাছাকাছি এসে,
ওইদিন ওর বাবা যা বলছিল,
হুবহু সেটাই বলবো, তোমাদের
আজকের এই সমাবেশে।
শোন,
বাতাস যদি পাগলের মতো আচরণ করে,
গাছগাছালির ডাল ভেঙে দেয়
আর শিলাবৃষ্টি ঝরে।
রাস্তাঘাটে যায় না হাঁটা
টিনের চালও ওড়ে,
জেনে রাখো, মানুষ একে খারাপ বলে ধরে।
বৃষ্টির পরই সূর্য আসে
মোছে ঠান্ডা হাওয়া,
এটাকে বলে ‘ভালো’
কারণ তরুণ বা বুড়ো
সবার এই-ই চাওয়া।
আবার যখন কুচকুচে
কালো কোনো ছেলে,
বিচ্ছিরি-ময়লা-মাখা তার
থুতনিতে ও গালে।
এটাকে তুমি খারাপ হিসেবে ধরবে,
পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকাকে ‘ভালো’ মনে করবে।
যে ছেলেটা সকাল-বিকাল দু’বার গোসল করে
পরিপাটি থাকে, আর ভালো জামা-কাপড় পরে।
জেনে রাখো তোমরা: সে-ই ছেলেটাই
সবার কাছে প্রিয়।
তোমরা সবাই এমন ছেলের সঙ্গ বেছে নিও।
আবার যে ছেলেটা বখাটে-গুণ্ডা-মাস্তান
কথায় কথায় বন্ধুদের
মারে আর ধরে,
উঁচু গলায় ঝগড়া করে
কথাও বলে চেঁচানোর স্বরে।
শোন, এরকম আচরণকে মানুষ
খারাপ-ই মনে করে।
যারা বলে,
তোমার চাইতে খাট যারা
তাদের তুমি ধরবে না
তোমার চাইতে গরিব যারা
তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বও করবে না।
আমি কিন্তু এটাকে খারাপ বলেই জানি,
আশা করি, তোমরাও এমনটাই ভাবো।
কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ
এ নিয়ে আরও কিছু কথা বলে
তারপর আমি যাবো।
যদি একইদিনে তুমি একটা বই ছিঁড়ে ফেল,
ধরো, সেদিন-ই অসাবধানতায়
তোমার একটা খেলনাও ভেঙে গেল।
‘ছেলেটা খুব দুষ্ট’, সবাই তখন এ কথাই বলবে,
এরপর থেকে তুমি কিন্তু ঠিক-ই সাবধান হয়ে চলবে।
যে ছেলেটা পড়তে আর আঁকতে ভালোবাসে,
সবাই কিন্তু স্নেহ নিয়ে তার কাছেই আসে।
যে ছেলেটা নিয়ম করে পড়ালেখা করে,
তাকেই সবাই আদর করে স্কুলে বা ঘরে।
কাক দেখলেই যে ছেলেটা চিৎকার করে ওঠে,
মুরগি-হাঁস বা কবুতর এলে মারার জন্য ছোটে।
এরকম ভীতু ছেলের জন্য খুব করুণা হয়,
সাহস করে আগাও, দেখবে দূর হবে ভয়।
মনে রেখ,
তোমরা যারা এখনও এত বড় হওনি,
যদি তুমি এখন একটা পুঁচকে সিংহ হও,
বড় হয়ে স্পষ্টবাদী সিংহ-ই হবে,
কাউকে তোয়াক্কার দরকার নেই।
বাবার এই কথা শুনে
সেই ছেলেটা চকচকিয়ে উঠলো,
কোথাও বনে নতুন একটা
ফুলের কুঁড়ি ফুটলো।
এরপর বলল,
বুঝতে পেরেছি বাবা,
মানুষের যাতে মঙ্গল হয়
বড় হয়ে আমি এমন কাজই করবো।
খারাপের ধারেকাছেও যাবো না,
ভালোর সঙ্গে থেকে থেকে
এই জীবনকে গড়বো।
কী হবো আমি?
সময় যাচ্ছে চলে, আর বেড়ে উঠছি আমি,
আগামী বছর পা দেব- সতেরোতে।
কী বেছে নেব আমি?
কোন ধরনের চাকরি?
ভালো একটা ক্যারিয়ার শুরু করতে?
দারুণ দক্ষ কাঠমিস্ত্রিরা,
আসবাব বানানো চাট্টিখানি কথা নয়,
প্রথমে একটা মোটা-গোল কাঠের গুঁড়ি নিয়ে
তারপর,
এটাকে বেঞ্চির কাছে টেনে নিতে হয়।
এরপর কাজ- করাত দিয়ে কাটি,
ঠিক এইভাবে- হ্যাঁ, এইভাবে ঠিক কাটি!
বানাই তক্তা- লম্বা, সমতল আর পরিপাটি।
এরকম
অনেকটা সময় কাজ করার পর,
ব্যস্ত করাত লালচে-গরম হয়ে ওঠে,
আর
কাঠের গুঁড়োরা চারপাশে তার ওড়ে
হলুদ ঢিবিতে জমে তারা
প্রত্যেকে ফুল হয়ে ফোটে।
এবার
আমরা হাতে নিই এক রেঁদা,
নতুন করে শুরু করি সব কাজ।
তক্তার এদিক-সেদিক বারবার ঘষে,
গিঁট আর খোঁচা যত আছে দেই মুছে।
যদি লাগে বল বা কুঁচি,
সেই কাজটাও লেদ মেশিনে করি,
একের পর এক অংশ আগে গড়ি,
এখন এগুলো জোড়া দিতে তৈরি।
ওয়াড্রব, টেবিল, চেয়ার বা আলমারি,
সব-ই চমৎকার করে
এভাবে আমরা তৈরি করতে পারি।
আসবাব বানানোর কাজটা ভালো,
কিন্তু দালান নির্মাণও খারাপ কিছু নয়।
আমি হবো এক রাজমিস্ত্রী,
হ্যাঁ এটাই হবো আমি।
আগে ওরা আমাকে শেখাক,
কী করে বানাতে হয় বাড়ি।
প্রথমে আঁকবো এক নকশা
আমার অন্তরে যে ঘর
ঠিক সেরকম একটা বাসা,
আর বানানোর সময়
বাড়িটাকে দেব
সৌন্দর্যের অনবদ্য সব ভাষা।
চোখ জুড়ানো বিস্তৃত আর ঝকঝকে জানালায়,
মুহূর্তে যেন হেসে ওঠে- নতুন দিনের আশা।
এখানে সামনের অংশ, যাকে বলে- ফ্যাসাড,
ওখানটায় হবে বাগানের যত সাজ।
এদিকে একটা পাথরের পথ যাবে,
ওদিকে ভাঁড়ারঘর; আর তার পাশে যে ঘর
সেখানে সবাই সারবে গোসলের কাজ।
আর,
রান্নাঘরের পাশেই একটা কান্না ঘর থাকবে,
সে-ই ঘরটা আমাদের সব যন্ত্রণা জমা রাখবে।
নকশা বানানো শেষ; তুমি-আমি ও সবাই
এসো লেগে যাই যার যার কাজে,
একটুও সময় নেই-
অনেক বেলা বাজে।
এতোটা উঁচুতে গড়বো এই বাড়ি
যেন তা আকাশ হাত বাড়ালেই ছোঁয়,
উপর থেকে তাকালে ঘুরবে মাথা,
হৃদয় যেখানে মেঘের বালিশে শোয়।
ছাদের উপর আমরা দেই টিনের চালা,
যেন তা খুব শক্ত হয়
আর পানিকে ঢুকতে দেয় বাধা।
বাড়িটা এখন তৈরি
কী যে সুন্দর হয়েছে তা
দেখলেই যে কারও চোখে লাগবে ধাঁধা।
পর্যাপ্ত রুম আছে এখানে
প্রত্যেক পরিবারের জন্য,
তোমরা সবাই উঠে পড়ো,
তবে-ই এ বাড়ি হবে
আনন্দময়ী মানুষের অরণ্য।
রাজমিস্ত্রী হওয়া ভালো,
কিন্তু একজনের ডাক্তারের কাজও তো মন্দ নয়,
শিশুদের সারিয়ে তুলতে আমার
কী যে দারুণ আনন্দ হয়!
কিন্তু আগে ওরা আমাকে শেখাক,
কী করে একজন ডাক্তার হওয়া যায়!
হেঁটে হেঁটে কড়া নাড়বো তখন
প্রত্যেক বাড়ির দরজায়।
বলবো,
এই বাড়িতে কেউ কি অসুস্থ আছে?
চিন্তা কোরো না তোমরা,
ডাক্তার সাহেব নিজেই এসে গেছে।
তোমরা যারা জ্বরে ভুগছো এইভাবে হাঁ করো,
থার্মোমিটারটা আলতো করে জিহ্বার নিচে ধরো।
ভয় পেওনা- এভাবেই মাপতে হয় জ্বর
ঠান্ডা লাগলে সর্দি হবেই ভাঙবে গলার স্বর।
ঠিকমতো ওষুধ খেলে অসুখ সেরে যাবে,
এরকম ভালো ডাক্তার আর কোথায় পাবে?
প্রেসক্রিপশনে ওষুধ ছাড়াও থাকবে কবিতা-ছড়া,
দেহের সঙ্গে মনের অসুখেরও হবে বোঝাপড়া।
ডাক্তার হওয়া ভালো
কিন্তু একজন শ্রমিক হওয়াও দোষের কিছু নয়,
আগে ওরা আমাকে শেখাক
কী করে একজন কর্মঠ মানুষ হতে হয়।
এক্ষুণি তোমরা সবাই উঠে পড়
দলে দলে কারখানায় চলো,
মাথার ঘাম পায়ে ফেলার গল্প সবাইকে বলো।
কিছু কাজ আছে যা কারও কারও জন্য কঠিন,
সবাই মিলে আমরা
সে-ই কাজটাই করি সারাদিন।
কেউ কাটে কাচি দিয়ে কাপড়,
কেউ সারাদিন সেলাই করে যায়,
ইস্তিরি করে কেউ কেউ,
কেউ আবার ভারি ভারি মেশিন চালায়।
কারখানার ভেতরের সময়টা খুব-ই কঠিন ভাই,
একটা মুহূর্তও বিশ্রাম নেওয়ার
অবসর সেখানে নাই।
সারাদিন কাজ করার পর
সে সামান্য কিছু পায়,
সেটা দিয়েই শ্রমিক তার সংসার চালায়।
ব্রেড আনতে বাটার ফুরায়,
পান্তা আনতে নুন,
আর কথায় কথায় বসের ঝাড়ি,
পান থেকে যদি খসে চুন।
এর চেয়ে ভালো আমি হবো বাসের হেলপার
সকাল-সন্ধ্যা চিল্লাবো,
টিকেট লাগবে কার?
বড় বড় বাসে করে দূর শহরে যাবো
প্রতি যাত্রায় নতুন নতুন প্যাসেঞ্জার পাবো।
আমার বাসে উঠবে শিশু, বুড়ো, পুরুষ আর নারী
সবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব,
বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
সবাই যা চাইবে আমি তা-ই দিয়ে দেবো,
বিনিময়ে তাদের থেকে ভালোবাসা নেব।
যাত্রা শেষে বাস যখন পৌঁছাবে ঠিকানায়,
ওদের অন্তরে যেন আমার নামটা গেঁথে যায়।
বাসের হেলপার হওয়া ভালো,
কিন্তু সেটার চালক হওয়াও মন্দ কী?
আমি না-হয় গাড়ি-ই চালাবো
এখনও পথের অনেক বাকি।
যার যেখানে যেতে মন চায়
সেখানেই নিয়ে যাবো,
কেয়ার করি না গন্তব্যে পৌঁছে
ভাড়া কতো পাবো!
বাড়ি যেতে চায় যারা
তাদের নিয়ে আমার গাড়ি ছুটবে,
ওদের বাড়ি-ই আমার নিজের
বাড়ি হয়ে উঠবে।
ট্রাফিকের সব নিয়মকানুন মেনেই গাড়ি চলবে,
পথে পথে ওরা আমাকে
মনের গোপন কথা বলবে।
কার অন্তরে কীসের ব্যথা যেতে যেতে শুনবো,
আমার হৃদয়েও কয়টা ব্যথা
হাতের আঙুলে গুনবো।
আমার গল্প শেষ,
আশা করি বুঝতে পেরেছ
যে কোনো কাজ-ই ভালো,
যা হতে ইচ্ছা করে সেই মোতাবেক
মনের আগুন জ্বালো।