পত্রিকায় তার কতো বিচিত্র নাম দেখতাম- 'সাকিবুল', ‘সাকিবুল হাসান’, ‘সাকিব উল হাসান’। এই সব নাম ছাপিয়ে ‘সাকিব’ হয়ে ওঠেন ‘বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ!’
Published : 09 Oct 2023, 10:33 PM
বাংলাদেশের ক্রিকেট তখনও নবীন। অনেক সমালোচনা। জিওফ বয়কটরা তো পারলে ক্রিকেট থেকে নির্বাসন দেন বাংলাদেশকে। ২০০৩-এর বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে টাইগারদের হারিয়ে দিল কানাডার মতো দল! তারপরও অবশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেট শেষ হয়ে যায়নি, কিন্তু দশাটা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়!’ মাঠে নামলেই ব্যাটিং ধস। টেলিভিশনের সামনে থেকে সরা যায় না, পলক ফেললেই নেই উইকেট!
তারপর লিকলিকে পাতলা এক ছেলেকে একদিন নেমে পড়তে দেখলাম মাঠে। একটু আধটুকু ব্যাটিং আর কিছুটা বোলিং জানা অলরাউন্ডার। নিউ জিল্যান্ড দলটায় তখন এমন খেলোয়াড়দের ছড়াছড়ি। আমাদের ক্রিকেটেও এমন কেউ এলেন!
সালটা ২০০৬। জিম্বাবুয়ের মাঠে অভিষেক হলো ছেলেটার। ১৯ বছরের ছেলেটার নাম সাকিব-উল হাসান। সিরিজ হার ততক্ষণে নিশ্চিত, সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে খেলতে নামলেন তিনি। বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনে ১০ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে একটি উইকেট নিলেন। পরে ব্যাট হাতে অপরাজিত ৩০। আশা জাগানিয়াই বটে!
সাকিব তখন নতুন। এভাবেই তার নাম আসত। ২০০৭ সালে বিশ্বকাপ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গেলেন। প্রথম ম্যাচটা ভারতের বিপক্ষে। তখনও ‘সাকিব আল হাসান’ হয়ে ওঠেননি তিনি। বিশ্বকাপ অভিষেকেই খেললেন ৮৬ বলে ৫৩ রানের ইনিংস। বিশ্বকাপ অভিষেক সেদিন আরও দুজনের হয়েছিল, তামিম ইকবাল আর মুশফিকুর রহিমের। সেই ম্যাচটা অবশ্য তামিমের জানান দেওয়ার ম্যাচ হিসেবেই বিখ্যাত। তবে সাকিবও জানিয়ে দিয়েছিলেন- আমিও আসছি! সেদিন বাংলাদেশের কাছে ভারতের পরাজয়ে বিশ্বকাপের গতিপ্রকৃতিই বদলে গিয়েছিল!
তারপর একে একে সাকিব কীর্তি গড়ছিলেন আর পত্রিকায় তার কত বিচিত্র নাম দেখতাম- 'সাকিবুল', ‘সাকিবুল হাসান’, ‘সাকিব উল হাসান’। এই সব নাম ছাপিয়ে ‘সাকিব’ হয়ে ওঠেন ‘বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ!’ বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই যেন সাকিব বন্দনা!
এই সাকিব একবার নয়, বারবার এমন ত্রাতার রূপে হাজির হয়েছেন বাংলাদেশের হয়ে। বাংলাদেশ দলের পোস্টারবয় হয়ে উঠেছেন।
আমরা তখনও ওর মতো ধারাবাহিক বাংলাদেশি ক্রিকেটার দেখিনি। আমরা বলতাম, ‘সাকিব ব্যাটিংয়ে নামলে নিশ্চিন্তে ওয়াশরুম ঘুরে আসা যায়!’ সাকিব ব্যাটিংয়ে থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, একটু চোখ বুজে ঘুমিয়েও নেওয়া যায়। এই ছেলেটা আলাদা ধাতুতে গড়া। সে আলাদা এক মানুষ, বিশ্বসেরার লক্ষণ ওর ব্যাটে-বলে!
তখনও সাকিব অনেক মুখচোরা, কথা বলত খুব কম। কিন্তু মাঠে নামলেই ব্যাটে-বলে কথা বলত। আমরা দেখতাম আমাদের সাকিব টেক্কা দিচ্ছেন বাঘা বাঘা সব নামের সঙ্গে।
২০০৯ সাল, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ চলছে। প্রথম ম্যাচেই জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে গেছে বাংলাদেশ। ব্যাটে-বলে একাই লড়লেন সাকিব। পরের ম্যাচে সমীকরণ এমন দাঁড়িয়েছে যে, শক্তিশালী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বোনাস রানরেটে জিতলে তবেই ফাইনালে খেলতে পারবে বাংলাদেশ। লঙ্কানদের সে ম্যাচে অল্প রানেই বাঁধা হলো। ১৪৮ রান করতে পারলেই জিতবে বাংলাদেশ, কিন্তু ফাইনালে উঠতে হলে ম্যাচটা জিততে হবে ২৫ ওভারের আগেই। উইকেটটা ব্যাটারদের জন্য বধ্যভূমি আর প্রতিপক্ষ লঙ্কান দলে আছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন নামের ত্রাস!
সাকিব সেদিন পিটিয়ে ছাতু বানালেন লঙ্কার বোলারদের। ৬৯ বলে ৯২ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংসে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতল ২৩.৫ ওভারেই। সাকিব অপরাজিত থেকে ছাড়লেন মাঠ। ফাইনালে বাংলাদেশ!
এই সাকিব একবার নয়, বারবার এমন ত্রাতার রূপে হাজির হয়েছেন বাংলাদেশের হয়ে। বাংলাদেশ দলের পোস্টারবয় হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশ দলের গণ্ডি ছাড়িয়ে আইপিএল, বিগব্যাশ, একে একে মাতিয়ে চলেছেন অসংখ্য টুর্নামেন্ট। দেশের ক্রিকেটের প্রথম ফেরিওয়ালা তাকে বলাই যায়।
বড় খেলোয়াড়ের প্রমাণের মঞ্চ বিশ্বকাপ। বিশ্বসেরাদের এই মঞ্চে জ্বলে উঠতেই হয়। শচীন জ্বলেছেন; লারা, পন্টিং, ইমরান, কপিল, জয়াসুরিয়া, সবাই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের জন্যই বিখ্যাত। বাংলাদেশ তো আর অতবড় ক্রিকেট শক্তি নয়, তাই এই দেশের কারও নাম তাদের সঙ্গে আলাপে আসবে এমনটা ভাবাই তো অকল্পনীয়। কিন্তু সাকিব পেরেছেন। শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরা হয়নি, কিন্তু ক্রিকেটের সেরা আসরে সাকিব যা করেছেন তাতে তার নামটা স্থায়ী হয়ে থাকা নিশ্চিত।
বিশ্বকাপে হাজারের ওপর রান ও তিরিশের ওপর উইকেট আছে শুধু একজনেরই। তিনি একজন বাংলাদেশি, নাম তার সাকিব আল হাসান।
এই নিয়ে পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলেছেন সাকিব। তাতে রান সংগ্রাহকের তালিকায় সেরা দশে ঢুকে পড়েছেন তিনি। ১১৬০ রান নিয়ে নয় নম্বরে আছেন। তবে মাত্র ৬৫ রান করলেই চার নম্বরে উঠে আসবেন। ছাড়িয়ে যাবেন ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারাকে। আর যদি কোনমতে ৩৭৩ রান করতে পারেন, তাহলে সাকিব ছাড়িয়ে যাবেন কুমার সাঙ্গাকারাকেও। ওপরে থাকবেন শুধু রিকি পন্টিং আর শচীন টেন্ডুলকার!
মজার বিষয়, তালিকার নামগুলোর প্রায় সবাই নিখাদ ব্যাটসম্যান। সেরা দশে সাকিব বাদে জ্যাক ক্যালিস আর সনাথ জয়াসুরিয়াকেই অলরাউন্ডার বলা চলে।
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়া বোলারদের তালিকাতেও সেরা বিশেই আছেন সাকিব। উইকেট নিয়েছেন ৩৭টি। এই বিশ্বকাপে আর তিনটি উইকেট নিলে সেরা দশেই জায়গা পেতে পারেন তিনি। যদি ব্যাটে-বলে মিলিয়ে সাকিবের পারফরম্যান্সের কথা বলা হয়, তবে সাকিবের সঙ্গে তালিকায় জায়গা পাওয়ার মতো নেই কেউই।
বিশ্বকাপে হাজারের ওপর রান ও তিরিশের ওপর উইকেট আছে শুধু একজনেরই। তিনি একজন বাংলাদেশি, নাম তার সাকিব আল হাসান। যিনি একদিন অখ্যাত এক তরুণ ছিলেন। যার নামটা পত্রিকাওয়ালারা লিখতেন নানাভাবে। কখনো ‘সাকিবুল’ তো কখনো ‘সাকিব-উল হাসান’! কিন্তু সেই তিনি সময়ের সঙ্গে হয়ে উঠেছেন সাকিব আল হাসান; এক বিশ্বসেরা ক্রিকেটার। নম্বর ওয়ান অলরাউন্ডার!
সাকিবের বয়স এখন ৩৬। এখনো সে বাংলাদেশের সেরা। বিশ্বেরই সেরা, ইতিহাসের সেরাদের একজন। এই বিশ্বকাপের পর আর ওয়ানডে বিশ্বকাপে হয়তো দেখা যাবে না সাকিবকে। আগের চার আসরেই পারফরম্যান্সে রাঙিয়েছেন, এবার শুরুটা হয়েছে দারুণ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বল হাতে তুলে নিয়েছেন ৩ উইকেট। আর ক্যাপ্টেন্সি? তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাঘা বাঘা ক্রিকেট বোদ্ধাদের।
তবে শেষ বিশ্বকাপে এসে একটা জায়গায় ছেদ পড়েছে ধারাবাহিকতায়। আগের চার আসরের প্রথম ম্যাচে কমপক্ষে ৫০ রান করা সাকিব এবার আউট হয়ে গেছেন ১৪ রানে। এই ধারাবাহিকতায় যখন ছেদ পড়েছে তখন বদলে যাক টাইগারদের বিশ্বকাপ ভাগ্যও। শিরোপা আসুক টাইগারদের ডেরায়। আমাদের ক্রিকেটের সেরা তারকার শেষটা রাঙিয়ে যাক শিরোপায়।