টিআাইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যথাযথ আইন ও বিধিমালা না থাকায় হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
Published : 25 Jun 2023, 09:38 PM
‘একচ্ছত্র ক্ষমতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অনিয়মের কারণে’ হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী বলে টিআইবির এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
রোববার টিআইবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেবার মান কমে যাওয়ায় সুনাম নষ্ট এবং রোগী কমে যাওয়ায় হাসপাতালটির আয়ও কমে গেছে। আর হাসপাতালটির এই পরিস্থিতির জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও অংশীজনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ‘দায় এড়ানোর সুযোগ নেই’।
‘হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এদিন ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে টিআইবি।
তবে ওই প্রতিবেদনে যে পর্যবেক্ষণ এসেছে, তার ‘সত্যতা নেই’ দাবি করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদলিপি দেওয়ার কথা বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
পরিচালনা পর্ষদের কারও সঙ্গে কথা না বলেই এমন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন হাসপাতালটির পরিচালক।
টিআইবি বলছে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির প্রাক্তন গবেষক ও বর্তমানে পরামর্শক তাসলিমা আক্তার এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. মাহ্ফুজুল হক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যথাযথ আইন ও বিধিমালা না থাকায়’ হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আলাদা মানবসম্পদ কাঠামো বা অর্গানোগ্রাম না থাকায় অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ হাসপাতালের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে।
টিআইবি বলছে, হাসপাতালের পরিচালনসহ নিয়োগ, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, অনুদানের অর্থের আয়-ব্যয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (বিডিআরসিএস) চেয়ারম্যানকে ‘একচ্ছত্র ক্ষমতা’ প্রদান করা হয়েছে। তার কথামত কাজ না করায় হাসপাতাল পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অভিযোগও রয়েছে।
এমনকি হাসপাতালের লাইসেন্সও নিয়মিত নবায়ন করা হয়নি বলে তথ্য দেওয়া হয়েছে টিআইবির প্রতিবেদনে।
এছাড়া হাসপাতালের জনবল নিয়োগ ও পদায়নে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া, ডাক্তার নিয়োগে অবৈধ লেনদেন, চাকরি প্রত্যাশীদের থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে বলেও উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়।
সেখানে বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ হাসপাতালের প্রাত্যহিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনায় চিকিৎসক-নার্স ও নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি রয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এক ব্যক্তির হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায় এবং হাসপাতাল পরিচালনায় একক কর্তৃত্বের অবারিত প্রয়োগের ফলে সেবা প্রদানসহ সার্বিক কার্যক্রমে একদিকে সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়মনীতির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। অন্যদিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিহীনতা স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে।
“ব্যক্তিগত পছন্দ ও দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদায়ন থেকে শুরু করে ক্রয়খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ব্যাপকভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন। অন্য হাসপাতালের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে ক্রমেই হাসপাতালটি একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।”
হাসপাতালটিতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতির ‘পরিপন্থী কার্যক্রম’ পরিচালনা করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এ অবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও অংশীজনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এই সুশাসনের ঘাটতি থেকে উত্তরণে সবার আগে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। একইসঙ্গে ব্যবস্থাপনা অবকাঠামোর মূলধারায় সুশাসনের মৌলিক উপাদানসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে ঢেলে সাজাতে হবে।”
টিআইবির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ূন কবীর বলেন, “এই প্রতিবেদন সর্বৈব অসত্য। আমার সঙ্গে বা আমার পরিচালনা পর্ষদের কারোর সাথে টিআইবির কোনো আলাপ হয়নি।
“তারা এসব তথ্য কোন সূত্রে তৈরি করল আমরা বুঝতে পারিনি। আমি হাসপাতাল চালাই, আমার সঙ্গে একবার কথা বলবেন না? কেউ আমাকে একবার কিছু জিজ্ঞেস করে নাই।”
বিডিআরসিএস চেয়ারম্যানের প্রভাবে কোনো সমস্যা হয় কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সমস্যা তো হয়ই না, বরং আজ পর্যন্ত হসপিটালের বেটারমেন্টের জন্য এমন কোনো বিষয় নাই, যা উনি করেন নাই। কোনো কিছু নিয়ে গেলে উনি আরও সহযোগিতা করেন।
“তবে আমাদের এখানে কিছু অপ্রয়োজনীয় কর্মী বা নার্স রয়েছে, যাদের বেতন ৬০ হাজার টাকা। যেখানে নতুন ডাক্তারদের বেতন ২৫ হাজার টাকা। আমরা এ বিষয়ে (প্রতিবেদন) আগামীকাল আনুষ্ঠানিকভাবে একটা প্রতিবাদলিপি দেব।”
হাসপাতালের চলমান পরিস্থিতি সমাধানে ১৪ দফা সুপারিশও এসেছে টিআইবির প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি অর্ডার, ১৯৭৩ বা প্রেসিডেন্ট’স অর্ডার নং ২৬, ১৯৭৩ সংশোধন করে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা হ্রাস এবং সকল আয়-ব্যয় ও কর্মকাণ্ড বোর্ড সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিচালনা; হাসপাতালের জন্য একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত মানবসম্পদ কাঠামো/আর্গানোগ্রাম তৈরি করা; একটি আলাদা বিধিমালার প্রণয়ন করে হাসপাতালটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ সবস্তরের কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; হাসপাতালটির সুনাম পুনরুদ্ধার এবং হাসপাতালে সেবার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন ও অবকাঠামো মেরামতে কার্যকর পদেক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি।
টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।