লাইসা আহমদ লিসা বলেন, “এবারের নববর্ষের প্রথম প্রভাতে, আমরা মানুষের জয়গান করব, ভোগবাদ নয়, স্বার্থপরতা নয় মনুষ্যত্বকে পাওয়ার অভিলাষী ছায়ানটের আহ্বান থাকবে।"
Published : 06 Apr 2024, 05:34 PM
আত্মকেন্দ্রিকতা দূর করে আলো জ্বালাবার আহ্বান নিয়ে এবার বর্ষবরষের অনুষ্ঠান আয়োজন করবে ছায়ানট।
শনিবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনের মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সে কথাই জানাল সাংস্কৃতিক সংগঠনটি।
ষাটের দশকে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল ছায়ানট, এখন তা বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ।
সংবাদ সম্মেলনে এবারের আয়োজনের নানা দিক তুলে ধরেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা।
তিনি বলেন, “এবারের নববর্ষের প্রথম প্রভাতে, আমরা মানুষের জয়গান করব, ভোগবাদ নয়, স্বার্থপরতা নয় মনুষ্যত্বকে পাওয়ার অভিলাষী ছায়ানটের আহ্বান, স্বাভাবিকতার সাধনা এবং সম্প্রীতির ধ্যান ‘দূর করো আত্মকেন্দ্রিকতা, আপনি জ্বালো এই তো আলো’।”
ছায়ানট বলেছে, বৈশাখের প্রথম দিন ভোরের আলো ফুটতেই আহীর ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে এবারের নতুন বছর আবাহনের শুরু করা হবে।
পুরো অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। যোগ হয়েছে, জাতীয় কবির কালজয়ী সৃষ্টির বিজাতীয় অবমাননার প্রতিবাদ এবং লেখনীর দুর্দম শক্তিতে বাঙালির গণজাগরণে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে চলা আবু বকর সিদ্দিককে স্মরণ।
ছায়ানটের যুগ্ম সম্পাদক জয়ন্ত রায় বলেন, এবার আয়োজনে সম্মেলক গান থাকবে ১১টি, একক গান থাকবে ১৫টি এবং পাঠ ও আবৃত্তি থাকবে।
শুরুতেই একটি রাগসংগীত থাকবে। একক গান শোনাবেন শাহীন সামাদ, খাইরুল আনাম শাকিল, চন্দনা মজুমদার, লাইসা আহমেদ লিসাসহ অনেকে। পাঠ ও আবৃত্তিতে অংশ নেবেন রামেন্দু মজুমদার ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।
জয়ন্ত বলেন, “বর্ষবরণ সার্থক করতে আন্তরিক নিষ্ঠায় প্রায় আড়াই মাস আগে থেকেই গান তোলা আর গলা মেলানোর কাজে নেমেছে শতাধিক ক্ষুদে ও বড় শিল্পী।”
ঢাকার রমনা উদ্যানে দুঘণ্টাব্যাপী এই আয়োজন সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। দেখা যাবে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলেও (www.chhayanaut.com/digitalplatformchhayanaut)।
অনুষ্ঠান সামনে রেখে ছায়ানটের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়- “বিশ্বব্যাপী, বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ যেভাবে বেড়েছে সেভাবে কমেছে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, যার ফলে ক্ষয়ে চলেছে মানবতা, ক্রমান্বয় অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্বের ক্রমবৃদ্ধিতে, অন্য মানুষের প্রতি আচরণের অস্বাভাবিকতায় আজ আমরা মুখোমুখি নতুন সংকটের।”
“তবে এই সংকটে আমরা আশাহত হই না, দিশা হারাই না, বিশ্বাস করি মানুষের কাছে গিয়ে, মানুষের হাতে হাত রেখে সকলের সাথে মিলবার, চলবার, গাইবার সাধনাই মানুষকে আবার ফিরিয়ে আনবে মানুষের কাছে। স্বাভাবিকতা ও পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির সাধনায় আমাদের যুক্ত হতে হবে।
“মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার শক্তিতে বাঙালি মনুষ্যত্বের জয়গান গাইবে, উচ্চারণ করবে কত শতাব্দী করেছি মা পাপ মানুষেরে করি ঘৃণা, জানি মা মুক্তি পাব না তাহার প্রায়শ্চিত্ত বিনা, পরম প্রত্যয়ে বলবে হিংসা আর নিন্দা ছাড়ো মনটা করো পরিষ্কার। মানুষকে ভালবেসে নিজেকে সার্থক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আঁধার রজনী শেষে নবীন আলোয় নবীন আশায় নবীন জীবন লাভ করে সুদিনের পথে চলব আমরা, বাঙালিকে বলব, নাই নাই ভয় হবে হবে জয়।”
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লিসা বলেন, “সকলকে নিয়ে শুভ কর্মপথে চলবার, কণ্ঠে নির্ভয় গান তুলে নেবার ছায়ানটের এই আয়োজন সার্থক হবে সর্বজনের সমর্থন, অংশগ্রহণ এবং উপলব্ধিতে।
“বরাবরের মতই নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার এই আয়োজন সার্থক করে তুলতে অক্লান্ত সেবা দিয়ে চলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী এবং গণপূর্ত অধিদপ্তর। ছায়ানট কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিরলস শ্রম দিয়ে চলেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা, লাউড ওয়ার্কস এবং থার্টিনথ হুসার্স ওপেন রোভার গ্রুপ সদস্যরা।”
সাংবাদ সম্মেলনে বলা হয় এবারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রবেশপত্র নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা করে দিয়েছেন ছায়ানট সুহৃদ্ শারমিন আরা ও ছায়ানট প্রাক্তনী শাহরিয়ার হাবিব। দেড়শ শিল্পী-কর্মী ধারণ করতে সক্ষম মঞ্চ নির্মাণের কাজ চলছে। মঞ্চ সজ্জায় সহযোগী হয়েছেন আরেক প্রাক্তনী রন্জিত রায়।
অন্যদের মধ্যে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, সহ-সভাপতি আতিউর রহমান, খায়রুল আনাম শাকিল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
নিরাপত্তা বেষ্টনীতে এই আয়োজন কাম্য নয়
১৯৬৭ সালে নগরে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল ছায়ানট, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই সে অনুষ্ঠান হয়েছে; নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে সুরের মূর্চ্ছনা আর কথামালায়। কোভিডের দুবছর এ আয়োজন করা হয় ভার্চুয়ালি।
২০০১ সালে ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। তাতে ১০ জন নিহত হন। এরপর থেকে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই প্রতি বছর বর্ষবরণের এ আয়োজন হচ্ছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, “এই যে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে শিল্পীরা গান গাই, এটি তো শিল্পীদের এবং দর্শকের- কারো জন্যই কাম্য নয় কখনো। যে কথাটি আমরা বলবার চেষ্টা করছি, সমাজের মধ্যেই একটা অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। সমাজের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। সমাজের এই ক্ষতটা যদি নিরাময় করতে না পারি, তাহলে এর সমাধান হবে না। এর জন্য সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে হবে।”
পহেলা বৈশাখ যেন একদিনের বাঙালি সাজার প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত না হয়, তার আহ্ববান জানিয়ে সারওয়ার আলী বলেন, “এটি যেন সর্বজনের ভ্রাতৃত্ববোধের মিলনমেলায় পরিণত হয়।”
আতিউর রহমান বলেন, “পাকিস্তানিরা বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাত করেছিল, কারণ তারা জানতো বাঙালি যদি নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা করে তাহলে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছায়ানটের জন্ম।”
তিনি বলেন, “মানুষে মানুষে আমরা মিলতে চাই। সমাজের যে অনাচার, বৈষম্য আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আমাদের সংস্কৃতি চর্চা করার জন্য এই বর্ষবরণে আমরা একসঙ্গে সাম্যের গান গাইব।”
খাইরুল আনাম শাকিল বলেন, “এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়। বাংলা বর্ষবরণ বাঙালি সংস্কৃতির বৃহৎ আয়োজন বলা যায়, এজন্য এই উৎসবকে ঘিরে ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে সকল বাঙালি একত্রিত হতে পারে। আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার ভাবনা থেকেই ছায়ানট এই অনুষ্ঠান সাজায় বা পরিকল্পনা করে। একটি জাতির মূল পরিচয়ই হচ্ছে তার সংস্কৃতি।”