জন্মদিন ঘিরে কোনো আয়োজন করতে তিনি আগেই নিষেধ করে দিয়েছেন সবাইকে।
Published : 04 Apr 2024, 03:51 PM
“অল্পে তুষ্ট সহজ সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি,” গতবছর জন্মদিনে বলেছিলেন সন্জীদা খাতুন। ‘নবতিপূর্ণা’ শিরোনামের সেই অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শুনিয়েছিলেন, অনুষ্ঠানে এসেছিলেন হুইলচেয়ারে বসে।
বছর ঘুরে আবারও এল তার জন্মদিন। বৃহস্পতিবার তার ৯১তম জন্মবার্ষিকীর দিনটি তার কাটছে একেবারেই নিভৃতে।
জন্মদিন ঘিরে কোনো আয়োজন করতে তিনি নিষেধ করে দিয়েছিলেন সবাইকে। ফলে ছায়ানট বা অগণিত শুভানুধ্যায়ীরা এবারের জন্মদিনে কোনো আয়োজন করেননি।
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য সন্জীদা খাতুন এমনিতেই জন্মদিনের আয়োজন খুব একটা পছন্দ করেন না। তবে অনুরাগীরা অন্য বছর বাসায় গিয়ে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান, তার সঙ্গে আড্ডায় মাতেন। এবার সেটাও হচ্ছে না।
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "উনি তো এখন শারীরিকভাবে খুব একটা ভালো নেই। এজন্য উনিই আমাদের মানা করেছেন কোনো আয়োজন করতে। এবার কোনো আয়োজন করা হয়নি।"
অন্য বছর ছায়ানট বা কাছের মানুষজন ফুল নিয়ে গেলেও এবার সন্জীদা খাতুন তাতেও মানা করেছেন জানিয়ে লিসা বলেন, "এখন একটুতেই উনি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন।"
সন্জীদা খাতুনের ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ জানালেন, বেশিরভাগ সময় এখন বিছানায় শুয়েই কাটাতে হচ্ছে তার মাকে। কাউকে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন না। জন্মদিনে সবাইকে বাসায় আসতে নিষেধ করেছেন। কোনো অনুষ্ঠানও করা হচ্ছে না কোথাও।"
পার্থ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "শারীরিকভাবে এখন খুব একটা ভালো নেই।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল।
তিনি কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন।
সন্জীদা খাতুনের লেখার একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ গড়ে তোলার অনন্য কারিগর তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শুদ্ধ সংগীতের চর্চার পাশাপাশি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় ছিলেন সন্জীদা খাতুন, তখন সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মিনু আপা’ নামে।
গবেষক মফিদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্জীদা আপার জীবন পরিক্রমা আর বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণ হাতে হাত ধরে চলেছে। সত্যিকার অর্থে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।”
“সনজীদা আপা এক বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব” মন্তব্য করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মুফিদুল হক বলেন, “এমন কথা খুব বেশি মানুষের ক্ষেত্রে বলা যায় না, কিন্তু তার সম্পর্কে উচ্চকণ্ঠে বলা যায়।”
গত শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন। ছায়ানটের পাশাপাশি জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দার সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন।
একাধারে শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক সন্জীদা খাতুন সম্প্রতি ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
একুশে পদক, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) ভূষিত সন্জীদা ১৬টি বই লিখেছেন।
‘সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম’ বইটি তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রামাণ্য ইতিবৃত্ত এবং মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক তার একান্ত ভাবনাগুচ্ছ ধারণ করেছে।