গান হল সৌরভ ছড়ানোর জিনিস, এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আশির ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের জন্ম দেওয়া এই গায়ক।
Published : 19 Mar 2024, 12:31 AM
‘সরলতার প্রতিমা’র শিল্পী খালেদ ঢাকায় ফিরে বেশ কিছু কাজের পরিকল্পনা করছিলেন; ‘সময় খুব কম’ বলে বসে বসে তা নষ্ট করতে চাইছিলেন না। নতুন গান ঘুরছিল তার মাথায়।
আশির ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের জন্ম দেওয়া এই গায়ক সেইসব গান বাঁধতে চেয়েছিলেন এবারের ঢাকায় থাকার সময়টিতে। কথা ছিল সপ্তাহ তিনেক পরে এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধে চৈত্র সংক্রান্তিতে একটি অনুষ্ঠানে গান যাওয়ার।
এসবের কিছুই হল না, বুকে ব্যাথা নিয়ে বাসার পাশের হাসপাতালে যাওয়ার আগেই চলে গেলেন একেবারে-যেখান থেকে কেউ ফেরে না। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই তার গাওয়া গানের মতই হাহাকার ভক্তদের হৃদয়ে, ‘কোনো কারণে ফেরানো গেল না তাকে’।
ঢাকার ব্যান্ডগুলোর তারকাখ্যাতির স্বর্ণ সময়ে চাইম ব্যান্ডের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া খালিদের বাসা গ্রিনরোডে। তবে বেশ কিছু দিন থেকে বসবাস করতেন যুক্তরাষ্ট্রে।
সোমবার তার মৃত্যুর পর গায়কের ঘণিষ্ঠ কবি সঞ্জিব পুরোহিত বলেন, আমেরিকা যাওয়ার পর কোভিডকালীন সময়ে বসে থেকেই সময় কাটাতে হয়েছে। কয়েক মাস হল ঢাকায় ফিরেছেন তিনি। এসেই বেশ কিছু কাজের পরিকল্পনাও করেছিলেন।
তিনি বলেন, “আমেরিকা থেকে ফিরলেন সদ্য। ভাওয়াল ক্লাব ও দাঁড়কাকের যৌথ আয়োজনে চৈত্র সংক্রান্তি, ১৩ এপ্রিল শো হবার কথা ছিল।”
এদিন সন্ধ্যায় ঢাকার গ্রিনরোডের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন খালিদ। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নেওয়া হয় কাছের কমফোর্ট হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসক সন্ধ্যা ৭টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আমেরিকায় বসে ২০২১ সালে সংগীত শিল্পী ও সুরকার তানভীর তারেককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও খালিদ ঢাকায় ফিরে কাজ করার পরিকল্পনার বিষয়টি তুলে ধরেন। বলেছিলেন, ঢাকায় ফিরে বসে বসে সময় কাটাতে চান না। কারণ ‘সময় খুব কম’।
সাক্ষাৎকারটি ইউটিউবে ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকাশ করেন তারেক। এতে দেশে ফিরে বেশ কিছু নতুন গানের কাজ করার কথা বলেন। ইতোমধ্যে ১২টা গান রেডি আছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
শেষ জীবনে চাওয়া কি? এমন প্রশ্নে ‘হয়নি যাবারও বেলা’ গানের শিল্পী খালিদ বলেছিলেন, “আমার জন্য যেন কাউকে কিছু করতে না হয়। আমি যেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেই সব কিছু করতে পারি। এটাই আমার চাওয়া।”
খালিদের চলে যাওয়াটা যেন তারই চাওয়া মতই হল। কাউকে কিছু করার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলেন। যেন তার গানের মতই- ‘কোনো কারণে, কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে, ফেরানো গেল না কিছুতেই… সে যে হৃদয় পথের রোদে একরাশ মেঘ ছড়িয়ে হারিয়ে গেল নিমিষেই’।
পুরো নাম খালিদ সাইফুল্লাহ। ১৯৬৫ সালের ১ অগাস্ট গোপালগঞ্জে জন্ম নেওয়া এ শিল্পী রেখে গেছেন স্ত্রী ও এক ছেলে। খালিদ ১৯৮১ সালে গানের জগতে যাত্রা করেন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন ‘চাইম’ ব্যান্ডে।
'সরলতার প্রতিমা’, ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’, ‘হয়নি যাবারও বেলা’, ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’, ‘তুমি নেই তাই’-এমন বহু শ্রোতাপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন খালিদ।
১৯৮৯ সালে ‘নাতি খাতি বেলা গেল’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তার পর প্রথম বিদেশ সফরের ডাক আসে। কাতারের দোহায় একটি অনুষ্ঠানে গান করতে গিয়েছিলেন।
গত ৩ ডিসেম্বর চ্যানেল আইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খালিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, দীর্ঘ সংগীত যাত্রায় শিল্পী হিসেবে খালিদের আক্ষেপ কিসে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমার আক্ষেপ রয়্যালটি নিয়ে। আমার পাশের দেশেও একটা গান যদি হিট করে তার দু-পুরুষ বা চার পুরুষ আর কিছু করতে হয় না।
“আমার তো অনেক গান, তো কই? যদিও এটা বলা ঠিক না। গান বিক্রির জিনিস না, গানের মাধ্যমে সৌরভ ছড়ানোর জিনিস। আমার আক্ষেপ প্রাপ্য রয়্যালটি না পাওয়া।“
দীর্ঘ সংগীত যাত্রায় ‘সুনাম অর্জন’কেই নিজের প্রাপ্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন তিনি। ফেইসবুক, ইউটিউব ভালো কিছু দিচ্ছে না বলেও ভাষ্য ছিল তার। বলেছিলেন, “সারা পৃথিবীতেই চরম একটা অবক্ষয় হল ফেইসবুক আর ইউটিউব। গান হারিয়ে যাচ্ছে।”
ফেইসবুক যেন শোক বই
খালিদের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে অনেকেই তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে আবেগি মন্তব্য লিখেছেন। ফেইসবুক যেন হয়ে উঠেছে শোকবই।
অবসকিউর ব্যান্ডের শিল্পী সাইদ হাসান টিপু লেখেন, “বিটিভিতে দেখা, বলেছিলাম খালিদ ভাই আপনার সাথে আমার কোনো ছবি নাই । সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন । প্রিয় মানুষের বিদায় মেনে নিতে কষ্ট হয় । ভাল থাকবেন ভাই।”
সঙ্গীতশিল্পী জয় শাহরিয়ার লেখেন, "আহা খালিদ ভাই... কোনো কারণেই আর ফেরানো গেল না।"
শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ লেখেন, "শুধু গানেই রকস্টার নন, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও রাজপথে সোচ্চার ছিলেন খালিদ ভাই। বর্তমান সময়ের কর্পোরেট শিল্পীরা কখনও খালিদ ভাইয়ের মতন রকস্টার হতে পারবেন না। আমরা সৌভাগ্যময় প্রজন্ম, আমাদের সময়ের রকস্টারেরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে, একেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রসম। তাই তাঁদের চলে যাওয়াটা হজম করতে কষ্ট হয়, মেনে নিতে সময় নেয়। বিদায় রকস্টার খালিদ ভাই।"
অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান লেখেন, “আমার অসামান্য কৈশোরের একেক নক্ষত্রের বিদায়ে আমি ক্রমশই স্থবির হয়ে যাই।”
অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম লেখেন, “সে যে হৃদয় পথের রোদে একরাশ মেঘ ছড়িয়ে… হারিয়ে গেল নিমিষে…”।
আরও পড়ুন...