১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কোনো এক রাতে তরুণ নজরুল লিখেছিলেন রক্তে দোলা জাগানো সেই কবিতা; লিখেছিলেন- “বল বীর/ চির-উন্নত মম শির”
Published : 25 May 2024, 12:35 AM
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শিগগিরই ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’র স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক বেগম আকতার কামাল, যিনি কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ছায়ানট আয়োজিত ‘নজরুল উৎসব ১৪৩১’ এর সূচনা অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি বলেন, বিদ্রোহী কবিতাকে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান দেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে সরকারের মাধ্যমে ইউনেস্কোর কাছে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সুপারনিউমারারি অধ্যাপকের কথার সূত্র ধরে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহর কাছে বিষয়টি জানতে চায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমক।
তিনি বলেন, “আমরা নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রস্তাবটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার কথা, পরে ইউনেস্কোতে। আমাদের দিক থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, এরপর কোন ধাপে আছে, জানা নেই।
“আকতার কামাল নজরুল ইনস্টিটিউটের বোর্ড অব ট্রাস্টি, তিনি যে তথ্য দিয়েছেন, তা ঠিক আছে।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জনমানসে যখন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, তখন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কোনো এক রাতে তরুণ নজরুল লিখেছিলেন রক্তে দোলা জাগানো সেই কবিতা। লিখেছিলেন- “বল বীর/ চির-উন্নত মম শির”
কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। গত একশ বছরে বহু আন্দোলন সংগ্রামে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাঙালিকে দিয়েছে অনুপ্রেরণা।
ছায়ানটের অনুষ্ঠানে আকতার কামাল তার বক্তৃতায় বলেন, “বিদ্রোহী কবিতা রচনার পর নজরুলকে ‘বিদ্রোহী কবি’ নাম দেন প্রমথ চৌধুরী। মানুষের মাঝে যে বিচিত্র পদ-পদবি আছে, তা ভেঙে দিয়ে মানুষের আত্মসম্মানকে বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন নজরুল।”
জীবদ্দশায় নজরুল ‘বিতর্কিত কবি’ ছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মুসলমানরাও তাকে কাফের আখ্যা দিয়েছে, হিন্দুরাও তাকে মেনে নিতে পারেনি। ষাটের দশকে আমরা দেখেছি নজরুলের লেখায় শব্দ কাঁটছাঁট করা হচ্ছে ধর্মীয় চিন্তা থেকে। কিন্তু এখন দেখি নজরুলকে অনেকেই ‘তাদের’ বলে দাবি করেন। নজরুল আসলে সবার। নজরুল মানবতার কবি।
“কামাল পাশা নিয়ে লিখেছেন নজরুল, লিখেছেন খেলাফত আন্দোলন নিয়ে। তার সামনে যখন যে কর্তব্য এসেছে, তা নিয়েই লিখেছেন তিনি।”
আকতার কামাল যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ছায়ানটের সহসভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল।
ঢাকার ধানমণ্ডিতে ছায়ানট ভবনে নজরুল উৎসব ১৪৩১ এর সূচনা হয় ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মিলিত নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে। এরপর নাচ, গান, আবৃত্তিতে মুখর হয়ে ওঠে পরিবেশ।
কথন পর্বে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, “সাম্যের কথা বলেছেন নজরুল, মানবতার কথা বলেছেন নজরুল। সেই সাম্য এবং মানবতাবাদের চর্চাকে এগিয়ে নিতে আমাদের মধ্যে আসুন আরও বেশি প্রীতির বন্ধন তৈরি করি এবং মানবতার জয়গান গাই। তার প্রেরণাতেই আমরা শিকল পরে শিকলকে বিকল করি। আসুন নজরুল উৎসবে মানবতার জয়গান গেয়ে উঠি সকলে।”
ছায়ানটের সহসভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল মনে করেন, ছায়ানট বরাবরই রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে চর্চা করে আসছে।
তিনি বলেন, “আমাদের আত্মপরিচয় যদি জানতে চাই, তাহলে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে বার বার ফিরে যাই।”
কথন পর্বের পর পরিবেশিত হয় নজরুল সৃষ্ট রাগ ‘নবরাগ মালিকা’ এর ওপর গীতিনৃত্যালেখ্য। পাঠে অংশ নেন ত্রপা মজুমদার। সম্মেলক গান ও নৃত্যে ছায়ানটের পাশাপাশি আমন্ত্রিত শিল্পীরাও অংশ নেন।
একক গান শোনান জান্নাত-এ-ফেরদৌসী লাকী, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, ঐশ্বর্য সমদ্দার, পরিতোষ কুমার মন্ডল, মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া, আশা সরকার, সমুদ্র শুভম, ছন্দা চক্রবর্তী, ফেরদৌস আরা, লাইসা বিনতে কামাল, শুক্লা পাল সেতু, শর্মিষ্ঠা দাশ ও রেজাউল করিম।
সম্মেলক কণ্ঠে গান শোনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা। একক নৃত্য পরিবেশনায় ছিলেন সামিনা হোসেন প্রেমা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন নাজমুল আহসান ও হাসিব বিল্লাহ্।
যন্ত্রানুষঙ্গে তবলায় ছিলেন সুবীর ঘোষ ও স্বরূপ হোসেন, সেতারে ফিরোজ খান, কি-বোর্ডে রবিন্স চৌধুরী, বাঁশিতে মামুনুর রশীদ এবং মন্দিরায় প্রদীপ কুমার রায়।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় পরিবেশিত হবে সন্জীদা খাতুনের গ্রন্থনায় গীতি-আলেখ্য ‘সজল শ্যাম ঘন দেয়া’।
তৃতীয় দিন রোববার ‘নজরুলসংগীত: তথ্য, ভাব ও সুরসন্ধান’ গ্রন্থটি প্রকাশ করবে ছায়ানট। এ গ্রন্থে নজরুলের ৫০টি গানের ভাবসন্ধান, সুরসন্ধান ও তথ্যসন্ধান করা হয়েছে, যার সম্পাদনা করেছেন মফিদুল হক এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন সন্জীদা খাতুন।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ভাবসন্ধান নিয়ে কথা বলবেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং গ্রন্থ থেকে গানের ভাবসন্ধান নিয়ে গীতি-আলেখ্য ‘অন্তরে তুমি আছো চিরদিন’ পরিবেশিত হবে।