“প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝামাঝি অনেক প্রশ্নের উদয় হওয়া এক সিনেমার নাম হৃদিতা।”
Published : 14 Oct 2022, 07:33 PM
বিয়োগান্তক এক উপন্যাসের নাম ‘হৃদিতা’, যা সিনেমা হওয়ার আগে থেকেই অনেক মানুষ জানত। সেই পরিচিত গল্পের প্রায় অপরিচিত এক সিনেমার নাম যেন ‘হৃদিতা। অপরিচিত এই অর্থে যে ‘চেনা পরিচালক’ ইস্পাহানী আরিফ জাহানকে এই সিনেমায় আগের মাত্রায় খুঁজে পাওয়া যায়নি! জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের লেখা সরকারি অনুদানের এক সিনেমা হৃদিতা। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝামাঝি অনেক প্রশ্নের উদয় হওয়া এক সিনেমা হৃদিতা। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ‘হৃদিতা তোমার জন্য কাঁদছি’ বলার মতো এক সিনেমাও ‘হৃদিতা’!
প্রেম কিংবা ভালোবাসার প্রতিযোগিতার এক গল্প হৃদিতা। কিশোর বয়স পার হওয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া হৃদিতা কবিরুল নামের এক চিত্রকরের প্রেমে পড়ে। তুলনামূলক বেশি বয়সের কারণে কবিরুলের সঙ্গে হৃদিতার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরমধ্যে কবিরুল জানিয়ে দেয় এই সম্পর্ক সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় সেটা কবিরুলের মা জানিয়ে দেয় হৃদিতাকে। কবিরুলের কঠিন অসুখ থাকার কারণে ভালোবাসার প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য এক মিথ্যা অসুখের গল্প ফাঁদে হৃদিতা। সেও জানায় তার কঠিন অসুখ ধরা পড়েছে। বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে হৃদিতা ও কবিরুল কাছাকাছি আসে, তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তাদের বিয়ের পর জানা যায় হৃদিতার কোনো অসুখ নেই, কোনোদিন হাসপাতালেও যায়নি সে। কিন্তু মাজারে গিয়ে প্রার্থনার পরেও কবিরুলকে বাঁচানো যায় না। তার অনাগত সন্তানকে পেটে নিয়ে বেঁচে থাকে হৃদিতা।
প্রথমেই বলা হয়েছে, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝামাঝি অনেক প্রশ্নের উদয় হওয়া এক সিনেমার নাম হৃদিতা। প্রথম দৃশ্যে হৃদিতা দুর্ঘটনায় পড়ে। সেটা কি সিএনজি না বেবিট্যাক্সিতে? বেবিট্যাক্সির যুগ বলে কি মোবাইল দেখানো হয়নি? যদি তেমনই হয় তাহলে ঢাকা শহরের স্থাপনা, রাস্তা, ঘরবাড়ির বেলায়? রাস্তায় একটাও বেবিট্যাক্সি চলতে দেখা যায়নি! হৃদিতা ও কবিরুলের সিঙ্গারা খাওয়ানোর জন্য যে রেস্টুরেন্ট দেখানো হয়েছে, সেটা কি তখন ছিল?
বেঁচে থাকার জন্য মানুষ সব ধরনের প্রার্থনায় যায়, মাজারে গিয়েও প্রার্থনা করে। বাংলা সিনেমায় ভিন্ন ধরনের মাজার প্রীতি দেখা যায়, যা এই সিনেমাতেও আছে। মাজারে গিয়ে প্রার্থনার পর অনেক অসাধ্য সাধন হতে দেখা যায়। যদিও এই সিনেমাতে সেই অসাধ্য সাধন দেখানো হয়নি। উপন্যাসে কি এমনটা ছিল?
একটা সংলাপে আছে-‘কবিরুল খুব ভালো মানুষ কারণ সে কবুতরের মাংস খায় না’! ভালো হওয়া মাপার জন্য কি কবুতরের মাংস কোনো পরিমাপক? রানওয়েতে বমি করার ভঙ্গি নিয়ে যেভাবে কবিরুল ও হৃদিতা বিমানে ওঠে সেটা কি স্বাভাবিক?
কবিরুলের কঠিন অসুখ, অথচ সবসময় তাকে ফিটফাট দেখা যায়। তার পোশাক পরিপাটি ও চুল ছোট করে কাটা। শেষ দুই-তিন দৃশ্য ছাড়া সে যে অসুস্থ, এটা বোঝার উপায় নেই। হৃদিতাকে যখন কবিরুলের মা অসুস্থতার কথা জানায় তখন সংলাপ মিউট ছিল। ঢাকা বা তার আশপাশের কোনো নদীতে হৃদিতা ও কবিরুলের রোমাঞ্চ দৃশ্যে মাছরাঙা পাখির মাছ ধরার গ্রাফিকাল দৃশ্যটা হাসির উদ্রেক করে।
এই সিনেমার পরিচালক দুইজন। এম এন ইস্পাহানি ও আরিফ আল আশরাফ জুটি যাদের ফিল্মি নাম ইস্পাহানি আরিফ জাহান। মারপিট ধাঁচের জনপ্রিয় সিনেমা নির্মাণের জন্য পরিচালক জুটির খ্যাতি আছে। তাদের পরিচালিত সিনেমার মধ্যে বিদ্রোহী বধূ, লাট সাহেবের মেয়ে, সুখের স্বর্গ, আমার বউ, নায়ক, ভিলেন, গোলাম, মোস্তফা ভাই, আসলাম ভাই, মাথা নষ্ট, গুণ্ডা দ্য টেরোরিস্ট ও মিশন মাদ্রিদ রয়েছে। জনপ্রিয় ধাঁচের বাংলা সিনেমা নির্মাণের জায়গা থেকে সরে এসে তাদের ‘হৃদিতা’ নির্মাণের চেষ্টাকে নাটক মনে হয়েছে।
জনপ্রিয় ধাঁচের বাংলা সিনেমার মতো এই সিনেমাতে কোনো সিনেমাটিক আয়োজন নেই যে কারণে নাটকের ভাবটাই প্রবল এবং আবহ সংগীতের উপস্থিতিও কম মনে হয়েছে। সিনেমাজুড়ে ‘ইনহাউজ’ শুটিংয়ের আধিক্য চোখে পড়ার মতো।
হৃদিতা চরিত্রে অভিনয় করেছেন পূজা চেরি। এস এ হক অলীকের ‘গলুই’ সিনেমার মতো এই ছবিতেও তিনি সপ্রতিভ থাকার চেষ্টা করেছেন। বিউটি সার্কাসে এবিএম সুমনকে যতটা উজ্জ্বল মনে হয়েছে, হৃদিতার কবিরুল চরিত্রে তেমন মনে হয়নি। কবিরুলের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবেরি আলাম মোতাহার। হৃদিতার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনজুমান আরা বকুল এবং বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মানস বন্দ্যোপাধ্যায়।
একটি বিয়োগান্তক উপন্যাসের শেষদৃশ্যগুলো যতটা কান্নাকাতর হওয়ার কথা ছিল, এই সিনেমার শেষ দৃশ্যগুলোকে তেমন মনে হয়নি।
এই সিনেমার সবচেয়ে স্বস্তির দিক গল্প ও গান। গল্প জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের লেখা ‘হৃদিতা’ উপন্যাস থেকে নেওয়া। জনপ্রিয় দুটি গান লিখেছেন কবির বকুল, সুর করেছেন ইমরান মাহমুদুল। ‘ঠিকানাবিহীন তোমাকে লিখবো কোথায় আমি চিঠি’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন চন্দন সিনহা ও সিঁথি সাহা। গানটি ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে।
বেশ কয়েক বছর আগে পড়া হৃদিতা উপন্যাস এর স্মৃতি এখনও ম্লান হয়নি। কোনো এক বিষন্ন বিকালে কিংবা নির্ঘুম রাতে হৃদিতার কান্না এই সিনেমাতে তেমন করে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সিনেমার ফটোগ্রাফিতেও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই।
তবু জয় হোক বাংলা সিনেমার।