পারিবারিক জটিলতায় হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিয়ে কাজ হয় না বলে জানান নির্মাতার।
Published : 27 Jul 2024, 09:10 AM
আশি থেকে নব্বইয়ের প্রজন্মের কাছে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন গল্পের জাদুকর৷ ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ থেকে শুরু করে ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’-এর মতো জনপ্রিয় নাটক নির্মীত হয় তার গল্পেই।
১৯৯২ সালের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ সিনেমাটির গল্পকারও তিনিই। এই সিনেমার মাধ্যমেই সেরা গল্পকারের জাতীয় চলচ্চিত্রকারের সম্মান অর্জন করেন হুমায়ূন আহমেদ।
ধীরে ধীরে এক ঘণ্টার নাটক তৈরির মাধ্যমে পরিচালনাতেও আসেন তিনি। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদ নির্মীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’। এরপর একে একে তিনি নির্মাণ করেছেন আরও সাতটি সিনেমা। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ তার জনপ্রিয় সৃষ্টি।
হুমায়ূন আহমেদকে হারানোর প্রায় এক যুগ। তার মৃত্যুর পর অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে গেছে হুমায়ূন চর্চা৷ অনেকের মতে তার লেখা গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা কঠিন হয়ে গেছে। আগ্রহ থাকলেও পারিবারিক জটিলতায় হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিয়ে কাজ করতে পারেন না জনপ্রিয় নির্মাতারা।
জনপ্রিয় নির্মাতা অনিমেষ আইচ দীর্ঘ সময় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, গল্প থেকে নাটক নির্মাণ করেছেন, মিসির আলি নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাটক নির্মাণ করেছেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর কেন নাটক নির্মাণ বন্ধ হয়ে গেল এমন প্রশ্নে এই নির্মাতা গ্লিটজকে বলেন, "হুমায়ূন স্যার থাকাকালীন অনেক গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণ করেছি। ওনার শেষ ধারাবাহিকটা আমি নির্মাণ করেছিলাম। তবে স্যারের মৃত্যুর পর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তার মৃত্যুর পরে হুমায়ূন চর্চাটাই অনেকটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এটা খুব নেতিবাচক। হুমায়ূন আহমেদ যে গল্প বলেছেন, সমাজের, মানুষের মধ্যবিত্ত অবস্থার। সেই প্রজন্মটা কিন্তু আস্তে ধীরে মরে যাচ্ছে, বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। এখনো যদি হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিয়ে ভাবা না হয়, নির্মাণ না করা হয় পরবর্তী প্রজন্ম হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে জানতেই পারবে না।"
পারিবারিক জটিলতায় হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিয়ে কাজ হয় না তা জানিয়ে এই নির্মাতা বলেন, “আমি নিজেও স্যারের মৃত্যুর পর অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলাম অনেকগুলো কাজ করার। উনার গল্প থেকে নির্মাণের। কিন্তু পারিনি কারণ পারিবারিক কিছু জটিলতা ছিল। অনেকগুলো অনুমতি নিতে হয়। আমার মনে হয় হুমায়ূন আহমেদের পরিবার থেকে এটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তারা যদি কোনো ট্রাস্ট করে এটার উদ্যোগ নিয়ে হুমায়ূন চর্চাটা টিকিয়ে রাখে।”
সরকারি অনুদানে 'পেন্সিলে আঁকা পরী' নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী। সিনেমাটি নির্মাণ করতে না পারায় জরিমানাসহ টাকা ফেরত দিতে হয়েছিল এই নির্মাতাকে।
‘পেন্সিলে আঁকা পরী’ সিনেমা নিয়ে কী ধরনের জটিলতা হয়েছিল তা জানতে কথা হয় অমিতাভ রেজা চৌধুরীর সঙ্গে।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, "হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের কপিরাইটসের জটিলতায় সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত নির্মাণ করতে পারিনি। কপিরাইটের যে চার্জ ওনারা সেই সময় চেয়েছিলেন সেটা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সিনেমার বাজেট অনেক বেড়ে যাচ্ছিল।
"আমাদের দেশে যদি এক কোটি টাকা বাজেটের সিনেমা নির্মাণ করা হয় তাহলে কপিরাইটের ক্ষেত্রে কত টাকা দেয়া যাবে, সিনেমার বাজেটের আনুপাতিক হারেই তো কপিরাইটের বাজেট হয়। ১০০ কোটি টাকা বাজেটের সিনেমা বা ৫০ কোটি টাকার বাজেটের সিনেমা করলে কপিরাইটের টাকা বেশি দাবি করলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু এক কোটি সিনেমার ক্ষেত্রে তো অনেক টাকা দেওয়া যায় না। আমাদের দেশে সিনেমার মার্কেটটা তো সংকীর্ণ।"
হুমায়ূন আহমেদ এটি নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন জানিয়ে এই নির্মাতা বলেন, "হুমায়ূন আহমেদ আমাকে এটা ফ্রি দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'তুমি বানাও'। এটার কপিরাইট কিনে রেখেছিল আবু সাঈদ নামের এক ব্যক্তি। আমি আবু সাঈদের কাছ থেকে এটার কপিরাইট কিনি, তাকে টাকা দেই। কিন্তু ওনার মৃত্যুর পর পরিবার থেকে এত টাকাপয়সা চাইল যে, সেটা আমি দিতে রাজি হইনি। সিনেমা নির্মাণ থেকে সরে আসি। ওনার গল্পগুলো নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে পরিবার এতটা আগ্রহী না। ওনারা মনে করেন এটা নষ্ট হয়ে যাবে।"
দুটি সিনেমা নির্মাণের আগ্রহ ছিল হুমায়ূন আহমেদের গল্প থেকে। তা জানিয়ে এই অমিতাভ রেজা বলেন, "আমি 'জোছনা ও জননীর গল্প' ও ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’ দুটি সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছিলয়াম। আমি যদি এখনো সুযোগ পাই তাহলে ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’ নির্মাণ করতে চাই। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সিনেমা বানাতে অনেকে চায়, তার পরিবার যদি তাদের অধিকারটা একটু সহজ করে দিত, তাহলে হয়তো অনেকেই নির্মাণে আগ্রহ দেখাত। পরিবার থেকে সাপোর্ট সিস্টেমটা না আসলে উনার গল্প নিয়ে কাজ করার সাহস কেউ দেখাবে না।"
হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমায় কাজ করে দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন অভিনেতা ডা. এজাজুল ইসলাম। এরপর থেকেই নিয়মিত আছেন অভিনয়ে। এই অভিনেতার মতেও হুমায়ূনচর্চা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের উচিত এটার দায়িত্ব নেওয়া।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, "আমার মতে তার পরিবার বেশ কঠোর হয়ে আছেন। এগুলোর দায়িত্বে যারা আছেন তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। এই সাহিত্যের উত্তরাধিকার যাদের, তাদের নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আমার তো আর ইচ্ছে থাকলেও কাউকে দিতে পারব না। সুতরাং এসব উপন্যাসের অধিকারীদের একটু সজাগ হওয়া দরকার।"
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি মনে করে এই অভিনেতা বলেন, "এখনো প্রতিটা দিন আমি স্যারকে স্মরণ করি। একটা ঘটনা বলি, আমি একটি সুপারশপে শপিং করতে গিয়েছি, এক ভদ্রলোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার ছেলে-মেয়ে আপনাকে খুব পছন্দ করেন। আপনি বিরক্ত না হলে আমি আমি তাদের সঙ্গে একটু কথা বলিয়ে দিতে চাই। বাচ্চা দুটির একজন চতুর্থ শ্রেণিতে, একজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভিডিও কলে যখন তারা আমাকে দেখল, বাচ্চা দুটি চিৎকার করে উঠল। বলল, 'ওয়াও, আপনি তো হুমায়ূন আহমদের নাটক করেন’। এই ছোট দুটি বাচ্চা যদি চিৎকার করে উঠে সুতরাং হুমায়ূন স্যারের সময়ের কথা বলতে পারে, নাটক দেখে, তাহলে স্যার কখনো হারিয়ে যাবেন না। পরবর্তী প্রজন্মও তাকে খুব পছন্দ করবে। তার লেখা কোনোদিন পুরনো হবে না। বাংলা ভাষা, বাংলা নাটক যতদিন থাকবে ততদিন দর্শকের মন জয় করে যাবে। তাই হুমায়ূন চর্চাটা বাড়ানো উচিত।"
তবে চলতি বছরে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প ‘লোভ’ নিয়ে সিনেমা বানানোর জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সরকারি অনুদান পেয়েছেন পিংকি আক্তার। সিনেমাটি পরিচালনা করবেন সঞ্জয় সমদ্দার।
অনুমতির বিষয়টি জানতে চাইলে নির্মাতা বলেন, "'লোভ' সিনেমাটি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের কাছ থেকে যে অনুমতি পেয়েছেন সেই চুক্তিপত্র প্রযোজক আমাকে দিয়েছেন। আমি পরিচালক হিসেবে আমার জায়গা থেকে এটার অনুমতি আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়েছি। যখন জানানো হয়েছে যে, অনুমতি আছে তখন আমি কাজে নেমেছি। তাই এখন পর্যন্ত কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি।
“সিনেমাটির কাজ শুরু করেছি, আমরা প্রি-প্রোডাকশনের কাজ করছি। লোকেশন, স্ক্রিপ্ট রিরাইট এসব নিয়েই ব্যস্ত। আমি চেষ্টা করব আমার পরিশ্রমের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে নির্মাণের। আশা করছি খুব ভালো একটা সিনেমা হবে।"
সঞ্জয় সমদ্দার আরও বলেন, "তবে অনুমতির যে বিষয়টা, উত্তরাধিকারের বিষয়টা, সেটা তো উনার পরিবারের বিষয়। যেহেতু তাদের সম্পত্তি, তারা কীভাবে সেটার কপিরাইট চাইবেন, সেটা সম্পূর্ণই তাদের ব্যাপার। তবে তারা যদি জিনিসটাকে আরো সুন্দর এবং সহজ করে তোলেন, ওনাদের যেসব শর্ত বা চাওয়া আছে সেটা মেনে যদি কেউ কাজ করতে পারে, তাহলে হুমায়ূন আহমেদের গল্পে কাজ আরও বাড়বে।"
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী ও অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে। তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না এবং এই বিষয়ে কোনো ধরনের সাক্ষাৎকার দিবেন না বলে ফোন কেটে দেন।