“এখন যারা রাজনীতি করেন তারা ‘সমাজ বিচ্ছিন্ন’। তাদেরকে আমরা চিনি না, তারাও আমাদের চেনেন না“, বলেন এই নাট্যকার।
Published : 28 Apr 2024, 02:26 PM
রাজনীতিকরা সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছ থেকে ‘দূরে চলে গেছেন’ বলে মনে করছেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। এ জন্য আক্ষেপ করে তিনি বলেছেন, “রাজনীতি আর সংস্কৃতি যদি একসঙ্গে চলতে পারত, তাহলে সমাজ পরিবর্তন হত, ভালোভাবে চলত।”
শনিবার চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে চতুর্থ জাতীয় গণসঙ্গীত উৎসবে ‘শিল্পীর নাগরিক দায়, জীবন ও সংগ্রাম’ শীর্ষক সেমিনারে মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
‘ধর্ম ব্যবসায়ীরা’ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে বলে সতর্ক করে খ্যাতনামা এই নাট্যকার বলেন, “এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শিল্পীরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। …শিল্পী- সাহিত্যিক লাগে রাজনৈতিক সংগঠনে। কল্যাণের কথা চিন্তা করলে শিল্পের কাছে আসতে হবে।”
অতীতে রাজনীতিবিদ আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল, তার উদাহরণও তুলে ধরেন মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, “কাগমারী সম্মেলনে অধিকাংশ তোরণ ছিল শিল্পী, নাট্যকার ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে। ৯০ অভ্যুত্থানে যদি শিল্পীরা না থাকত রাজনীতির সঙ্গে তাহলে তা সম্ভব হত না।”
‘এক সময় রাজনৈতিক কর্মীরাই সংস্কৃতি এবং শিল্পীদের কাছে যেতেন’ জানিয়ে এই নাট্যকার বলেন, “এখন যারা রাজনীতি করেন তারা ‘সমাজ বিচ্ছিন্ন’। তাদেরকে আমরা চিনি না, তারাও আমাদের চেনেন না।“
শিল্পীদেরও দায় আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “জীবন সংগ্রামে সংস্কৃতি কর্মীরা ‘শিল্পের প্রতি দায় মেটায়’। কিন্তু এখন তাতে ছেদ পড়েছে। সংগ্রামের পথ থেকে যে সংস্কৃতিকর্মী পলাতক, তার পক্ষে শিল্প করা সম্ভব না।
“নাগরিক দায় পালন করতে গিয়ে কঠোর জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা কিছু দায় মেটাতে পারছি, কিছু পারছি না।…অনেক সময় আমরা আবার পিছলে যাচ্ছি। অসচেতন রাজনীতি ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কারণে আমরা পারি না।”
শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেওয়া কাজটি করে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু বর্তমানে আমরা পারি না। আপোষকামিতার কারণে অনেক কিছু পারা যাচ্ছে না, ভয়ের সংস্কৃতির কারণে অনেক ভালো কিছু করা হচ্ছে না।”
এর পরেও মানুষ তৈরি করার স্বপ্ন দেখে প্রত্যয়ের কথা বলেন মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, “শিল্পীরা সংকট বুঝতে পারে, এজন্য তারা আগামী দিনের গান করে। আমাদের গানে, নাটকে, কাব্যে প্রতিবাদ করে দাঁড়াতে হবে।”
সেমিনারে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক শামসুল হক বলেন, “স্বাধীনতার চেতনা থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। এ দেশ যখন সুন্দর অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল তখনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল। এরপরেই সংস্কৃতি কর্মী, লেখক ভাগ হয়ে গেল। পরবর্তীতে ৯০ দশকে সবাই একত্রিত হয়। কিন্তু এরপর আবারও রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে শিল্পীরাও আলাদা হয়ে যায়।
“এখন সংস্কৃতি কর্মীদের মিছিলে ৩০ জনের বেশি হয় না। অথচ মৌলবাদী সংগঠনের কর্মসূচি ও মিছিলে হাজার হাজার মানুষ হয়। সংস্কৃতি কর্মীদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের আরও অগ্রসর হতে হবে।”
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “সমাজের প্রতি দায় আছে সেসব শিল্পীদের, যাদের দেশের প্রতি দায়িত্ব আছে। তাদের নিয়ে আমরা কথা বলব।”
রাষ্ট্রভাবনা ও সমাজ ভাবনা না থাকলে ‘প্রকৃত শিল্পী’ হওয়া সম্ভব না জানিয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পরিচয় অবশ্যই থাকতে হবে। কাজী নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন ছিল।”
গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজী মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে সূচনা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
এবার উৎসবের বিভিন্ন অধিবেশনে লালন, কাজী নজরুল ইসলামের সাম্য ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, বর্ণবাদ বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী, কৃষক আন্দোলন, শ্রেণি-সংগ্রাম ও সমসাময়িক বিষয়ের গান পরিবেশন করা হয়।
এর বাইরে আব্দুল লতিফ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়-রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদের দেশের গান, ফকির আলমগীর-ভূপেন হাজারিকা, অজিত রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শাহ আব্দুল করিম, শেখ লুৎফর রহমান, সলিল চৌধুরী গান বিনোদিত করে মানুষকে।
ভাষা আন্দোলনের গান, চাকমা ভাষার গণসঙ্গীত, গারো গান, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষায় গণমানুষের গানও পরিবেশ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গণসঙ্গীতের দলগুলো।
আরো ছিল মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর গান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশের গান, মুকুন্দ দাস, অশোক সেনগুপ্ত আখতার হুসেন ও সেলিম রেজার গান।