নাজিয়া আন্দালীব প্রিমা, নিজে পরিচিতি সমকালীন দৃশ্যশিল্পী হিসেবে। তার এই লেখার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে তারই ‘মাইস্ট্রো’ মুর্তজা বশীরের নানান রংয়ের পরম্পরা।
Published : 18 Aug 2020, 06:46 PM
“কেমন আছো? আমি প্রতিদিন ছবি আঁকছি। তোমার কাছে কয়েন কি আছে নিয়ে এস, খুশী হব। ‘ইগারলি ওয়েটিং ফর দি ডেট।”
দৃশ্যমান ছবি এবং কথামালার এমনই মিষ্টি বিচিত্র-মূর্ত আমার মাইস্ট্রো বরেণ্য মুর্তজা বশীর।
‘বরেণ্য’ শব্দটাতে তাঁর ছিল ঘোর আপত্তি।
আমাকে প্রায়ঃশই বলতেন, “প্রিমা, এই পথ বড় পিচ্ছিল, খুব সাবধানে হেঁট যাতে প্রাপ্তির অহমিকায় পিছলে না পড়। আমি চাই তুমি শুধু পথ চলো।”
‘প্রিমাডোনা’ বইটির জন্য যখন একটা লাইন খুঁজছিলাম, তিনি ফোনে বললেন, ‘অ্যান ইনফিনিট জার্নি’।
আমাকে বুঝতেন তিনি এত গভীরে। আমরা দু’জনে কতদিন পার করেছি শিল্পের এই অসীম পথের স্বরূপ উন্মোচনে। অফুরন্ত প্রাণশক্তির আঁধার তিনি। অক্সিজেন তাঁর কি-বা প্রাণের সঞ্চার করবে- আমি তাঁর অক্সিজেন সিলিন্ডারের দিকে তাকিয়ে হাসি আর ভাবি।
“আমার বেশ কিছু কাজ এখনও বাকি “নতুন ড্রইং করছি কিডবিজ্যম স্টাইলে?, দেখেছো”
চিন্তা, চেতনা এবং কথার অভাব তাঁর কোনো কালেই ছিল না বলেই বোধকরি তিনি রেখায় অজেয়, দূর্লভ।
মুঠো ফোনে বলতেন, “আমি ১৫ মিনিট আগে পৌঁছে গেলাম। তুমি কিন্তু এগারোটাতেই দরজা খুল। আমি তোমার গ্যারেজে হাঁটাহাঁটি করছি।”
বন্ধুত্বের প্রগাঢ় অনুভূতি, তাঁকে বিনয় শ্রদ্ধাভরে ভালোবাসা- আমি মুর্তজা বশীরের থেকেই শিখেছি।
খণ্ড খণ্ড করে বিশাল ভূখণ্ড রচনার এক চমৎকার ক্ষমতা ছিল তাঁর।
আমার সঙ্গে আমার মাইস্ট্রো’র সম্পর্ক শব্দ-বর্ণ-রেখার মতো। কখনও কঠিন, কখনও পেলব, কখনও বা সমান্তরাল।
ভ্রমণে গেলে সবসময় আমার নজর থাকত দূর্লভ-পেপার কারেন্সিতে। কারণ প্রতিবার, প্রত্যেকবার আমাকে বলতেন, “আমার জন্য পেপার কারেন্সি আনতে ভুলবে না কিন্তু।”
ওনাকে নিয়ে লিখতে গেলে কেবল ‘ইনভাইটেড কোমা’-ই দিতে হবে। কারণ, এমন কথা কেবল শিল্পী মুর্তজা বশীর-ই বলতে পারেন। কত শিক্ষা-জ্ঞান-প্রজ্ঞা আমি আহরণ করেছি তাঁর থেকে। যেহেতু স্বভাবত আমি জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা পিপাসু তাই খুব সহজেই কাছে এসে পড়েছিলাম তাঁর। জীবনের নিবিড় শিষ্য-বন্ধু করে নিয়েছিলেন তিনি আমাকে।
আমাকে বলতেন, “জান প্রিমা, আমার ‘উইং’, ‘দেয়াল’, ‘এপিটাফ’- সিরিজগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পোধ্যায়।”
কিছু অপ্রদর্শিত নতুন কাজ আমায় দেখিয়েছিলেন ২০২০ এর শুরুর দিকে।
একটা বুদ্ধিদীপ্ত, চিন্তাশীল, দুষ্ট-মিষ্টি হাসি লেগে থাকতো তাঁর ঠোঁটে- চোখে। এ হাসি দেওয়াও এক দুর্বার শক্তি, অসম্ভব কারও পক্ষে।
আমাকে প্রায়ই বলতেন, “তুমি আমাকে কালো রংয়ে ব্যবহার শেখাবে? সাধারণত ক্যানভাসে কালো রংটা মরে যায়। কিন্তু তোমার কালো রং সবসময় জীবন্ত।”
আর মাঝে মাঝে বলতেন, “খেয়াল রাখবে একই রংয়ের পূর্ণব্যবহার যাতে না ঘটে। কারণ রংয়ের বৈচিত্র্য রংয়ের মাঝেই নিহিত, তাকে আবিষ্কার করবে।”
একজন মুর্তজার মতো শিল্পীকে আমরা কীভাবে ধারণ করব জানিনা।
অনেক আগে একবার এশিয়ান বিয়েন্নালেতে গিয়েছিলেন আমার কাজ দেখতে। বিমূর্ত ধারার কাজ অনুশীলন করতাম তখন আমি।
শিল্পকলা থেকে বাড়িতে ফিরে ফোনে বললেন “তোমার কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ দুটো কাজ (যথারীতি লাল এবং কালোর সংমিশ্রণ) পার করে যাওয়ার সময় গায়ে বিদ্যুতের চমক পেলাম। দেখলাম সে দুখানা কাজ তোমার।”
আমি এশিয়ান বিয়েন্নালের কোনো পদক রপ্ত করতে পারিনি বা হয়ত কখনও চাইওনি। কারণ এমন শিল্পীর কাছ থেকে আমার কাজের প্রতি এহেন অভিব্যক্তি যেকোনো পদককে ম্লান করে দেয় আমার কাছে। আমি অনুপ্রাণিত, তাই আমি সদা পিপাসিত, জাগ্রত শিল্পের কাছে। আমি কেবল শিক্ষার্থী মাত্র।
শিল্পীত জীবন কেবল চর্চা করা সম্ভব, ধারণও হয়ত করা যায়। কিন্তু ছাপিয়ে যাওয়া কখনই সম্ভব নয়। শিল্পরস আস্বাদন এবং তাতে অবগাহন করে গেছেন সর্বক্ষণ শিল্পী মুর্তজা বশীর। আমিও তাই এই দুয়ের মাঝে যেন শিল্পিত অনুরনন।
মাইস্ট্রো বলতেন “কাজের মধ্যে অমর হতে হবে, প্রিমা।”
এহেনু শিল্পীর কাছে জীবনও হার মেনে যায়। জীবনকে সবাই যাপন করে, তবে জীবনে প্রাণ একজন মুর্তজাই সঞ্চার করতে পারেন তাঁর সৃষ্টিশীলতায়, বিচিত্র সরল অভিজ্ঞতায় আর তাঁর থেকেও নিমগ্ন শৈল্পিক একাগ্রতায়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ, সম্পর্কের দ্যোতনা সবসময় সম্পর্ককে আরও গভীর করে নিয়ে যায় নিবিড় শিকড়ে।
শিল্পী আমিনুল ইসলামকে বড় ভালোবাসতেন। কত কথা তাঁকে নিয়ে, তাঁর কাজ নিয়ে বলতেন।
বলতেন দেবদাস চক্রবর্তীর কথা, কত শিক্ষা “আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব, ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছো জীবন নবনব”- মুর্তজা বশীর এমনই অশেষ।
১৭ অগাস্ট তাঁর জন্মদিন। গ্যালারি কায়াতে প্রতিবছর এই দিনে বিপুল আয়োজন। কারণ তিনি, তাকে ঘিরে কত অনুপ্রেরণা, উৎসাহ, কৌতুহল। সাহসী মুর্তজা বশীর, আমার আজন্ম পিপাসু শিক্ষক, হতে-কলমে নয় হৃদয়ে-মননে-দহনে। নতুন কোনো পোশাক পরলেই আমাকে জানাতেন,
একবার একটা হালকা রংয়ের শার্ট ওনাকে উপহার দিলাম, আমার প্রদর্শনী (২০০৯) তে পরবার জন্যে। উনি বললেন উজ্জ্বল রংয়ের একটা পাঞ্জাবি চাই। যথা আজ্ঞা, মাইস্ট্রো বলে কথা, সবুজ-নীলের মিশ্রণে একটা পাঞ্জাবি পরে এলেন উদ্বোধনে।
প্রায়ই বলতেন আমার ফিতা কাটতে ভালো লাগেনা। কিন্তু চলে যেতেন বারবার শিল্পীকে, শিল্পকে উদ্বুদ্ধ করতে। আমার কাজে কোনো বাহুল্য বা অসঙ্গতি দেখলে এক ধরনের অস্বস্তিতে পড়ে যেতেন যেন। আমিও অস্থির হয়ে যেতাম জানার আগ্রহে কি বলতে চান উনি। আমার কত অপ্রাপ্তি ওনার প্রাপ্তিতে খুঁজে পাই।
কতবার বলেছেন প্যারিস ইতালির সেই বাড়িগুলো দেখে আসতে যেখানে তিনি ছিলেন; আমি খুঁজে পাইনি তার চিহ্ন। মাঝে মাঝে আমি মোবাইলে রেকর্ড বাটনটা চেপে দিতে ভুলে গেলে বলতেন “রেকর্ডটা কর, কথাগুলো পড়ে শুনতে পাবে”
একজন শিল্পীকে জানা তার কাজকে জানার মতোই অপরিহার্য, গুরুত্বপূর্ণ, অনস্বীকার্য। শিল্পীকে অনুধাবন করতে হবে, তা না হলে শিল্পীর সৃষ্ট শিল্পকর্ম অব্যক্ত রয়ে যাবে, আর সেই শিল্পকে বিশ্ব ধারণ করতে ব্যর্থ হবে। তখন শিল্প শুধু অর্থের কাছেই নয় আমাদের জীবনের কাছেও পরাজিত হবে।
শিল্পের শিকড়ে তাই মুর্তজা বশীর। তিনি পেরেছেন এই জীবনবোধ থেকে জাগ্রত শিল্প সৃষ্টি করতে। অভিজ্ঞতা কে শৈল্পিক দৃশ্যমানতায় সন্নিবিষ্ঠ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। তিনি করেছেন, অবগাহন, ধারণ এবং উপস্থাপন।
আমার ২২তম একক প্রদর্শনী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে, কাজ দেখাতে গেলাম। আমার দেয়া কাযাকিস্থানের একটি টুপি পরে ওনার ড্রইং সমৃদ্ধ দেয়াল বেষ্টিত শোবার ঘরে উপবিষ্ট, কাজ দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললেন
“এবার তুমি মিরো আর কান্দিনিস্কিকে মিলিয়ে খেয়ে ফেল। তারপর বমি করে তোমার ক্যানভাসে ঢেলে দাও। দেখো কি মজা!”
আমি বাড়ি ফিরতে ফিরতে আনিস স্যারকে (প্রফেসর অ্যামিস্টোস আনিসু) ফোন করলাম। উনি হেসে উঠলেন, যদিও তখন তিনি বেশ একটা সুস্থ নন।
হেসে বললেন “বশীর, দারুণ বলেছে তো! তোমায় অনেক চিন্তার খোরাক দিয়েছে। তুমি চিন্তা করতে ভালোবাসো, ভাবো, তাই কর। নিশ্চয়ই উপভোগ্য কিছু হবে।”
আজও আমার ‘বমি’ করা হয়নি। আমি খেয়েই যাচ্ছি শিল্পের রসদ প্রতিনিয়ত একদিন বহু প্রতিক্ষীত সে উদ্গরণ হবে নিশ্চয়ই। একদিন আমি পরিপূর্ণ, তৃপ্ত হব; নতুন করে অতৃপ্ত হওয়ার বাসনায়। সেখানেও হেসে দাঁড়িয়ে থাকবে আমার শিল্পীত অনুপ্রেরণায় মুর্তজা বশীর।
আমাকে তার দুটো স্বাক্ষর করে দিয়েছেন কাল এবং ক্ষণ নিণর্য় করে।
শিল্পী বলেছেন, কোন সাল থেকে কোন সাল অব্দি স্বাক্ষরগুলো তিনি দিয়েছেন। পদ্ধতিগত কলাকৌশলও জানেন এক দক্ষ পরিপূর্ণ মানুষের মতো। আমাকে তাঁর উপর বইগুলো দিয়ে আবার ‘ফলোআপ’ করতেন, আমি পড়েছি কিনা জানতে।
নিজের কথাগুলো খুব অকপটে বলতে পারতেন মাইস্ট্রো, বলতেন তার নাম বিভ্রাট নিয়ে গল্প, তাঁর পরিবার, তাঁর দুই প্রিয় মেয়ে জুঁই/যুথীর কথা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (পড়াবার সময়কার কত ঘটনাবহুল তাঁর বিচিত্র জীবন)।
আর তাঁর একেকটা প্রদর্শনী মানেই পত্রিকার হেডলাইন। হেডলাইন হতে পারার অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তাঁর। মুর্তজা বশীর মানেই একটা খবর, আলোচিত আবার সমালোচিতও, নিজ সুখেই মিষ্টি হাসিমাখা মুখে এক এক করে ঘটনা বলে যেতেন অবিরাম।
মনে পড়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ধানমণ্ডির গ্যালারি প্রাঙ্গনে সেই প্রথম পরিচয় মাইস্ট্রোর সঙ্গে। তাঁর প্রতিটি কাজের পেছনে এক একটি গল্প। সৃষ্টি যে এক সুনির্দ্দিষ্ট অভিজ্ঞতা প্রকাশেরই আরেক নাম।
একটি স্কেচ খাতায় এঁকে দিয়েছেন আমার কিছু আত্ম প্রকৃতিও। আমি কথা বলি, তিনি আঁকেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে হঠাৎ মনে পড়ে রের্কডারে বাটনে তো চাপ দেওয়া হয়নি। যাঃ, আবার পরের বার।
গল্পের ছলে অবিরাম পাড়তেন শিল্প রচনা। তাঁর ড্রইং করতে সিরিজের ছটফটে প্রজাপতির ডানার রংয়ের যেমন ছিল সন্নিবিষ্ট বাঙময়তা আর এপিটাফ ডি মাট্রিয়ার-এ ছিল তেমনি শক্তিশালী ঘন রংয়ের বেদনা।
সমকালীন শিল্পে আগ্রহ ছিলো প্রগাঢ়; আমার পারফরমেন্সগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতেন, বলতেন “ছবি আঁকাও তো এক প্রকার পারফরমেন্স, কি বলো?”
আমি বলতাম, “সে অর্থে এখনওতো আমরা পারফরমেন্স করছি”
তিনি তাঁর দেয়াল সিরিজ থেকেই মূলত আহরণ করেছিলেন তাঁর ‘কালার প্যালেট’। দেয়ালের নিলোর্ভ নিবিড় রংয়ের প্রকাশ তাঁর পরবর্তী কাজগুলোতেও লক্ষ্যণীয়। বহু মাত্রিকতা তার শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য।
যেহেতু সৃজনশীল কাজের অঙ্গনে আমার নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ততা তাই তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল আমার কাজে। নতুন কাজ তাঁকে দেখাতেই হত, তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করতেন আমার কাজগুলো।
শিল্পের মধ্যেই গাঁথা পড়তো আমাদের বন্ধুত্ব। ছেড়ে দেওয়াই যদি হয় শিল্পের বৈশিষ্ট্য, জুড়ে থাকাই আমাদের পথচলার সাধনা। সাধনাই করেছে শিল্পী মুর্তজা বশীরকে অনাদিকালের কাছে চির অনুপ্রেরণা।